বৃহস্পতিবার ০২ মে ২০২৪
Online Edition

আইন-আদালতে বাংলা ভাষা প্রচলনের সকল প্রতিবন্ধকতা দূরীকরণ প্রসঙ্গ

এএম জিয়া হাবীব আহসান : গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের পবিত্র সংবিধানের ৩ নং অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রভাষা হবে বাংলা। উক্ত বিধানকে কার্যকর করার লক্ষ্যে প্রণীত হয়েছে বাংলা ভাষা প্রচলন আইন ১৯৮৭ (১৯৮৭ সালের ২নং আইন)। যার ৩ নং ধারায় বলা আছে “(১) এই আইন প্রবর্তনের পর বাংলাদেশের সর্বত্র তথা সরকারী অফিস, আদালত, আধা-সরকারী, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান কর্তৃক বিদেশের সাথে যোগাযোগ ব্যতীত অন্যান্য সকল ক্ষেত্রে নথি ও চিঠিপত্র, আইন-আদালতের সওয়াল জবাব এবং অন্যান্য আইনানুগ কার্যাবলী অবশ্যই বাংলায় লিখিতে হইবে। (২)৩(১) উপ-ধারায় উল্লেখিত কোন কর্মস্থলে যদি কোন ব্যক্তি বাংলাভাষা ব্যতীত অন্য কোন ভাষায় আবেদন বা আপীল করেন তাহা হইলে উহা বেআইনী ও অকার্যকর বলিয়া গণ্য হইবে। (৩) যদি কোন কর্মকর্তা বা কর্মচারী এই আইন অমান্য করেন তাহা হইলে উক্ত কার্যের জন্য তিনি সরকারী কর্মচারী শৃঙ্খলা ও আপীল বিধির অধীনে অসদাচরণ করিয়াছেন বলিয়া গণ্য হইবে এবং তাহার বিরুদ্ধে সরকারী কর্মচারী শৃঙ্খলা ও আপীল বিধি অনুসারে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হইবে।” ৪নং ধারায় এ আইনের উদ্দেশ্য পূরণকল্পে সরকারকে গেজেট বিজ্ঞপ্তি দ্বারা বিধি প্রণয়নের ক্ষমতাও দেয়া হয়েছে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে অদ্যাবধি আইন আদালতে তথা সর্বস্তরে বাংলা ভাষা চালু হয়নি। আমরা এখনও বাংলাবান্ধব একটি বিচার ব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারিনি। প্রতিবছর ২১শে ফেব্রুয়ারি এলে সর্বস্তরে বাংলাভাষা চালুর সোচ্চার আওয়াজ শোনা যায়। কিন্তু ফেব্রুয়ারি চলে গেলে সে আওয়াজ আস্তে আস্তে ক্ষীণ হয়ে যায়। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে আমরা ইংরেজী ২১ ফেব্রুয়ারী এর স্থলে বাংলা সনের ৮ই ফাল্গুনকে এখনও ভাষা দিবস হিসেবে চালু করতে পারিনি। আইনের একজন শিক্ষার্থী হিসেবে আইন-আদালতে বাংলা ভাষার প্রচলনের বিষয়ে সকল প্রতিবন্ধকতা দূরীকরণের প্রসঙ্গে দু’একটি কথা বলবো। আমাদের আইন-আদালতে বাংলা ভাষা প্রচলনে কোনো আইনগত বাধা না থাকা সত্ত্বেও এ কাজে আমরা এখনও পিছিয়ে আছি কেন? জার্মান, জাপান, ফ্রান্স, স্পেন, নেদারল্যান্ডস, চীন, রাশিয়া, সুইডেন প্রভৃতি দেশে তাদের মাতৃভাষায় বিদেশিদেরও কথা বলতে হয়। তাদের ভাষা শিখে সেখানে যেতে হয়, পড়তে হয়, থাকতে হয়। অথবা শেখার জন্য নির্দিষ্ট সময় দেয়া হয়। কিন্তু আমরা ভাষার জন্য রক্ত দিয়েও সে মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করতে পারলাম না। ফৌজদারী কার্যবিধির ৩৫৭ ধারায় আদালতে সাক্ষীর জেরা, জবানবন্দী ইংরেজি ভাষার বিকল্পে ‘আদালতের ভাষায়’ বা বাংলা ভাষায় লিপিবদ্ধ করতে সরকার নির্দেশ দিতে পারেন। বৃটিশ আমলের গোলামীর যুগে বাংলার প্রাদেশিক সরকার উক্ত ধারা মূলে ম্যাজিস্ট্রেট ও দায়রা জজ আদালতসমূহে জেরা জবানবন্দী ইংরেজি ভাষায় লিপিবদ্ধ করার নির্দেশ দিয়েছিলো। পাকিস্তান আমলেও তা বলবৎ থাকে। কিন্তু স্বাধীনতা অর্জনের পর বর্তমানেও এ ব্যাপারে সুস্পষ্ট নির্দেশনা বা বাধ্যবাধকতা না থাকায় আমাদের মাতৃভাষা বহু ক্ষেত্রে উপেক্ষিত। ফৌজদারি কার্যবিধি আইনের ৩৫৭ ধারায় ফৌজদারি আদালতের রায় ‘আদালতের ভাষায়’ অথবা ইংরেজিতে লিপিবদ্ধ করার নির্দেশ রয়েছে। হাইকোর্ট ব্যতীত অন্যান্য আদালতের ভাষা কি হবে তা ফৌজদারি কার্যবিধি আইনের ৫৫৮ ধারা মতে সরকার নির্ধারণ করতে পারেন। হাইকোর্টে সাক্ষীদের সাক্ষ্য কিভাবে গৃহীত হবে সে বিষয়ে বিধি প্রণয়নের ক্ষমতা ফৌজদারি কার্যবিধির ৩৬৫ ধারা মোতাবেক হাইকোর্টকে দেয়া হয়েছে। এ প্রকার বিধি প্রণয়নের জন্য হাইকোর্টের চূড়ান্ত এখতিয়ার রয়েছে। (সূত্রঃ সিলেক্ট কমিটি রিপোর্ট, ১৯৬১)। বাংলা ভাষা প্রচলন আইন ১৯৮৭ এর ৪ নং ধারায় উক্ত আইনের উদ্দেশ্য পূরণ কল্পে বিধি প্রণয়নের কথা বলা হয়েছে।  ১৯০৮ সনে প্রণীত দেওয়ানী কার্যবিধি আইনের ১৩৭ ধারায় উল্লেখ করা হয়েছে, ‘যে পর্যন্ত সরকার অন্য নির্দেশ প্রদান না করেন সে পর্যন্ত হাইকোর্টের অধীনস্থ যে আদালতে আদালতের ভাষা হিসেবে যে ভাষা প্রচলিত আছে সে আদালতে সে ভাষাই প্রচলিত থাকবে।’ সিভিল রুলস অ্যান্ড অর্ডারস (১ম খণ্ড) এর ১১নং বিধিতে উল্লেখ করা হয়েছে, ‘মামলার পক্ষগণ আরজি, বর্ণনা, দরখাস্ত ইত্যাদি এবং এফিডেভিট ইংরেজি ভাষায় দাখিল করিবেন।’ আদালতে বাংলা ভাষার ব্যাপক প্রচলন করতে হলে উক্ত আইনসমূহের পরিবর্তন, পরিবর্ধন, সংশোধন এবং প্রয়োজনমত নতুন আইন, বিধি ও বিজ্ঞপ্তি জারি করা আবশ্যক। এরশাদ সরকারের আমলে বাংলায় আইন প্রণয়ন শুরু হয়। বর্তমানে পার্লামেন্টের আইনসমূহ বাংলায় পাস হয়। সাথে সাথে এগুলোর ইংরেজি ভার্সনও প্রকাশ করা যেতে পারে। বিশিষ্ট সাংবাদিক মিজানুর রহমান খান বলেন, ‘সম্ভবত উচ্চ আদালতে বাংলা চালুর বাধা মনস্তাত্তি¦ক। এর সঙ্গে এক শ্রেণীর আদালতকেন্দ্রিক মানুষের স্বদেশি ঠকানোর ধান্ধাও আছে।’ ইংরেজি না জানা লোকের কাছে ইংরেজিতে বিচারকার্য পরিচালনা গোপন বিচারের সামিল যা সংবিধানের ৩৫(৩) অনুচ্ছেদে বর্ণিত ‘প্রকাশ্যে বিচার’ এর ধারণার পরিপন্থি। কারণ, ইংরেজি না-জানা লোকের কাছে ‘গোপন বিচার’ আর ‘প্রকাশ্য বিচার’ ধারণার পার্থক্য নেই। তাঁকে দুর্বোধ্যতার অন্ধকারে রাখতে বা ঠকাতে পারে যে কেউ। অথচ বাংলাদেশ নামের রাষ্ট্রের জন্মের আগেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেছিলেন, ‘আমরা ক্ষমতা নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সর্বত্র বাংলা চালু করে দেব। সে বাংলা যদি ভুল হয়, তবে ভুলই চালু হবে। পরে সংশোধন করে নেব।’ কিন্তু ক্ষমতা পেয়ে সংবিধান লিখতে বসে সে লিখাই বাকী পড়ল।” মূলত ব্যাংক ও অর্থ লগ্নিকারী প্রতিষ্ঠান সমূহে বন্ধকী দলিল ও পাওয়ার অব এটর্নি (আমমোক্তারনামা), চার্জ ডকুমেন্ট ইত্যাদি বাংলায় ড্রাফট করা হলে গ্রাহকদের ঠকানো যাবে না। তাই এক ধরণের দুর্বোধ্যতার অন্ধকারে রাখতেই এই প্রচেষ্টা। সংবিধানের কোথাও লেখা নেই নিম্ন আদালতে বাংলা ব্যবহার করা যাবে না, ইংরেজি ব্যবহার করতেই হবে। উচ্চ আদালতে ইংরেজি বহাল রাখার পেছনে কিছু সংখ্যক ব্যক্তির দূরভিসন্ধি ব্যবসায়ীক স্বার্থও থাকতে পারে। কিন্তু সম্মানিত বিচারকদের তা থাকার কথা নয়। তাঁরা কেন সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের অবোধগম্য ভাষায় রায় দিচ্ছেন। বিচার প্রার্থীর বোধগম্য ভাষায় বিচার ব্যবস্থাকে পরিচালিত করতে সমস্যা কোথায়। সম্প্রতি উচ্চ আদালতে যে সব বিচারপতি বাংলাভাষায় কতিপয় রায় দিয়ে ইতিপূর্বে নিজেদের স্থান করে নিয়েছেন তাদের মধ্যে বিচারপতি কাজী এবাদুল হক এবং বিচারপতি মোহাম্মদ হামিদুল হক (ডি,এল,আর, খ—৫০, ১৯৯৮,খ— ৫১, ১৯৯১), বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক, বিচারপতি আব্দুল আওয়াল, বিচারপতি মোহাম্মদ আবু তারিক এবং বিচারপতি এস,এম জিয়াউল করিম (ডি,এল,আর, খ—৬০, ২০০৮; বি,এল,টি, খ—১৫, ২০০৭; এম,এল,আর, খ—১২, ২০০৭; ডি,এল,আর, খ— ৫৯, ২০০৭; ডি,এল,আর, খ—৬১, ২০০৯; এম,এল,আর,খ—১৪, ২০০৯; ডি,এল,আর খ—৬০, ২০০৮; এম,এল,আর, খ—১৩, ২০০৮; এম,এল,আর, খ—১৪, ২০০৯), বিচারপতি মোহাম্মদ ফজলুল করিম, বিচারপতি মোহাম্মদ জয়নাল আবেদীন, বিচারপতি মোহাম্মদ হাসান আমিন (ল’গার্ডিয়ান, খ—৬,২০০৯), বিচারপতি খায়রুল হক, বিচারপতি মমতাজ উদ্দিন আহমেদ (বি,এল,সি, খ— ১৫, ২০১০) প্রমুখের নাম স্মরণীয় হয়ে থাকবে। এসব রায়ের পরেও অনেক মামলায় আরো কিছু বাংলায় রায় প্রদান করা হয়েছে। ২০১২ সালের মার্চ মাসে বিচারপতি এ,এইচ,এম শামসুদ্দীন চৌধুরী ও বিচারপতি এম এনায়েতুর রহমান এর নেতৃত্বাধীন বেঞ্চ বাংলা ভাষায় একটি রায় দিয়েছেন। মহান ভাষাদিবসকে স্মরণীয় করে রাখতে বাংলাদেশের উচ্চ আদালতে সর্বপ্রথম বাংলা ভাষায় রায় প্রদান করেন বিচারপতি এবাদুল হক। এরপর বিচারপতি আব্দুস সালাম ও বিচারপতি খায়রুল হক বাংলা ভাষায় জাজমেন্ট প্রদান করে উচ্চ আদালতে বাংলাভাষার মর্যাদাকে সুউচ্চে তুলে ধরেন। উচ্চ আদালতে সর্বাধিক বাংলা ভাষায় জাজমেন্ট দিয়ে অমর হয়ে আছেন চট্টগ্রামের কৃতী সন্তান শ্রদ্ধেয় বিচারপতি আব্দুস সালাম মামুন। অন্যান্য বিচারপতিরা এ ধারাকে শাণিত করতে বিরাট অবদান রাখতে পারেন। বর্তমানে আইন মন্ত্রণালয় বাংলাদেশ কোড এ ইংরেজি ও বাংলা ভাষায় যুগপৎভাবে আইন প্রকাশ করে মাতৃভাষায় আইন চর্চার পথকে অনেক সুগম করেছে। কিন্তু ‘ল জার্নালসমূহ (ডি,এল,আর/ বি,এল,ডি/ ’ল ক্রনিক/ এম,এল,আর/ বি,এল,সি/বি,এল,টি প্রভৃতি) এখনও ইংরেজির পাশাপাশি বাংলা ভার্সন পুরোপুরি চালু করতে পারেনি। ফলে মাতৃভাষায় আইন চর্চা চরমভাবে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। বাংলা ভাষায় সকল আইন রচনা ও প্রকাশ করতে হবে। যথাযথ সম্মান পূর্বক বলছি, ভালো ইংরেজি জানা অনেক সিনিয়র আইনজীবীকে দেখেছি যারা সুন্দর বাংলায় আর্জি/ জবাব লিখতে পারেন না। এটাকে যোগ্যতা মনে করার চেয়ে অযোগ্যতা মনে করা শ্রেয়। যা বাংলার প্রতি অবহেলা ও উদাসীনতা ছাড়া আর কিছুই নয়। অনেকে পান্ডিত্য জাহির করতে ইংরেজির পাশাপাশি বাংলাকে গ্রহণ বা ইংরেজির অধিক গুরুত্ব দিতে পারছেন না। সাথে সাথে সাধু চলিতের মিশ্রণে লেখা আর্জি/ জবাব দেখলে মাতৃভাষার প্রতি এত অবজ্ঞার কষ্ট সহ্য করা যায় না। বাংলা ভাষাকে বিশ্বের দরবারে সঠিকভাবে তুলে ধরতে ইংরেজিও জানা দরকার, কিন্তু সর্বস্তরে মাতৃভাষাকে চালু করতে না পারলে বিশ্ববাসীরা এ ভাষাকে যথাযথ গুরুত্ব দিতে এগিয়ে আসবে না। বাংলাকে অবজ্ঞা করে ইংরেজী চর্চার মানে হয় না। বাংলা ও ইংরেজী চর্চা প্যারাল্যাল বা যুগপৎ হওয়া চাই। এখন থেকে বাংলায় গেজেট/ জাজমেন্ট/ রাষ্ট্রপতির আদেশ ইত্যাদি সম্পূর্ণ বাংলা ভাষায় প্রকাশ করে সাথে ইংরেজি ভার্সন প্রকাশ করা যেতে পারে। অতীতের সমস্ত গেজেট/ জাজমেন্ট ও দেশি বিদেশি আইন বইয়ের বাংলা অনুবাদে সমগ্র দেশের আইন অঙ্গন ভরে দিতে হবে। স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশে সর্বস্তরে বাংলা ভাষা চালুর নির্দেশ সম্বলিত এক বিজ্ঞপ্তি প্রচার করা হয়েছিল। এর পর অফিস আদালতে ব্যাপক সাড়া জাগে। বর্তমানে নিম্ন আদালতে আরজি, বর্ণনা, দরখাস্ত, এফিডেভিট, হাজিরা ইত্যাদিতে বাংলা ভাষার ব্যাপক প্রচলন শুরু হয়েছে। বিচারকরা অনেকেই বাংলায় আদেশ ও রায় প্রদান করছেন। জেলা ও মহানগর আদালতসমূহও কিছু কিছু রায়, ডিক্রি, আদেশ বাংলায় দিচ্ছেন, যাদের সাধুবাদ জানানো যায়। বাংলা সাঁটলিপি বা স্টেনোর অভাবে এক সময় আদালতে বাংলা ভাষা ব্যবহারে প্রধান বাধা ছিল। বর্তমানে সে বাধা দূর হওয়া সত্বেও মাতৃভাষায় উচ্চ আদালতে ব্যাপক জাজমেন্ট দেয়া হচ্ছে না। আদালতে ব্যবহৃত ও বহুল প্রচলিত ফারসি ও ইংরেজি শব্দসমূহের উদ্ভট বাংলা না করে সেগুলোকে চালু রেখে বাংলা অনুবাদ কার্য করা যেতে পারে। যেমন- এজাহার এজলাশ, পেশকার, সোলেনামা, নামজারি, জামিন, তলবানা, তপশীল, রিভিশন, হাজিরা, মুসাবিদা, এওয়াজ, মুনসি, সুরতহাল, আলামত ইত্যাদি শব্দ। যেহেতু দীর্ঘদিন ইংরেজি ভাষায় সবকিছু চালু ছিল, তাই আইন আদালতে দ্রুত বাংলা চালু এতো সহজ নয়। আইনজীবী, বিচারক, আদালত কর্মচারী, আইন ছাত্র, গবেষক ও শিক্ষকগণের সম্মিলিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে আইন আদালতে মাতৃভাষা বাংলা চালু করা সম্ভব। এজন্যে গত ১৯৮৭ সালের ৮ মার্চ সর্বস্তরে বাংলা ভাষা প্রচলন আইন পাস হয়েছে। এ আইন প্রণয়ণের উদ্দেশ্য ছিল বাংলাদেশের অফিস আদালতে বাংলা ভাষার প্রচলন নিশ্চিত করা। এতে আইন আদালতে, সওয়াল জওয়াব এবং অন্যান্য আইনানুগ কার্যাবলী অবশ্যই বাংলা ভাষায় লিখিত হবে মর্মে উল্লেখ আছে। আমাদের সংবিধানের ৩ অনুচ্ছেদের বিধান মোতাবেক ‘প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রভাষা বাংলা’ এ বিধানকে পূর্ণরূপে কার্যকর করার উদ্দেশ্য প্রণীত আইনটি দৃঢ়তার সাথে বাস্তবায়ন করা আবশ্যক। আইন কমিশন ২০১১ সালের ৯ ফেব্রুয়ারিতে বাংলা ভাষা প্রচলন আইন ১৯৮৭ বাস্তবায়নে কতিপয় সুপারিশমালা পেশ করেছে। এতে বাংলাদেশের উচ্চ আদালতসহ সব আদালতের বিচারকার্যে বাংলাভাষা চালু করার সুবিধার্থে ইংরেজিতে রচিত বিদ্যমান আইনগুলো বাংলায় অনুবাদের সুপারিশ করে। সংবিধানের ৩ অনুচ্ছেদ এবং বাংলা ভাষা প্রচলন আইনের বিধান মতে আদালতসহ প্রজাতন্ত্রের সকল কার্যক্রম ও রাষ্ট্রীয় নথিপত্র বাংলা ভাষায় বাধ্যতামূলকভাবে সম্পাদিত হওয়ার কথা। রাষ্ট্রের ৩টি অঙ্গের মধ্যে সে অনুযায়ী অনুসরণ চলছে। নিম্ন আদালতেও তা অনুসরণ করা শুরু হয়েছিল। কিন্তু হাসমত উল্লাহ (মোঃ) বনাম আজমিরী বিবি ও অন্যান্য মামলায় (৪৪ ডি,এল,আর পৃষ্ঠা- ৩৩২-৩৩৮;অনু-২০) মাননীয় হাইকোর্ট বিভাগ রায় দিয়েছেন যে, সরকার অধস্তন দেওয়ানি আদালতের ভাষার ব্যাপারে দেওয়ানি কার্যবিধির ১৩৭(২) ধারায় কোনো ঘোষণা দেয় নাই, বিধায় বাংলা ভাষা প্রচলন আইন জারি করা সত্তে¦ও অধস্তন দেওয়ানি আদালতের কার্যক্রম ইংরেজি ভাষায় চলমান রাখা যাবে। ফলে আজ অবধি বিচারকাজে বাংলা ভাষা পুরোপুরি চালু করা সম্ভব হয়নি। বাংলাদেশ সংবিধানের অনুচ্ছেদ-৩, ২৩ এবং ২৩ (ক) সর্বস্তরে মাতৃভাষা বাংলা ভাষা চালুর পক্ষে। মনে পড়ে ২০১৪ সালের ৩রা মে মাসে সুপ্রিম কোর্টের বিজ্ঞ আইনজীবী এডভোকেট ইউনুস আলী আকন্দ মহামান্য সুপ্রিম কোর্ট হাইকোর্ট বিভাগে বাংলা ভাষা প্রচলন আইন বাস্তবায়নের জন্য একটি রিট আবেদন করেন। মহামান্য হাইকোর্ট ঐ বছর ১৫ মে’র মধ্যে সরকারকে বাংলা ভাষা প্রচলনের নির্দেশ দেয়। বাংলা ভাষা প্রচলনে হাইকোর্টের দেওয়া আদেশ বাস্তবায়নে সরকারের অগ্রগতি প্রতিবেদন আদালতে দাখিল করার পর বিচারপতি কাজী রেজাউল হক ও বিচারপতি এবিএম আলতাফ হোসেন গঠিত হাইকোর্টে বেঞ্চ এ আদেশ দেন। একই সাথে আদালত বলেন, বাংলা পত্রিকায় বাংলা বিজ্ঞাপন দিতে হবে এবং ইংরেজী পত্রিকায় ইংরেজী বিজ্ঞাপন দিতে পারবে। তবে অন্য সকল ক্ষেত্রে বাংলা ভাষা প্রচলনে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে বলা হয়েছে। এর আগে একই বেঞ্চ এক মাসের মধ্যে সকল বিদেশী ভাষার বিজ্ঞাপন এবং গাড়ীর নেইম প্লেট বাংলায় পরিবর্তনের জন্য কেন নির্দেশ দেওয়া হবে না তা জানতে চেয়ে রুল জারী করে। দুই সপ্তাহের মধ্যে বিবাদী মন্ত্রীপরিষদ সচিব, আইন সচিব, স্বরাষ্ট্র সচিব, বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ও সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্টারকে জবাব দিতে বলা হয়েছিল। গত ২০১৭ সালের ৫ ফেব্রুয়ারিতে নগরীর বিভিন্ন এলাকায় বিদ্যমান সকল সাইনবোর্ড পরবর্তী ৩০ দিনের মধ্যে বাংলা ভাষায় রূপান্তরের নির্দেশ দিয়ে পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করেছিল চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন। এর প্রায় এক বছর পর গত ১ ফেব্রুয়ারি (২০১৮) আরেকটি বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে সংস্থাটি। এতে বলা হয়, ‘ইদানীং লক্ষ্য করা যাচ্ছে যে,কোন কোন প্রতিষ্ঠানের নামফলক,সাইনবোর্ড,ব্যানার ইংরেজি ও অন্যান্য ভাষায় লেখা হয়েছে। ’ চসিকের সর্বশেষ এ বিজ্ঞপ্তিই প্রমাণ করে,চট্টগ্রাম শহরে এখনো ভিনদেশি ভাষায় লেখা সাইনবোর্ড, ব্যানার রয়েছে। অথচ ২০১৪ সালে উচ্চ আদালত সুস্পষ্ট নির্দেশনা দিয়েছিল, ‘সাইনবোর্ড বাংলায় লিখতে হবে।’ চার বছরেও উচ্চ আদালতের নির্দেশনা পুরোপুরি বাস্তবায়িত না হওয়ার কারণ কী? এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে জানা গেছে, মাঠ পর্যায়ে সঠিক তদারকির অভাবে উপেক্ষিত থেকে গেল উচ্চ আদালতের নির্দেশনা। তদারকির দায়িত্ব কার:  একটি রিটের প্রেক্ষিতে ২০১৪ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি উচ্চ আদালতের দেওয়া রায়ের আদেশে ‘দেশের সব সাইনবোর্ড, বিলবোর্ড, ব্যানার,গাড়ির নম্বর প্লেট,সরকারি দপ্তরের নামফলক এবং গণমাধ্যমে ইংরেজি বিজ্ঞাপন ও মিশ্র ভাষার ব্যবহার বন্ধ করতে নির্দেশ দেন। এ বিষয়ে সরকারকেই ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছিল ওই সময়। আদালতের রায়ের প্রেক্ষিতে একই বছরের ১৪ মে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় চিঠি দিয়ে সিটি করপোরেশন, পৌরসভা ও ক্যান্টনমেন্ট বোর্ডগুলোকে আদেশটি কার্যকর করতে বলেছিল। পরবর্তীতে ২০১৬ সালের ২৮ জানুয়ারি জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে আরেকটি চিঠি দেয়। ওই চিঠিতে উচ্চ আদালতের নির্দেশনার কথা উল্লেখ করে দ্রুততম সময়ের মধ্যে সাইনবোর্ড, বিলবোর্ড, ব্যানার ইংরেজির স্থলে বাংলায় রূপান্তরের উদ্যোগ নেওয়ার জন্য অনুরোধ করা হয়েছিল। অর্থাৎ চট্টগ্রাম শহরে বিষয়টি কার্যকর করবে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন। সংবাদপত্রে প্রতি বছর ফেব্রুয়ারি মাস এলে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করেই যেন দায়িত্ব পালন করে সিটি কর্পোরেশন। এর বাইরে সারা বছর উল্লেখযোগ্য দৃশ্যমান কোনো তৎপরতা দেখা যায় না। এদিকে ২০১৫ সালের ১৮ আগস্ট উচ্চ আদালতের একটি রায়ে মন্তব্য করা হয়েছিল, ‘বাংলা ব্যবহারে দৃশ্যত কোনো অগ্রগতি নেই।’ ২০১৬ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে একটি চিঠি পাঠানো হয়েছিল। সেখানে ‘সাইনবোর্ড,বিলবোর্ড,ব্যানার ইংরেজির স্থলে বাংলায় প্রতিস্থাপিত হয়েছে বলে দেখা যায় না’ উল্লেখ করে বলা হয়েছিল, ‘এটা বাংলা ভাষা প্রচলন আইন,হাইকোর্টের রুল ও আদেশের পরিপন্থী।’ জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান প্রফেসর ড মিজানুর রহমানের ভাষায়, “বাংলা ভাষা অদ্যাবধি মানুষের ভাষা, জনগণের ভাষা হিসাবেই রয়ে গেছে। রাষ্ট্রীয় ভাষা হিসাবে এর উত্তরণ ঘটেনি।” বাংলাদেশ আইন সমিতির সভাপতি এ কে এম আফজাল মুনির বলেন, ‘উচ্চ আদালতে ইংরেজি বহাল রাখার পিছনে উচ্চ আদালতের কিছুসংখ্যক আইনজীবীদের ব্যবসায়িক স্বার্থ থাকতে পারে কিন্তু মাননীয় বিচারকগণের তো তা নেই। তবুও সম্মানিত বিচারকগণ সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের অবোধগম্য ভাষায় রায় দিচ্ছেন কেন? আমার মনে হয় এর অন্যতম একটি কারণ হচ্ছে উচ্চ আদালতের বিচারক হিসেবে নিয়োজিত হওয়ার পূর্বেকার কর্ম অভিজ্ঞতার কারণে অনেকেই বাংলার চেয়ে ইংরেজীতে রায় লিখতে বেশী স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। এক্ষেত্রে প্রশ্ন হচ্ছে এদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের বোধগম্য ভাষায় আদালতের রায় দেওয়ার জন্য এতটুকু কষ্ট স্বীকার কি মাননীয় বিচারপতিগণ করবেন না ? তারা যদি এ কষ্ট স্বীকার করে তাদের রায় বাংলায় লেখা শুরু করেন এবং পাশাপাশি আইনজীবীদের বাংলায় দরখাস্ত ও জবাব লিখতে উৎসাহিত করা শুরু করেন তবে উচ্চ আদালত সহ সমস্ত বিচার ব্যবস্থায় বাংলা ভাষা ব্যবহারের ক্ষেত্রে একটি বিপ্লব সাধিত হবে এবং বিচার প্রার্থীরা তাদের নিজ ভাষায় বিচার পাওয়ার অধিকার প্রাপ্ত হবেন।” প্রফেসর ড সলিমুল্লাহ খান বলেন, অদ্যাবধি সর্বস্তরে বাংলা ভাষা চালু না হওয়া বেদনাদায়ক। মাতৃভাষার সম্মান বৃদ্ধির লক্ষ্যে আদালতে বাংলা ভাষার ব্যবহার আরো সমৃদ্ধ করতে হবে। এ জন্যে প্রয়োজন সংশ্লিষ্টদের সদিচ্ছা। উচ্চ আদালতে বাংলা চালুর ক্ষেত্রে আমাদের অনিচ্ছাই প্রধান বাধা। আইন শিক্ষা ব্যবস্থায়ও বাংলা ভাষার ব্যবহার জোরদার করা জরুরি। বিচারক, আইনজীবী ও ভাষাবিদদের সমন্বয়ে এ ব্যাপারে একটি শক্তিশালী কমিটি করে আইন-আদালতে বাংলা ভাষা চালুর কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে। একটি বাংলাবান্ধব বিচার ব্যবস্থা আমাদের দীর্ঘদিন চাওয়া পাওয়ার সোনার হরিণ। সর্বস্তরে মাতৃভাষা বাংলা চালু হোক ভাষা শহীদের এ প্রত্যাশা পুনর্ব্যক্ত করছি।
লেখক : আইনজীবী, কলামিস্ট, সুশাসন ও মানবাধিকার কর্মী

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ