মঙ্গলবার ১৪ মে ২০২৪
Online Edition

খুলনায় সংক্রামক ব্যাধি হাসপাতালে টিটেনাস ভ্যাকসিন সরবরাহ নেই

খুলনা অফিস : খুলনা সংক্রামক ব্যাধি হাসপাতালে গত পাঁচ বছরে টিটেনাসে আক্রান্ত হয়ে ১০৩ জন মারা গেছে। এর মধ্যে ২৫ জনই রয়েছে শিশু। এই হাসপাতাল থেকে ৫ বছরে চিকিৎসা সেবা গ্রহণ করে ৩৮ জন শিশুসহ ৩৬১ জন। এছাড়া ওই সময়ের মধ্যে জলবসন্তে ৯ জন এবং ডায়রিয়ায় ৩ জন মারা গেছে। হাসপাতালে টিটেনাস ভ্যাকসিন সরবরাহ না থাকার কারণে চিকিৎসা ব্যয় নিয়ে হিমশিম খান নিম্নবিত্তরা। পাশাপাশি জনবল সঙ্কটের কারণেও এ হাসপাতালে সুষ্ঠু চিকিৎসা সেবা বিঘিœত হচ্ছে।
সংক্রামক ব্যাধি হাসপাতালের সাব অ্যাসিসট্যান্ট কমিউনিটি মেডিকেল অফিসার (এসএসিএমও) ডাঃ নাসরিন সুলতানা জানান, টিটেনাস আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসা ব্যয়বহুল। রোগীদের জন্মের পর টিটেনাসের টিকা না দেওয়া থাকলে আক্রান্ত হওয়ার পর প্রথমেই ১২টি ইনজেকশন দেয়া প্রয়োজন হয়। প্রতিটি ইনজেকশনে ব্যয় করতে হয় ১০৫০ টাকা। এর সাথে ঘুমের ওষুধ ও কিছু এন্টিবায়টিকও রাখতে হয়। এ ব্যয় মেটানো একজন দরিদ্র পরিবারের পক্ষে অসম্ভব হয়ে ওঠে। আমাদের এখানে স্যালাইনটি সাপ্লাই রয়েছে। ‘টিটেনাস ও জলাতঙ্কের বিশেষ ইনজেকশন আমাদের হাসপাতালে নেই। কিন্তু স্যালাইনসহ অন্যান্য ওষুধ আছে। তিনি আরও বলেন, মায়েদের গর্ভাবস্থায় ওই সব টিকা নেওয়া প্রয়োজন। এছাড়া জন্মের পর শিশুকে সব টিকা দেওয়া হলে এ রোগ এড়ানো সম্ভব বলে তিনি উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, বর্তমানে হাসপাতালে জনবল সংকট রয়েছে।
বাগেরহাট জেলার রামপাল উপজেলার শরপপুর গ্রামের বৃদ্ধ সৈয়দ হাসমত আলী গত বৃহস্পতিবার গ্রামের রান্নাঘর সংস্কার করার সময় পায়ে লোহার পেরেক ঢোকে। ওই সময় স্থানীয় চিকিৎসক দিয়ে পায়ে ব্যান্ডেজ করা ও তাকে ওষুধ খাওয়ানো হয়। রাতে তার খিঁচুনি ওঠে ও মুখের চোয়াল আটকে যায়। দেরি না করে ওই রাতে তাকে খুলনা সংক্রামক হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। চিকিৎসকরা জানান, তার টিটেনাস বা ধনুষ্টংকার হয়েছে। প্রথমদিনে তাকে ১২টি ভ্যাকসিন দেওয়া হয়। সাথে আছে নানা ধরণের ওষুধ। সব মিলিয়ে প্রথম দিনে চিকিৎসা খরচ লাগে ১৫ থেকে ১৮ হাজার টাকার মতো।
বৃদ্ধ আলতাফ হোসেন (৬৩) রূপসা এলাইপুর এলাকার বাসিন্দা। গত শনিবার বাড়িতে কাঠ চলা করতে গেলে তার পায়ে লোহার আঘাত লেগে রক্ত বের হয়। স্থানীয় হাতুড়ে ডাক্তারের কাছ থেকে প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়া হয়। কিন্তু তার দুই গাল আটকে যায়। পাশাপাশি শরীরে খিঁচুনি ওঠে। ওই দিন তাকে দ্রুত খুলনা সংক্রামক হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। তারও প্রথমদিনে চিকিৎসায় ২০ হাজার টাকার ওপরে খরচ হয়। ওই সব রোগীর পরিবারগুলো চিকিৎসার ব্যয় মেটাতে হিমশিম খাচ্ছেন। ওই রোগের ভ্যাকসিন সরকারিভাবে বরাদ্দ করার দাবি জানিয়েছেন ভুক্তভোগী পরিবারগুলো।
সূত্র জানায়, দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১ জেলায় মানুষের ডায়রিয়া, টিটেনাস, নিওমেটাল টিটেনাস, জলবসন্ত, হাম, জলাতঙ্কসহ সংক্রামক রোগের চিকিৎসার জন্য ১৯৬৮ সালে খুলনার মীরেরডাঙ্গায় ভৈরব নদের পাশে হাসপাতালটি নির্মাণ করা হয়। ৪ একর জমির ওপর গড়ে ওঠা হাসপাতালটি ২০ শয্যা নিয়ে যাত্রা শুরু করে। আজ পর্যন্ত বাড়েনি হাসপাতালের বেড সংখ্যা। বদলায়নি হাসপাতালের চিত্র।
জানা গেছে, হাসপাতালে ২১টি পদের মধ্যে এখন কাজ করছে ১২ জন। ৩ জন মেডিকেল অফিসারের বিপরীতে একজন দিয়েই চলছে হাসপাতালটি। সহকারী সেবিকার চারটি পদ থাকলেও দীর্ঘদিন ধরে শূন্য। আর দুইজন বাবুর্চীর বিপরীতে একজন ও তিনজন পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা কর্মীর স্থলে কাজ করছে মাত্র একজন। এছাড়া গার্ড ও নৈশ প্রহরী না থাকার কারণে অরক্ষিত থাকে হাসপাতালটি। দিনের বেলায় গোচারণ ভূমি আর রাতে মাদকবসেবীদের অভয়রণ্যে পরিণত হয়।
হাসপাতালে সূত্রে জানা যায়, গত ৫ বছরে ডায়রিয়া, টিটেনাস, নিওমেটাল টিটেনাস, জলবসন্ত, হাম ও জলাতঙ্ক রোগী নিয়ে ১৩ হাজার ৩২৪ জনকে চিকিৎসা সেবা প্রদান করা হয়েছে। এর মধ্যে গত ৫ বছরে নিওমেটাল টিটেনাস (শিশু) টিটেনাস (বয়স্ক) বা ধনুষ্টংকার আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন ১০৩ জন। এর মধ্যে শিশু রয়েছে ২৫ জন।
সূত্র আরও জানায়, ২০১২ সালে ডায়রিয়া, টিটেনাস, নিওমেটাল টিটেনাস ও জলবসন্ত আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ছিল ২ হাজার ৪৪ জন। এর মধ্যে টিটেনাসে ৬ শিশুসহ ২২ জন ও জলবসন্তে ২ জন মারা যায়। ২০১৩ সালে ২ হাজার ৫৯৬ জন আক্রান্তের মধ্যে টিটেনাসে ৪ শিশুসহ ১৬ জন ও জলবসন্তে ১ জন মারা যায়। ২০১৪ সালে আক্রান্ত ৩ হাজার ১৯০ জনের মধ্যে টিটেনাসে ৬ শিশুসহ ২৪ জন ও জলবসন্তে ২ জন মারা যায়। ২০১৫ সালে ৪১১৩ রোগীর মধ্যে টিটেনাসে ৫ শিশুসহ ২৬ জন, জলবসন্তে ২ জন ও ডায়রিয়ায় ১ জন মারা যায়। ২০১৬ সালে আক্রান্ত ৪২৯৯ জনের মধ্যে ডায়রিয়ায় ২ জন, টিটেনাসে ৪ শিশুসহ ১৫ জন ও জলবসন্তে ২ জন মারা যায়। চলতি বছরের প্রথম ৫ দিনে টিটেনাস ও ডায়রিয়া আক্রান্ত ছিল ৬ জন। এর মধ্যে ২ জন বৃদ্ধা টিটেনাস আক্রান্ত রয়েছেন।
চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, টিটেনাস বা ধনুষ্টংকার রোগ একটি ঘাতক ব্যাধি। এ রোগে আক্রান্ত অধিকাংশই রোগীই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। এ রোগে রোগীর মুখম-ল, ঘাড় ও পিঠের মাংসপেশী শক্ত হয়ে যায়। ফলে রোগী মুখ খুলতে পারে না এবং ঘাড় নাড়াতে পারে না। পিঠ বাঁকা হয়ে ধনুকের মতো হয়। মারাত্মকভাবে আক্রান্ত রোগীদের খিঁচুনিও হতে পারে। আক্রান্ত রোগীদের হাসপাতালে ভর্তি করে এমন স্থানে রাখতে হবে যেখানে আলো ও শব্দ কম থাকে।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ