রবিবার ১৯ মে ২০২৪
Online Edition

এ কান্না বাবুল আক্তার কিংবা তার সন্তানের নয় সমগ্র মানবতার কান্না

আ.ফ.ম. মশিউর রহমান : গত ৫ জুন সকালের যে খবরটি সমগ্র জাতিকে বেদনাহত, স্তব্ধ ও বাকরুদ্ধ করেছে সেটি একজন নিষ্ঠাবান পুলিশ অফিসারের স্ত্রীর নৃশংস মৃত্যু। যেটিকে শুধু মৃত্যু বলাই যথার্থ নয় বরং একটি পরিকল্পিত, কাপুরোষিত ও বর্বরোচিত হত্যাকাণ্ড। কী অপরাধ ছিল এই নিরীহ নিষ্পাপ নারীর যার কারণে তাকে এই পরিণতির স্বীকার হতে হলো? উত্তর একটিই হতে পারে, আর তা হলো তার দায়িত্ববান ও নিষ্ঠাপরায়ণ স্বামীর সততা, অন্যায়ের বিরুদ্ধে আপসহীন লড়াই ও ন্যায় প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম যা অগণিত কুচক্রী, সন্ত্রাসী ও স্বার্থান্বেষী মানুষের অন্যায় আবদারে বাধ সেঁধেছে। আর সে কারণেই স্ত্রীকে হত্যা করে বাবুল আক্তারের উপর প্রতিশোধ, কিন্তু এ প্রতিশোধ শুধু তার বিরুদ্ধে নয়, বরং তার সমগ্র পরিবার, স্বজন, এমনকি সমগ্র মানবতার বিরুদ্ধে। এ রকম বর্বরতা মধ্যযুগ নয়, জাহেলী যুগকেও হার মানায়।
এ পৈশাচিকতার সংস্কৃতি নতুন নয়। বাংলাদেশের সৃষ্টি লগ্নেই বুদ্ধিজীবী হত্যার মাধ্যমে দেশের সৎ, সাহসী ও নিষ্ঠাবান মানুষদের হত্যার গোড়াপত্তন হয়েছিল, যা স্বাধীনতা পরবর্তী সময়েও কানো শাসকই শূন্যের কোটায় আনতে পারেননি। কিন্তু সমসাময়িক ঘটনাগুলোর দিকে নজর দিলে নিঃসন্দেহে বলা যায়, সর্বকালের সব ইতিহাস ব্রেক হতে চলছে। এই পাগলা ঘোড়ার লাগাম টেনে ধরা তো দূরে থাক, লাগামেরই যে হদিস পাওয়া যাচ্ছে না।
সবথেকে উদ্বেগজনক ঘটনা হচ্ছে, সম্প্রতি সময়ের হত্যাকাণ্ড গুলোর ধরণ প্রায় সবই একই, কিন্তু কোনোটিরই বিচার তো পরের কথা সত্যিকারের মোটিভই সুস্পষ্ট নয়। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক অধ্যাপক রেজাউল করিম স্যারের মতো অত্যন্ত নিরীহ, বিবাদহীন মানুষটিকেও ঠিক মাহমুদা খানমের মত সাতসকালে বাসার সন্নিকটেই হত্যা করা হয়েছিল। আরেকটু পেছনে ফিরলে দেখা যাবে আরো বেশ ক’জন শিক্ষক, সাংবাদিক, ব্লগার, ব্যাবসায়ী, বিভিন্ন ধর্মাবলম্বী মানুষের একই পরিণতি, এমনকি গত বছর নভেম্বরে আশুলিয়াতেও একইভাবে হত্যা করা হয়েছিল একজন দায়িত্বরত পুলিশ অফিসারকে। এর বাইরেও তো আছে তনু হত্যার মতো আরো কত ধরনের পৈশাচিকতা। যা কোনো ধর্ম তো দূরে থাক, বিবেক সম্পন্ন কোনো মানুষের দ্বারাই ঘটানো কিংবা সমর্থন দেয়া পুরোপুরিই অসম্ভব।
তবে, মাহমুদা খানমের ঘটনাটি সকল পূর্বোক্ত ঘটনা থেকে বেশী গুরুত্ব রাখে এই অর্থে যে, পুর্বোক্ত ব্যক্তিদের থেকে এখানে একটি আলাদা নিরাপত্তা বলয় ছিল একজন ঊর্ধ্বতন পুলিশ অফিসারের সহধর্মিণী হিসেবে। কিন্তু সে রকম পরিবেশের মধ্যেও যখন দুর্বৃত্তরা এই দুঃসাহস দেখাতে সক্ষম হয়েছে তাতেই প্রমাণ পাওয়া যায় যে তাদের অবস্হান কতটা শক্তিশালী। এখানে আরো একটি সমীকরণের ব্যাপার হলো, নিয়মিতই একজন পুলিশ সদস্য তাঁর সন্তানকে স্কুলে নিয়ে যেতেন কি আজ ঐ সদস্যের এবং স্বামীর অনুপস্থিতিতে তিনিই নিয়ে যেতে বের হন, আর সেখানেই বেদনাদায়ক ঘটনাটি ঘটে। প্রশ্ন হলো তিনি যে আজকে বের হবেন হয় এটি হত্যাকারীরা জানত অথবা তাঁর পেছনে দুর্বৃত্তরা দীর্ঘদিন যাবত সুযোগ সন্ধানে লেগেছিল, যার দ্বারাও তাদের নেটওয়ার্কের শক্তি পরিমাপ করা যায়। আরেকটি দুঃখজনক সত্য হচ্ছে, এই পরিবার নাকি দীর্ঘদিন যাবতই ক্ষতির আশংকায় ভুগছিলেন যেটি সম্পর্কে মাহমুদা খাতুনের প্রতিবেশীর বক্তব্য থেকে জানা যায় এবং তাঁরা নাকি বাসা চেঞ্জ করারও চিন্তা করেছিলেন। নিরাপত্তায় নিয়োজিত একজন ঊর্ধ্বতন অফিসারের পরিবারের ক্ষেত্রেই যদি এরকম হয় তাহলে সাধারণ মানুষের অসহায়ত্ব কতটা তা খুব সহজেই আচ করা যায়।
গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হচ্ছে, যেখানে কোনো বিবেকবান মানুষই এমন জঘন্য কাজ করতে পারেন না সেখানে এই বিবেকহীন পাষণ্ড মানুষগুলোর আবির্ভাব কোত্থেকে ঘটলো? এরা নিশ্চয়ই ভিনগ্রহবাসী নয়, এই দেশ, সমাজ ও কারো না কারো পরিবারেরই অংশ। যারা সবার অলক্ষ্যে সব কুকর্ম দিনের পর দিন করে যাচ্ছে। এদেরকে আরো বাড়তে দিলে ক্রমান্বয়ে এই ভূমি মানুষের বসবাস থেকে দিনে দিনে পশুদের চারণক্ষেত্রে পরিণত হবে। যাদের কালো থাবা থেকে আপনি, আমি কেউই নিরাপদ নই।
সুতরাং সময় এসেছে, দল মত নির্বিশেষে কোনো ঘটনা ঘটার সাথে সাথেই একপক্ষ আরেক পক্ষকে কোনো প্রমাণ ছাড়াই দোষারোপ না করে, দোষীদেরকে দলমতের বাহিরে দোষী হিসেবেই বিবেচিত করে খুঁজে বের করা ও যথাযত শাস্তির আওতায় নিয়ে আসা এবং সে ক্ষেত্রে নির্দোষ কেউ যাতে কোনো ভাবেই ভুক্তভোগী না হয় সেদিকে দৃষ্টি রাখা। সেক্ষেত্রে  আইন শৃংখলা বাহিনীর সজাগ, কৌশলী ও নিরপেক্ষ দৃষ্টি যে রকম প্রসারিত হওয়া জরুরী, ঠিক একইভাবে সর্বস্তরের জনগণকেও আশে পাশের অপরাধীদেও বিষয় সঠিক তথ্য দিয়ে আইনশৃংখলা বাহিনীকে সহযোগিতা প্রদান, কোনোক্রমেই অপরাধীকে আশ্রয় প্রদান না করা এবং কোনো কারণেই যাতে নিজের পরিবারের কেউ অপরাধ কার্যক্রমে জড়িয়ে না যায় সেদিকে সজাগ দৃষ্টি রাখা জরুরী।
হয়তোবা সবার প্রচেষ্টায় অপরাধীরা ধরা পড়বে, সমাজে পরিবর্তন আসবে। কিন্তু বাবুল আক্তার কি তাঁর স্ত্রীকে এবং সন্তান কি তার মাকে খুঁজে পাবে? শুধু তাই নয়, আজ মাহমুদা খানমেরর শিশু সন্তানের জুতোয় যে মায়ের রক্তের দাগ লেগে আছে তা কি কোনো ভাবেই মুছে ফেলা যাবে? এ ট্র্যাজেডি আর্নেস্ট হেমিংওয়ের ছয় শব্দের উপন্যাস ”For sale: baby shoes, never worn” এর আবেদনকেও হার মানিয়েছে। আজ তনুর বাবা মা কি তাদের সন্তানকে ফিরে পাবে? রয়েছে এ রকম হাজারো প্রশ্ন। তবুও আমরা নিরাশ হতে চাই না, আমরা চাই সমাজের পরিবর্তন। যে পরিবর্তন হবে মূল্যবোধের ও দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তনের মাধ্যমে। আসুন সবাই মিলে কাজ বিহীন বুলি না আওড়িয়ে সমাজের পজিটিভ পরিবর্তনের অংশ হই। দেশ, জাতি ও সর্বোপরি মানবতার স্বার্থে নিজের সর্বোচ্চটুকু বিলিয়ে দিতে প্রস্তুতি গ্রহণ করি।
লেখক: কবি ও সাংবাদিক
(এমফিল গবেষণারত)
ই-মেইল: [email protected]

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ