শনিবার ০৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪
Online Edition

ইবনে খালদুন জগতসেরা ঐতিহাসিক ও সমাজবিজ্ঞানী

ইবনে খালদুনের নাম তোমরা অনেকেই হয়তো শুনছ। তাঁর সম্পর্কে আমাদের অনেক কিছুই অজানা। তিনি একজন ঐতিহাসিক ও সমাজবিজ্ঞানী। না অতটুকু বললেই কম বলা হবে। তাকে এখনও পৃথিবীর সেরা ঐতিহাসিক বলা হয়। ইবনে খালদুনের ছিল অসাধারণ প্রতিভা। শুধু ইতিহাসেই তার শ্রেষ্ঠত্ব ছিল না। তিনি একজন নামকরা চিকিৎসাবিজ্ঞানীও ছিলেন। তাছাড়া দর্শন, শিল্প-সাহিত্য ও সমাজবিজ্ঞানেও তার অসামান্য অবদান ছিল।
ইবনে খালদুনের জন্ম আফ্রিকার তিউনিসিয়ায়। ১৩৩২ সালের ২৭ মে ইবনে খালদুন এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার পুরো নাম আবু জায়েদ ওয়ালীউদ্দিন ইবনে মুহাম্মদ ইবনে খালদুন। পিতার নাম মুহাম্মদ ইবনে খালদুন। খালদুন তার বংশীয় উপাধী। খালদুনের পূর্ব পুরুষরা ইয়েমেনে বসবাস করতেন বলে জানা যায়। পরে তারা তিউনিসিয়ায় এসে বসতি স্থাপন করেন। ইবনে খালদুনের পিতামহ তিউনিসিয়ার সুলতানের মন্ত্রী ছিলেন। ফলে তাদের পরিবার ছিল উচ্চ বংশীয় এবং শিক্ষিত। বাল্যকাল থেকে শিক্ষার প্রতি ইবনে খালদুনের প্রচ- অনুরাগ ছিল। তার স্মরণশক্তি ও মেধা ছিল প্রখর। দর্শন, রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজবিজ্ঞান, ইতিহাস প্রভৃতি বিষয়ের প্রতিও খালদুনের প্রবল ঝোঁক ছিল। যে কোন বিষয়ের উপর বই হাতের কাছে পেলে তিনি তা পড়ে ফেলতেন। ফলে অতি সহজেই তিনি শিক্ষার নানা শাখায় উন্নতি লাভ করতে সক্ষম হন। মাত্র ১৫ বছর বয়সে খালদুন পবিত্র কুরআনের তাফসির শিক্ষা শেষ করেন। আর মাত্র ১৮ বছর বয়সে তিনি সকল শিক্ষা সমাপ্ত করতে সক্ষম হন। ইবনে খালদুনের জীবন ছিল নানা ঘাত-প্রতিঘাতে ভরা। দুঃখ- বেদনা ছিল তার চিরসঙ্গী। তিনি অত্যন্ত সৎ, আপোসহীন ও ন্যায়নিষ্ঠ মানুষ ছিলেন। তাই অসততা ও অন্যায়ের সাথে তাকে যুদ্ধ করতে হয়েছে। এ জন্য অনেকের ঈর্ষা ও শত্রুতার শিকার হয়েছেন তিনি। তাকে দেশ থেকে দেশান্তরে ঘুরে বেড়াতে হয়েছে। জালেম শাসকরা ইবনে খালদুনকে মোটেও সহ্য করতে পারতো না। অসত্যের কাছে মাথা নত না করায় তাকে কারাগারে যেতে হয়েছে।
শুরুতেই ইবনে খালদুনের জীবনে ঘটে যায় এক মর্মান্তি দুর্ঘটনা। সেটি ১৩৪৯ সালের কথা। ইবনে খালদুনের বয়স মাত্র ১৭ বছর। এ সময় তিউনিসে দেখা দেয় মরণঘাতী প্লেগ রোগ। এ রোগ মহামারী আকারে তিউনিসিয়ার চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে। এ সময় ইবনে খালদুন তার পিতামাতা, শিক্ষক, আত্মীয়স্বজন ও বন্ধুবান্ধবদের অনেকে মারা যান। সবাইকে হারিয়ে ইবনে খালদুন হতাশা ও বেদনায় দিশেহারা হয়ে পড়েন। তার জীবন হয়ে ওঠে দুর্বিসহ। তখন অভাব-অনটন এসেও তাকে তাড়া করে।
ফলে ইবনে খালদুন জীবিকার তাগিদে কাজের পেছনে ছুটতে বাধ্য হন। ১৩৫২ সালের দিকে তিনি প্রথম চাকরি লাভ করেন। এ সময় তিনি তিউনিসিয়ার সুলতানের ব্যক্তিগত সহকারীর চাকরির পদ গ্রহণ করেন।
১৩৫৪ সালে তিনি বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। তখন তার বয়স ছিল মাত্র ২২ বছর। আপনজন হারানোর দুঃসহ বেদনা আর সংসারের টানাপোড়েন সত্ত্বেও ইবনে খালদুন দমে যাননি। বরং তিনি গভীর আগ্রহ নিয়ে জ্ঞান সাধনায় এগিয়ে যান। ধীরে ধীরে ইবনে খালদুনের সুনাম দেশময় ছড়িয়ে পড়ে। মেধা, প্রতিভা ও অসাধারণ বুদ্ধিমত্তার কারণে তিনি সবার শ্রদ্ধার পাত্রে পরিণত হন। এ সময় ইবনে খালদুন অকস্মাৎ রাজনীতির সাথে জড়িয়ে পড়েন। তিনি তিউনিস থেকে আন্দালুসিয়ার সরকারী দায়িত্বপ্রাপ্ত হন। গ্রানাডার সুলতান তাকে কেষ্টিল রাজ্যের রাষ্ট্রদূত নিয়োগ দান করেন। ১৩৬৬ সালে তিনি আবার তিউনিসে ফিরে যান। সুলতান আবু আব্দুল্লাহ তাকে বর্গী নামক রাজ্যের মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব প্রদান করেন। সে সময় এসব রাজ্যের রাজনৈতিক অস্থিরতা ও নানা ষড়যন্ত্রের কারণে তিনি বেশ অসুবিধার মধ্যে পড়েন। তিনি বন্দী হন। বর্গী রাজ্যের সুলতান তার ভাই আবুল আব্বাসের হাতে নিহত হলে খালদুন আরও অসুবিধার মধ্যে পড়েন। আব্বাস রাজ্যটি দখল করে নেয়। এ সময় ইবনে খালদুনের বিরুদ্ধে গ্রেফতারের নির্দেশ জারি হয়। তাই প্রাণভয়ে তিনি পালিয়ে মরক্কোতে গিয়ে আশ্রয় নেন। সেখানে গিয়েও রেহাই পাননি তিনি। সুলতান আব্দুল আজিজ ইবনে আল হাসান ইবনে খালদুনকে বন্দি করেন। পরে অবশ্য খালদুনের জ্ঞান প্রতিভায় মুগ্ধ হয়ে সুলতান তাকে মুক্তি দেন। এদিকে অল্প কিছুদিনের মধ্যেই আন্দালুসিয়ার কাছে মরক্কোর পতন হয়। ইবনে খালদুন আবার গ্রেফতার হন। ১৩৭৪ সালে তিনি মুক্তি পান।
তারপর ইবনে খালদুন উত্তর আফ্রিকার বানু আরিফ প্রদেশে চলে যান। সেখানে ইবনে সালামার নির্জন দুর্গে বসে গভীর জ্ঞান সাধনায় মনোনিবেশ করেন। আমীর মুহাম্মদ ইবনে আরিফ তাকে নিরাপত্তা ও সহযোগিতা প্রদান করেন। ১৩৭৪ থেকে ১৩৭৮ পর্যন্ত চার বছর গভীর সাধনা করে সমাজবিজ্ঞানের ধারণা উদ্ভাবন করেন। এ জন্য ইবনে খালদুনকে সমাজবিজ্ঞানের জনক বলা হয়।
ইবনে খালদুন তারপর আবার তিউনিসে ফিরে আসেন। এখানে জাইতুন বিশ্ববিদ্যালয়ে বসে তিনি বিশ্বখ্যাত কিতাব ‘ধাল মুকাদ্দিমা’ রচনা করেন। এটি বিশ্ব ইতিহাসের উপর বিস্ময়কর গ্রন্থ। মুকাদ্দিমার হস্তলিখিত পান্ডুলিপি লেনিনগ্রাড, বৃটিশ মিউজিয়াম, মিলান, মিউনিখ, ভিয়েনা, আল আজহার, অক্সফোর্ড, তিউনিস ও আলজিয়ার্সে সংরক্ষিত আছে। ইবনে খালদুনের আরেকটি সেরা ইতিহাস গ্রন্থ হচ্ছে কিবাত ‘ধাল ইবর’। এটি বিশ্বের সর্বপ্রথম ও সর্ববৃহৎ গ্রন্থ। ইবনে খালদুনের আরেকটি গ্রন্থের নাম ‘ধাত তারিক’। এটি তার আত্মজীবনমূলক গ্রন্থ। উল্লেখ্য, ১৩৮২ সালে ইবনে খালদুন তিউনিস থেকে মিসরে চলে যান। সেখানে আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা শুরু করেন। মিসরের বাদশাহ এক সময় তাকে বিচারপতির দায়িত্বও দিয়েছিলেন বলে জানা যায়। মিসরে তিনি ২৪ বছর কাটান।
ইবনে খালদুন তার শেষ জীবন মিসরে কাটিয়েছিলেন। তার দেশ তিউনিসিয়া তাকে মর্যাদা দিতে পারেনি। ১৪০৬ সালে এই মহা মনীষী পৃথিবী ছেড়ে চলে যান। তিনি মুসলিম ইতিহাসে যে অবদান রেখে গেছেন আজও তা শ্রদ্ধার সাথে পঠিত ও আলোচিত হচ্ছে। ইবনে খালদুনের চিন্তাধারা ও জ্ঞান সাধনাকে মুসলিম বিশ্ব কাজে লাগাতে পারেনি। তবে অমুসলিমরা ঠিকই তাকে চিনতে পেরেছে। ইবনে খালদুনের মহান আবিষ্কারকে তারা অভিনব ও অসাধারণ বলে মনে করে। আধুনিককালের সমাজ ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা ইবনে খালদুন সম্পর্কে যে উচ্চ ধারণা পোষণ করে তা সত্যিই বিস্ময়কর। প্রখ্যাত রাষ্ট্রবিজ্ঞানী মেকিয়াভেলী, ভিকো, গীবন, এ্যাডাম স্মিথ, অগাস্ট কোঁতে, ক্লাসিও প্রমুখ খালদুনের চিন্তা ও চেতনায় গভীরভাবে প্রভাবিত হয়েছেন। তারা তাকে বিশ্বের সেরা চিন্তানায়ক বলে মন্তব্য করেছেন। তাদের ভাষায়, ‘ইবনে খালদুন হচ্ছেন মধ্যযুগের সেরা চিন্তানায়ক।’

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ