ধাওয়া
মাহিন মুবাশশির : একটা ছেলে দৌড়াচ্ছে। তাকে ধরার জন্য কিছু লোক তার পিছন পিছন দৌড়াচ্ছে। ধর.... ধর.... বলতে বলতে উৎসুক জনতাও তার পিছু দৌড়াতে শুরু করলো। ওদিকে ছেলেটা দৌড়াতে দৌড়াতে হাফিয়ে উঠেছে। ছেলেটির বয়স আর কত হবে ? বিশ কি বাইশ। কালো চেহারা। মলিন পোশাক-পরিচ্ছদ।
Ñকি হলো! ঐ ছেলেটা এভাবে দৌড়াচ্ছে কেন? অবাক কা-! এতোগুলো লোক ওকে ধরার জন্যে মরিয়া হয়ে উঠেছে। ব্যাপারখানা কি?
অলী বাজারে যাচ্ছিলো। পথিমধ্যে এ দৃশ্য দেখে তার মনে চিন্তার উদ্রেক হলো। সে কৌতূহলী হয়ে জনতার পিছন পিছন দৌড়াতে লাগলো।
দৌড়াতে দৌড়াতে জনতা ছেলেটাকে ধরে ফেললো। তাদের মধ্য থেকে কেউ একজন বললো :
Ñএবার! এবার কোথায় যাবি? এক্কেবারে হাতে-নাতে ধরেছি।
অন্য একজন বললো :
Ñচোরের দশদিন তো গৃহস্থের একদিন। এবার পালাবি কোথায়?
ভিড়ের মধ্য থেকে মোটা-সোটা একজন মারতে উদ্যত হলো। অন্যরা বললো :
ÑমারÑমার!
Ñদে ঘুষি। বলেই একজন বেজোরে ঘুষি মারলো।
এরপর কিছুক্ষণ সপাৎ সপাৎ কিল-ঘুষির শব্দ ছাড়া আর কোনো শব্দ শোনা গেলো না। একপর্যায়ে চোরের নাক-মুখ ফেটে ফিনকি দিয়ে রক্ত পড়তে থাকলো। চোর যন্ত্রণায় কাতরাতে কাতরাতে অনুনয় বিনয় করতে লাগলো :
Ñও মারে, ও বাবারে! গেলাম রে! মরলাম রে! আমারে ছাইর্যা দেও! আর মাইরো না। আমার জানডা ভিক্ষা দেও। এই আমি কান ধরছি। নাকে খত্ দিচ্ছি। আমি আর কোনো দিন চুরি করমু না। আমি ভালো হয়ে যামু। এবারের মতো মাফ করে দেও আমারে। ওরে বাবারে! মারে ! মরছি রে !
আল্লাহ আমারে মাফ কইর্যা দিও।
মোটা লোকাটি বললো :
Ñধরা পড়লে সব চোরই এমন কয়।
উত্তেজিত জনতা বলে উঠলো :
Ñদে ঘুষি! মার আরো মার! একবারে জানে খতম কইর্যা দে।
জনতা আবার মারতে শুরু করলো। যেন মারতে তারা এক ধরনের পৈশাচিক আনন্দ পাচ্ছে।
অলী দূরে দাঁড়িয়ে সবকিছু দেখছিলো। চোরের বেদনাতুর কাকুতি শুনে তার কোমল হৃদয়ে কেমন যেন মোচড় দিয়ে উঠলো। বুকের মাঝে একটা চিনচিনে বেদনা অনুভব করতে লাগলো সে। চোরের জন্য তার মায়া হলো। তাই দেরী না করে সে ভিড় ঠেলে লোকদেরকে থামাতে চেষ্টা করলো। সবাইকে অনুরোধ করে বললো :
Ñদয়া করে আপনারা থামুন! ওকে আর মারবেন না। এবার ওকে ছেড়ে দিন । এভাবে মারতে থাকলে ও এখানেই মরে যাবে। এতে একটা পুলিশি ঝামেলা হবে। পরিণামে সবার ক্ষতি ছাড়া ভালো হবে না।
প্লিজ! আপনারা থামুন।
জনতা অলীর অনুরোধ মাখানো অথচ যুক্তিপূর্ণ কথাগুলোর মর্ম বোঝার চেষ্টা করলো। কথার সত্যতা উপলব্ধি করে চোরকে ছেড়ে দিলো।
চোর ছাড়া পেয়ে খোঁড়াতে খোঁড়াতে কিছু দূর গিয়ে একটু থামলো। তারপর এদিক-ওদিক তাকিয়ে দিলো ভৌঁ-দৌড়। চোরের দৌড় দেখে কেউ কেউ উচ্চস্বরে হেসে উঠলো ঠিক, কিন্তু কেউ তাকে ধাওয়া করলো না। এরপর একে একে সবাই যার যার কর্মস্থলে চলে গেলো।
অলী বাড়ি এসে গোসল সারলো। তারপর নামাজ পড়ে দুপুরের খাবার খেয়ে প্রতিদিনের অভ্যাসমতো বিছানায় গেলো। উদ্দেশ্য, একটু ঘুমিয়ে নেবে। কিন্তু অন্যান্য দিনের মতো আজ তার চোখে ঘুম এলো না। বারবার চোর মারার দৃশ্যটি তার চোখের সামনে ভাসতে লাগলো। কোনোভাবেই দৃশ্যটি সে ভুলতে পারছে না। কি জানি কেন তার ভাবনার জগৎ জুড়ে কেবল চোর মারার দৃশ্যটি ভেসে উঠছে বারবার। সে ভাবছে: মানুষের মতো চোখ, নাক, মুখ, চেহারা, হাত-পা হওয়া সত্ত্বেও ওর নাম চোর। রক্তে-মাংসে একজন মানুষ হওয়া সত্ত্বেও ও ঘৃণার পাত্র। হায়রে মানুষ! কি হয় চুরি করে? শক্ত সামর্থ্যবান যুবক হয়েও কাজ না করে চুরি? হায়রে মানুষের রুচি......! ভাবতে ভাবতে অলী ঘুমিয়ে গেলো। ঘুমের ভিতর আঁচ করলো কেউ একজন তাকে ডাকছে। চোখ কচলিয়ে সে দেখলো সেই চোরটা তার শিয়রের পাশে দাঁড়িয়ে তাকে অবিরাম ডেকে চলেছে। অলী তার চোখে চোখ রাখতেই সে বললো:
Ñআসসালামু আলাইকুম অলী ভাইয়া! কেমন আছেন? ওঠেন।
Ñকে কে তুমি! এখানে এলে কিভাবে? অলী আশ্চর্য হয়ে জিজ্ঞেস করলো।
লোকটি বললো :
Ñআপনাকে ধন্যবাদ দিতে এলাম। আপনি না থাকলে আমাকে ওরা মেরেই ফেলতো। আল্লাহ আপনার মঙ্গল করুন।
Ñঠিক আছে, ঠিক আছে। আর বলতে হবে না। কিন্তু তুমি আমার একটা কথার জবাব দেবে?
Ñকি কথা?
Ñতুমি চুরি করো কেন?
Ñলজ্জা দিলেন অলী ভাই। আসলে আগে আমি চোর ছিলাম না।
Ñতাহলে?
Ñআমি ছোট বেলায় শান্ত ও ভদ্র ছিলাম। তখন আমি পড়ালেখায়ও ভালো ছিলাম। ফলে আমার বাবা-মা আমাকে খুব ভালোবাসতেন। যখন যা চাইতাম তাই দিতেন। অথচ এরপর কিভাবে কি হয়ে গেলো....
কথা বলতে সে যেন মাঝপথে এসে পাথর হয়ে গেলো। থেমে গেলো তার মুখের কথা। অলী কৌতূহল নিয়ে জিজ্ঞেস করলো:
Ñকি ব্যাপার কি হলো এরপর? থেমে গেলে কেন? বলো কিভাবে কি হলো।
সে আবার বলতে থাকলো :
Ñএর কিছুদিন পর আমার বাবা এক রাজনৈতিক নেতার হাতে খুন হলেন। আমি এ ব্যাপারটি কিছুতেই মেনে নিতে পারলাম না। প্রতিশোধের নেশা আমাকে মাতাল করে দিলো। তাই আমি প্রতিশোধের নেবার জন্য যোগ দিলাম সে রাজনৈতিক দলে। ফলে দিন দিন আমি তাদের বিশ্বাস অর্জন করার জন্য তাদের ভালো-মন্দ সব নির্দেশ আঞ্জাম দিতে থাকলাম। এভাবে নিজের অজান্তেই আমি তাদের হাতের পুতুলে পরিণত হলাম। তাদের সাথে মদ-জুয়া, গাঁজা, হিরোইন, আফিম ইত্যাদি নেশায় আসক্ত হয়ে পড়লাম। সেই সাথে ভুলে গেলাম আমার বাবার প্রতিশোধ নেবার কথা। এরকম চলতে থাকলো কয়েকটি বছর। হঠাৎ একদিন পার্টির অনান্য লোকদের সাথে জমি ভাগা-ভাগি নিয়ে লাগলো বিরোধ। আমি দল ছেড়ে দিলাম। কিন্তু ঐ যে নেশা। যে নেশার বীজ আমার মাঝে প্রথিত হয়েছিলো দলে থাকতে। তার জোগান দিতেই এক সময় চুরির পথ বেছে নিলাম।
কথাগুলো শুনে অলীর শরীর কেমন শীতল হয়ে এলো। মুখ ফসকে বেরিয়ে এলো:
Ñএসব কি বলছো তুমি?
Ñহ্যাঁ, সত্যি বলছি। জানো অলী ভাই, আমার মাঝে মাঝে মনে হয় আত্মহত্যা করি। এ অভিশাপ থেকে নিজেকে মুক্তি দেই.........
Ñনা-না, এসব কি বলছো তুমি। জানো না আত্মহত্যা মহাপাপ।
Ñজানিতো। তারপরও..........
Ñথাম, শোনো আমার কথা। মানুষ ভুল করে, আবার সে মানুষই একদিন তার ভুল শুধরে নেয়। তুমিও নিজেকে শুধরে নাও।
Ñআমার মনের কথাটাই কইছেন। আমি ভালো হবো। আবার আগের মতো স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসবো। আমাকে সাহায্য করবেন অলী ভাই! বলেন করবেন..., বলেন....?
ঘুমের ঘোরে হঠাৎ মায়ের ডাক শুনতে পাচ্ছে অলী। সে ডাক ক্ষীণ থেকে ক্রমে জোরে হচ্ছে। হ্যাঁ, মা তাকে ডাকছেন :
Ñ অলী, এই অলী, ওঠ বাবা! আর কত ঘুমাবি। আসরের আজান হয়েছে। অযু কর। নামাজ পড়তে যা। ওঠ, ওঠ, ওঠ!
নামাজ পড়ে অলী অন্য কোথাও না গিয়ে সোজা বাড়ির পিছন দিকে হাঁটা দিলো। হাঁটতে হাঁটতে আনমনে বিলের ধারে বসে পড়লো। একাকী বিলপাড়ে বসে নানা-রকম ভাবনায় নিজেকে হারিয়ে ফেললো। ভাবতে ভাবতে এক সময় হতাশ হয়ে সে নিজের বিবেকের কাছে প্রশ্ন করলো: ‘আর কত মেধাবী ছেলেরা নোংরা রাজনীতির শিকার হয়ে অকালে ঝরে পড়বে? কত আর নষ্ট হয়ে যাবে হাজার হাজার জীবন!’ কিন্তু বিবেক তার এ প্রশ্নের উত্তর দিতে পারলো না।