মঙ্গলবার ০৫ ডিসেম্বর ২০২৩
Online Edition

শিবির মাত্রই কি গ্রেপ্তার ন্যায্য

তারেকুল ইসলাম

সম্প্রতি সুনামগঞ্জের টাঙ্গুয়ার হাওড় এলাকা থেকে ‘শিবির সন্দেহে’ একদল বুয়েট শিক্ষার্থীকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। এরপর সন্ত্রাসবিরোধী আইনে মামলা দিয়ে আদালতের মাধ্যমে তাদের কারাগারে পাঠানো হয়। অবশ্য দুদিনের মাথায় আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে আদালতে তাদের জামিনও দেয়া হয়। আটককৃত শিক্ষার্থীদের দাবি- তারা সেখানে দলবেঁধে ঘুরতে গিয়েছিল। কিন্তু পুলিশের ভাষ্যমতে, সরকারবিরোধী নাশকতার পরিকল্পনার অভিযোগে তাদের গ্রেপ্তার করা হয়। প্রকৃতপক্ষে, এ ধরনের ‘শিবির সন্দেহে’ এবং কথিত নাশকতার পরিকল্পনার অভিযোগে বিরোধীদের ওপর গ্রেপ্তার-জেল-জুলুম ও হয়রানি আজকে নতুন নয়। এভাবে যত্রতত্র ভীতি ও ত্রাস সৃষ্টি করে বিরোধী পক্ষের আন্দোলন দমনের অপকৌশলটি পুরনো। তাই এটা ভাবা অসঙ্গত হবে না যে, চলমান গণ-আন্দোলনের গতি ঠেকাতে নতুন করে ভীতি উৎপাদনের উদ্দেশ্যে ওই বুয়েট শিক্ষার্থীদের ‘শিবির সন্দেহে’ গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। 

প্রশ্ন হলো, শিবির হলেই কি গ্রেপ্তার ন্যায্য হয়ে যায়? ‘সন্দেহ’ পরে; আগে এ বিষয়ে ফায়সালা করতে হবে যে, সন্দেহাতীতভাবে কেউ শিবির হলেও বিনা ওয়ারেন্টে তাকে গ্রেপ্তার করা যায় কি-না; শিবির পরিচয় থাকলেই কারো মানবাধিকার লঙ্ঘন জায়েজ হয়ে যায় কি-না। প্রথমত, জামায়াত-শিবির কোনো নিষিদ্ধ সংগঠন নয়। এদেশের নাগরিক হিসেবে তারা বৈধভাবে রাজনীতি করছে। দ্বিতীয়ত, দেশের কোনো আইনে এটা বলা নেই যে শিবির হলেই কাউকে গ্রেপ্তার করা যাবে। অথচ গত পনেরো বছর ধরে আমরা দেখেছি, পুরো রাষ্ট্রযন্ত্রকে জামায়াত-শিবিরের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দেয়া হয়েছে। সেইসাথে জামায়াত-শিবিরকে ডিহিউম্যানাইজ বা বিমানবিকীকরণ করার প্রকল্পে একদল মার্সেনারি মিডিয়াকে নিপীড়ক রাষ্ট্রযন্ত্রের সহযোগী হিসেবে প্রচারযন্ত্রের ভূমিকা পালন করতে দেখা গেছে। প্রোপাগান্ডা চালিয়ে গণসম্মতি উৎপাদনের কাজটা তারা নিরবচ্ছিন্নভাবে করে গেছে। 

এই বিমানবিকীকরণের (Dehumanization) প্রক্রিয়ার উদ্দেশ্য আমাদের বুঝা জরুরি। বিশেষ করে প্রতিপক্ষের অধিকার হরণের ক্ষেত্রে বিমানবিকীকরণই কর্তৃত্ববাদের সহজ অবলম্বন। মার্কিন সমাজবিজ্ঞানী ড. জর্জ ইয়ানচে তার Dehumanizing Christians: Cultural Competition in a Multicultural World বইয়ে লিখেছেন, ‘ÔDehumanization indicates that the reason why the authoritarian power is being abused is not only for the sake of authoritarian control but to control the out-group members particular individuals have dehumanized. Once a group is dehumanized, it becomes easy to use authoritarian power to take away the rights of members in that group. (Page: 36). (অর্থাৎ, বিমানবিকীকরণ এটা ইঙ্গিত করে যে, কর্তৃত্ববাদী শক্তির অপব্যবহারের পেছনে শুধু কর্তৃত্ববাদী নিয়ন্ত্রণের স্বার্থই কাজ করে তা নয়, বরং বিমানবিকীকরণের শিকার গোষ্ঠীকে নিয়ন্ত্রণ করার উদ্দেশ্যও কাজ করে। কোনো গোষ্ঠীকে বিমানবিকীকরণ করার পর সেই গোষ্ঠীর সদস্যদের অধিকার কেড়ে নেয়ার ক্ষেত্রে কর্তৃত্ববাদী শক্তি ব্যবহার করা সহজ হয়।) 

সুতরাং, বিরোধী পক্ষকে দমিয়ে রাখতে এবং কর্তৃত্ববাদী ক্ষমতা নিরঙ্কুশ রাখার স্বার্থে জামায়াত-শিবিরকে বিমানবিকীকরণ করার প্রক্রিয়ায় আমরা রাষ্ট্রযন্ত্র ও মার্সেনারি মিডিয়ার যৌথ নির্লজ্জ তৎপরতা দেখেছি। এখন আমরা বুঝতে চাইব যে, বিমানবিকীকরণ বলতে ঠিক কী বুঝায়। নিউ ইংল্যান্ড বিশ^বিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের প্রফেসর ড. ডেভিড লিভিংস্টোন স্মিথ অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস থেকে প্রকাশিত তার On Inhumanity: Dehumanization and How to Resist It বইয়ে লিখেছেন, ‘To dehumanize others is to think of them not merely as inferior human beings, but as subhuman creatures.’ (Page: 22)  (অর্থাৎ, অপরপক্ষকে ডিহিউম্যানাইজ করার মানে তাদেরকে শুধু নিকৃষ্ট মানুষ হিসেবেই নয়, বরং অর্ধ-মানুষ প্রজাতির হিসেবেও তাদেরকে দেখা।) 

এক কথায়, বিমানবিকীকরণ তখনই ঘটে, যখন নির্দিষ্ট কিছু মানুষের মানবাধিকার অস্বীকার বা হরণ করা হয় এবং তাদের নাগরিক সুযোগ-সুবিধা, ভিন্নমত চর্চা, কর্মকা- ও কর্তাসত্তাও প্রত্যাখ্যান করা হয়। সমাজের কোনো পক্ষ বা গোষ্ঠীকে ‘অপর’ করে রাখাই হলো ডিহিউম্যানাইজেশন। জামায়াত-শিবিরের ক্ষেত্রে এই রাজনৈতিক বিমানবিকীকরণ ঘটিয়েছে ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র ও তার সহযোগী মার্সেনারি মিডিয়া। আমরা দেখেছি গত পনেরোটি বছর ধরে জামায়াত-শিবিরের প্রতি কী অমানবিক বর্বর আচরণ করা হয়েছেÑ যেন তারা মানুষ না! এ বছরের মার্চে প্রকাশিত মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্টের বার্ষিক মানবাধিকার প্রতিবেদনেও তাদের ওপর রাষ্ট্রীয় দমন-পীড়নের বিষয়টি উঠে আসে। 

২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে প্রকাশিত আমেরিকার ওরিগন বিশ^বিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা ও যোগাযোগ বিভাগের এক গবেষণায় বিমানবিকীকরণের চারটি তত্ত্ব বা পদ্ধতির কথা উল্লেখ করা হয়। সেসবের আলোকে জামায়াত-শিবিরের ওপর হওয়া রাজনৈতিক বিমানবিকীকরণের অবস্থা পর্যালোচনা করা দরকার মনে করি। প্রথমটি হলো, পরোক্ষ বিমানবিকীকরণ (infrahumanization theory)- এই তত্ত্বের মানে অপরপক্ষের অপমানবোধ তথা সেকেন্ডারি অনুভূতিগুলোকে অগ্রাহ্য বা অস্বীকার করা। জামায়াতের মুখপত্র দৈনিক সংগ্রামের সম্পাদক আবুল আসাদকে কিভাবে তার অফিস থেকে টেনেহিঁচড়ে হেনস্তা করে পুলিশের হাতে তুলে দেয়া হয়েছিল সেই দৃশ্য অনেকেরই মনে থাকার কথা। প্রকাশ্যে এমন শারীরিক হেনস্তার ফলে তার মতো একজন প্রবীণ লেখক ও সম্পাদকের মধ্যে যে মানসিক ট্রমা তৈরি হতে পারে তার কোনো তোয়াক্কা করা হয়নি। এ ছাড়া, যখন শিবিরের নেতাকর্মীদের রাজবন্দী হিসেবে আদালতে আনা-নেয়ার সময় জনসমক্ষে দড়ি ও ডা-াবেড়ি পরিয়ে কিংবা হেলমেট ও বুলেটপ্রুফ জ্যাকেট পরিয়ে ভয়ঙ্কর ‘সন্ত্রাসী’ হিসেবে হাজির করা হয়; আবার কখনো গ্রেপ্তারের পর সাধারণ ইসলামী বইপত্রকে ‘জিহাদী বই’ বলে মিডিয়ার সামনে তাদের ‘জঙ্গী’ হিসেবে অপবাদ দেয়া হয়, তখন তাদের মধ্যে যে অপমানবোধ ও ক্ষোভ তৈরি হয়, সেটা অগ্রাহ্য করার মাধ্যমে রাষ্ট্র তাদের এক ধরনের বিমানবিকীকরণ ঘটায়। মিথ্যা অপবাদ দিয়ে চরিত্র হনন ও মানবিক মর্যাদা ধূলিসাৎ করার প্রচেষ্টাও এই প্রক্রিয়ার অন্তর্ভুক্ত। 

দ্বিতীয়টি হলো, দ্বি-মাত্রিক মনুষ্যতা (dual perspective of humanness)- এটির প্রথম ধাপে বুঝায়, কিছু মানুষকে যখন মানুষ হিসেবে গণ্য করা হয় না, তখন তাদের কোনো পরিশুদ্ধতা, আত্মনিয়ন্ত্রণ, বুদ্ধিবৃত্তি ও যুক্তিবোধ আছে বলে মনে করা হয় না। এ ক্ষেত্রে তাদের প্রতি বিভিন্ন ঘৃণামূলক ও অপমানসূচক ট্যাগ দেয়া হয়। জামায়াত-শিবিরকে সবসময় ‘রাজাকার’, ‘মৌলবাদী’, ‘স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি’ ইত্যাদি ট্যাগ দিয়ে কোণঠাসা করার চেষ্টা করা হয়েছে। তাদেরও যে পাল্টা বক্তব্য বা যুক্তি থাকতে পারে, কিংবা তাদেরও যে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ থাকা উচিত, সেটি স্বীকার করা হয় না। এই তত্ত্বের দ্বিতীয় ধাপে বুঝায়, মানুষের মনুষ্যপ্রকৃতি (human nature) যখন অস্বীকার করা হয়, তখন তাদেরকে অধিকারহীন নি¤œবর্গীয় দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখা হয়। কোনো বিচার-বিবেচনা ছাড়াই জামায়াত-শিবিরের নেতাকর্মীদের যখন-তখন গ্রেপ্তার, গুম-খুন ও জেল-জুলুমে বিপর্যস্ত করা হয়েছে। তাদের কোনো ছিঁটেফোঁটা মানবাধিকারও রক্ষা করা হয়নি। লক্ষ্মীপুরে জেলা জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমীর ডাক্তার

ফয়েজ আহমদকে তার বাড়ির ছাদে নিয়ে গুলী করে ছাদ থেকে নিচে ফেলে নৃশংসভাবে হত্যা করেছিল র‌্যাব সদস্যরা (১৪ ডিসেম্বর ২০১৩, প্রথম আলো)। এত পৈশাচিকভাবে কোনো পশুকেও হত্যা করা হয় কিনা জানা নেই। তৃতীয় তত্ত্বটি হলো, উপলব্ধিগত বিমানবিকীকরণ (dehumanized perception)-অর্থাৎ, ভিন্ন মতাবলম্বীর মন-মানসিকতা বুঝতে না চাওয়া। স্বাধীন বাংলাদেশ নিয়ে বর্তমান জামায়াতে ইসলামীর দৃষ্টিভঙ্গি ও অবস্থানকে আমলে নেয়া হয় না। শিবিরের বর্তমান তরুণ প্রজন্মের রাজনৈতিক চেতনা বাংলাদেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের পক্ষে কি-না সেই বিষয়টি গোনায় ধরা হয় না। তাদের বর্তমান ভাবনা ও মন-মানসিকতা উপেক্ষা করার মাধ্যমেও তাদের প্রতি এক ধরনের বিমানবিকীকরণমূলক আচরণ প্রকাশ পায়। চতুর্থ তত্ত্ব Mind perception framework-এর আলোকে আমরা এটা বুঝতে পারি যে, জামায়াত-শিবিরেরও যে নিজস্ব রাজনৈতিক-বুদ্ধিবৃত্তিক এজেন্সি ও অভিজ্ঞতা থাকতে পারে তা অস্বীকার করা। মানুষ হিসেবে তাদের চিন্তা ও অভিজ্ঞতায় যে স্বাতন্ত্র্য আছে তা প্রত্যাখ্যান করার মাধ্যমেও তাদের বিমানবিকীকরণ ঘটে। 

ড. ডেভিড লিভিংস্টোন তার উক্ত বইয়ে বিমানবিকীকরণের পেছনে রাজনৈতিক শক্তির ভূমিকা ও মনস্তাত্ত্বিক প্রক্রিয়াকে চিহ্নিত করেছেন। ফলে বিমানবিকীকরণ মোকাবেলায় পাল্টা রাজনৈতিক তৎপরতা ও মনস্তাত্ত্বিক সচেতনতার ওপর জোর দিয়ে তিনি বলেছেন, ‘You cannot combat the spread of dehumanizing beliefs without taking political action. At the very least you have to combat it in small ways in daily life, calling it out where you see it, objecting when people you speak to or people who represent you employ its dangerous rhetoric, and, crucially, opposing it in the voting booth’ (Page: 185).  (অর্থাৎ, রাজনৈতিক তৎপরতা ছাড়া আপনি বিমানবিকীকরণের প্রসার ঠেকাতে পারবেন না। অন্ততপক্ষে আপনাকে দৈনন্দিন জীবনের ছোট ছোট পরিসরে এর মোকাবেলা করতে হবে। যেখানে এটির উপস্থিতি পান সেখানেই সমালোচনায় উচ্চকণ্ঠ হোন; যারা জনপ্রতিনিধিত্ব করে, তারা যদি বিমানবিকীকরণের পক্ষে বিপজ্জনক বক্তব্য দেয়, তখন প্রতিবাদ করুন এবং ভোটকেন্দ্রে এর জবাব দিন।)

 

দেশের অবস্থা এখন এমন যে, ভোটকেন্দ্রে জবাব দেয়ার পথও এখন রুদ্ধ। রাষ্ট্রীয় প্রণোদনায় এই বিমানবিকীকরণ এমন পর্যায়ে গেছে যে, হিন্দু হওয়া সত্ত্বেও নিরীহ পথচারী দর্জি বিশ^জিতকে জামায়াত-শিবিরের কর্মী সন্দেহে রাস্তায় দিনের আলোয় কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছিল। বুয়েটের মেধাবী ছাত্র আবরারকে শিবির সন্দেহে পিটিয়ে নৃশংসভাবে খুন করা হয়। গত পনেরোটি বছর যেকোনো বিরোধী আন্দোলন ও বিরোধী মতকে জামায়াত-শিবির ট্যাগ দিয়ে দমিয়ে রাখার চেষ্টা করা হয়েছিল। সদ্যবিগত মার্কিন ওয়্যার অন টেররের নীতির সুযোগে ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র ও ইসলামবিদ্বেষী মার্সেনারি মিডিয়ার যৌথ প্রযোজনায় জামায়াত-শিবিরকে বিমানবিকীকরণ করার প্রকল্প এতদিন বিনা বাধায় চলতে পেরেছিল। এখন বাইডেনের নতুন মার্কিন পলিসিতে মানবাধিকার ও গণতন্ত্র স্থান পাওয়ায় আগের মতো নিছক সন্ত্রাসবাদের জিগির তুলে ইসলামপন্থীদের দমন করে ফ্যাসিবাদী এজেন্ডা বাস্তবায়ন করার সুযোগ সঙ্কীর্ণ হয়ে পড়েছে। যাই হোক, জামায়াত-শিবিরের রাজনৈতিক অধিকার হরণ শুধু সংবিধানবিরোধীই নয়, আন্তর্জাতিক আইনেরও বিরোধী। তাদের সাথে যেকারো মতপার্থক্য থাকতে পারে; কিন্তু তাদের রাজনৈতিক অধিকার চর্চাকে দমন বা অস্বীকার করার সুযোগ নেই। তাদেরকে নির্মূল করার বাসনার মধ্যেই ফ্যাসিবাদের বীজ নিহিত। সেই বাসনা চরিতার্থ করার মধ্য দিয়েই আজকের এই ফ্যাসিবাদ ফ্রাঙ্কেনস্টাইনের দানবে রূপ নিতে পেরেছে। 

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ