রবিবার ১৯ মে ২০২৪
Online Edition

লোকরঞ্জনবাদের বড় বিপদ সামনে

যুক্তরাষ্ট্রের ৪৫তম প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করলেন ধনকুবের ডোনাল্ড ট্রাম্প। ২০ জানুয়ারি মার্কিন স্থানীয় সময় ঠিক দুপুর ১২টায় দেশটির প্রধান বিচারপতি জন রবার্টস তাঁকে শপথ পাঠ করান। শপথ নেয়ার পর উদ্বোধনী ভাষণে তিনি মার্কিন জনগণের মধ্যে নতুন উদ্দীপনা ছড়িয়ে দেয়ার চেষ্টা করেন। তাঁর সমর্থকরা উল্লাস প্রকাশ করেন। তবে যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন জায়গায় ট্রাম্পের বিপক্ষে বিক্ষোভ হয়েছে, হয়েছে সংঘর্ষও। তাঁর বক্তব্যে এমন কিছু বিষয়ের উল্লেখ হয়েছে, যাতে রয়েছে আশংকার উপাদান। সামনের দিনগুলোতে ট্রাম্পের বক্তব্যের তাৎপর্য আরো স্পষ্ট হয়ে উঠবে। আপাতত অপেক্ষা করাই ভালো। ট্রাম্পের আগে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলেন ওবামা। যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ প্রেসিডেন্ট হিসেবে বারাক ওবামা ইতিহাস গড়ে এসেছিলেন। তবে তাঁর বিদায়টা যেন করুণ রসে সিক্ত। চোখের জলে তাঁকে বিদায় জানালেন সহকর্মীরা। আসা এবং যাওয়ার নিয়মটা পালন করতে হলো বারাক ওবামাকেও।
এতদিন জীবনের সোনালী সময়টা ওবামা কাটিয়েছেন প্রিয় ওয়াশিংটন ডিসির ক্যাপিটল হিল হোয়াইট হাউসে। এ হাউস এখন আর তাঁর নয়। আসলে জীবনে কোন কিছুই যেন স্থায়ী হয় না। এই অধ্যায়টা শেষ করে তাঁকে যেতেই হচ্ছে। বৃহস্পতিবার শেষ কর্মদিবসে প্রিয় প্রেসিডেন্টকে জড়িয়ে ধরেন তাঁর প্রশাসন কর্মীরা। অনেকেরই চোখ ভিজে যায় অশ্রুতে। এর আগে শেষবারের মতো সংবাদ সম্মেলন করে সাংবাদিকদের বিদায় জানান বারাক ওবামা। দীর্ঘ এক ঘণ্টার বক্তব্যে তিনি উল্লেখ করেন গণতন্ত্র রক্ষায় সংবাদ মাধ্যমের অপরিহার্য ভূমিকার কথা। পরে উপস্থিত সাংবাদিকদের সাথে একে একে হাত মিলান, দেখান বিজয় চিহ্নও। সংবাদ সম্মেলনে বিদায়ী মার্কিন প্রেসিডেন্ট বলেন, রুশ পরমাণু অস্ত্রের মজুদ কমাতে কাজ করা উচিত ডোনাল্ড ট্রাম্পের। তিনি আরো বলেন, ইসরাইল-ফিলিস্তিন নিয়ে দু’টি আলাদা রাষ্ট্রের সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর সময় বয়ে যাচ্ছে। দ্রুতই কোন সিদ্ধান্তে পৌঁছানো না গেলে তা দুই দেশ, তাদের জনগণ, এমন কি যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তার ওপরও হুমকি হতে পারে।
বিদায় বেলায় আপন অভিজ্ঞতা থেকে কিছু গুরুত্বপূর্ণ কথা বলে গেছেন যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা। নতুন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ওই বিষয়গুলোকে কতটা গুরুত্ব দেবেন তা কিছুদিনের মধ্যেই স্পষ্ট হয়ে উঠবে। তবে প্রসঙ্গত এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, নতুন শতাব্দীর শুরুতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যে নতুন বিশ্ব গড়ার স্বপ্ন দেখিয়েছিল তা পূরণ হয়নি। বরং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ত্রুটিপূর্ণ নীতির কারণে বিশ্বে সংকটের মাত্রা আরো বেড়ে গেছে। কোন কোন ক্ষেত্রে ওবামা কিছুটা ইতিবাচক বক্তব্য প্রদান করলেও তা তেমন ফলপ্রসূ হয়নি। আর নতুন প্রেসিডেন্ট তাঁর উদ্বোধনী ভাষণে উচ্চকণ্ঠে যেভাবে মার্কিন জাতীয়তাবাদের কথা তুলে ধরলেন, তাতে সামনের দিনগুলো আরো জটিল হয়ে উঠতে পারে। শরণার্থী ও মৌলবাদী ইসলামের ব্যাপারে তাঁর যে দৃষ্টিভঙ্গি তা কোন্ মাত্রায় উপনীত হয় তাও দেখার মতো বিষয় হয়ে উঠবে। এখানে আরো উল্লেখ করতে হয় যে, মার্কিন নেতৃত্বাধীন জোট বিগত সময়ে ইরাক, আফগানিস্তান ও লিবিয়ায় যে সংকট সৃষ্টি করেছে, তা এখন বিশ্ব শান্তির ক্ষেত্রে এক বড় হুমকি হয়ে দেখা দিয়েছে। আর সিরিয়ায় শুধু রাশিয়ার ভূমিকা নয়, যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকাও বিশেষভাবে প্রশ্নবিদ্ধ। সব মিলিয়ে বলতে হয়, সাম্প্রতিককালে বিশ্ব শান্তি এবং মুসলিম স্বার্থের অনুকূলে যৌক্তিক ভূমিকা পালনে যুক্তরাষ্ট্র সমর্থ হয়নি। বরং বলা যেতে পারে, যুক্তরাষ্ট্রের ভুল নীতির কারণে সংকটের মাত্রা আরো বেড়েছে। এমন এক পরিস্থিতিতে যুক্তরাষ্ট্রের নতুন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প যে ভাষায় কথা বলছেন তা বিশ্বের বিবেকবান মানুষকে বেশ শংকিত করে তুলছে। এমন কি এতদিন ধরে যুক্তরাষ্ট্রের ভেতরে নানা ধর্ম, বর্ণ ও ভাষার মানুষের মধ্যে ‘বৈচিত্র্যের ঐক্য’ ভাবধারার যে দর্শনটি প্রবাহমান ছিল তা কতটা অটুট থাকবে, সেই প্রশ্নও ইতিমধ্যে দেখা দিয়েছে। এ বিষয়গুলো ডোনাল্ড ট্রাম্প কতটা উপলব্ধি করেন আগামী দিনগুলোতে তা দেখার মতো বিষয় হয়ে উঠবে।
বিশ্বের রাজনৈতিক অঙ্গনে এখন পপুলিজম বা লোকরঞ্জনবাদ নিয়ে বেশ আলোচনা হচ্ছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হিসেবে ডোনাল্ড ট্রাম্প দায়িত্ব গ্রহণের পর এই আলোচনার মাত্রা আরো বেড়ে গেছে। রোমান ক্যাথলিক খ্রিস্টানদের ধর্মগুরু পোপ ফ্রান্সিস বিশ্বে লোকরঞ্জনবাদ উত্থানের বিষয়ে হুশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন। তিনি বলেছেন, জনসাধারণের আবেগ-অনুভূতি কিংবা ভয়কে পুঁজি করে গড়ে ওঠা সরকার বা রাজনীতি সমর্থনের মধ্যে হিটলারের মতো স্বৈরাচারীর উত্থানের ঝুঁকি থাকে। স্পেনের পত্রিকা এল পাইসকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে পোপ এমন হুশিয়ারি উচ্চারণ করেন। পোপ এমন সময় এ কথা বললেন, যখন পপুলিস্ট নেতা হিসেবে পরিচিত ডোনাল্ড ট্রাম্প মার্কিন প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নিয়েছেন।
প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ গ্রহণের পর ডোনাল্ড ট্রাম্প তার উদ্বোধনী ভাষণে বেশ উচ্চকণ্ঠেই মার্কিন জাতীয়তাবাদের কথা উচ্চাণ করেছেন। তাঁর ওই বক্তব্য উগ্র জাতীয়তাবাদের প্রসার ঘটায় কিনা তেমন আশঙ্কা অনেকেই প্রকাশ করেছিলেন। সেই আশঙ্কাই যেন এখন বাস্তবে পরিণত হতে চলেছে। উল্লেখ্য যে, ট্রাম্পের শপথের পরদিনই জার্মানিতে ইউরোপের কট্টর ডানপন্থী নেতারা বৈঠকে মিলিত হয়েছেন। সেখানে ফ্রান্সের ন্যাশনাল ফ্রন্টের নেতা মারিন লো পেন বলেছেন, পশ্চিমাদের ভবিষ্যৎ নীতি হবে দেশপ্রেম। তিনি আরো বলেছেন- চলতি বছর ফ্রান্স, জার্মানি ও নেদারল্যান্ডসে যে নির্বাচন হবে, সেখানে জনগণ যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের পদাঙ্ক অনুসরণ করবে। এই তিন দেশেই জাতীয়তাবাদীরা ক্ষমতায় আসবে।  লো পেন ২০১৭ সালকে ‘ইউরোপীয়দের জাগরণবর্ষ’ হিসেবে অভিহিত করেন। বৈঠকে নেদারল্যান্ডসের অভিবাসন বিরোধী ফ্রিডম পার্টির প্রধান ও কট্টর মুসলিম বিরোধী হিসেবে পরিচিত নেতা গিয়ার্ট ভিল্ডার্স বলেন, ‘গতকাল নতুন এক আমেরিকা, আজ নতুন এক ইউরোপ ... রাজনৈতিক শুদ্ধাচারের জোয়াল কাঁধ থেকে ছুড়ে ফেলে দিয়ে ইউরোপের মানুষ জেগে উঠেছে’। এমন বক্তব্য থেকে উপলব্ধি করা যায়, ডোনাল্ড ট্রাম্পের উগ্র জাতীয়তাবাদী বক্তব্য পৃথিবীকে কোনদিকে নিয়ে যাচ্ছে।
ট্রাম্পের উদ্বোধনী বক্তব্য ইসরাইলকে আরো বেপরোয়া হতে উৎসাহ যুগিয়েছে। ইসরাইলী কর্মকর্তারা ২২ জানুয়ারি পূর্ব জেরুসালেমে ইহুদি বসতি স্থাপনকারীদের জন্য ৫৬৬টি বাড়ি তৈরির অনুমতি দিয়েছেন। জেরুসালেমের ডেপুটি মেয়র মেইর তুরজেমান এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট হওয়ায় নিয়ম-নীতি বদলে গেছে। বারাক ওবামার আমলের মতো আমাদের হাত বাঁধা নেই। আমরা এখন বসতি নির্মাণ করতে পারছি।’ ফিলিস্তিনী প্রেসিডেন্টের দপ্তর ইসরাইলের এই উদ্যোগের নিন্দা জানিয়ে একে জাতিসংঘ প্রস্তাবের লঙ্ঘন বলে আখ্যা দিয়েছে। বর্তমান বিশ্বব্যবস্থায় যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের পপুলিজমের যে উত্থান লক্ষ্য করা যাচ্ছে, তাতে বিশ্বের সাধারণ মানুষ বিশেষ করে মুসলমানদের আতঙ্কিত হওয়ার যথেষ্ট কারণ আছে। যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপে লোকরঞ্জনবাদের উত্থান বিষয়ে মূল্যায়ন জানতে চাইলে পোপ ফ্রান্সিস বলেন, এটি আতঙ্কের। তার মতে, ১৯৩৩ সালে জার্মানিতে পপুলিজমের উত্থানের বিষয়টি সর্বনাশের এক বড় উদাহরণ। পোপ আরো বলেন, ‘ওই সময় জার্মানি ভেঙ্গ পড়েছিল। তখন মানুষ একজন নেতা খুঁজছিল। অ্যাডলফ হিটলার নামের এক তরুণ তখন বলেছিল- আমি পারবো, আমি পারবো। জার্মানরা সেই হিটলারকে ভোট দিল। সে কিন্তু ক্ষমতা দখল করেনি, জনগণই তাকে ভোট দিয়েছিল এবং সে তার সেই জনগণকেই ধ্বংস করে দেয়।’ পোপ ফ্রান্সিস তো ইতিহাসের সত্যের আলোকে তাঁর উপলব্ধির কথা বর্ণনা করলেন। এখন দেখার বিষয় হলো, যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের রাজনীতিবিদ ও এলিটরা পোপের মূল্যায়নকে কতটা উপলব্ধি করেন এবং সম্মান জানান।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ