বুধবার ০১ মে ২০২৪
Online Edition

নেত্রকোনা ও সুনামগঞ্জের হাওর এলাকার লক্ষাধিক একর জমির ফসল পানির নিচে

দিলওয়ার খান, নেত্রকোনা থেকে : উজান থেকে নেমে আসা ঢলের পানি অব্যাহত থাকায় নেত্রকোনা জেলার খালিয়াজুরী, মোহনগঞ্জ, মদন ও কলমাকান্দা উপজেলার ছোট-বড় প্রায় ৩৩টি হাওরে আগাম বন্যার পানি প্রবেশ করায় ৬৫ হাজার একর জমির ইরি-বোরো ধান তলিয়ে গেছে। হাওরাঞ্চলের কৃষকরা জানান, পাহাড়ী ঢল আর ভারী বৃষ্টিপাতই হচ্ছে হাওরবাসীর কাল। গত ক'দিনের বৃষ্টি আর ভারতের মেঘালয় রাজ্য থেকে নেমে আসা পাহাড়ী ঢলে কীর্তনখোলা, চৌতারা, বৈঠাখালী, সোনাডুবি, হুলদড়িয়া, হাইজদা, ঝালকাটি, বেড়িকালি বাঁধ ভেঙ্গে পাঙ্গাসিয়া হাওর, পাডার হাওর, পায়রাবন্দ, জাঙ্গলিয়া, বিশরপাশা, বেড়িকালী, জগন্নাথপুর, ইছাপুর, চাকুয়া হাওর, তলার হাওর, গণেশের হাওর, শয়তানখালী, সোনাতার, মালাদারিয়া, চাদরা, ডোবাইল, বৈঠাখালী, সোনাডুবি, বড়হাওর, নাগডুবা, রঘুনাথপুর, হরিণধরা, ছত্রমপুর, গুজাকুলিয়া, কালিহালা, কালাইকান্দি, নোয়াগাঁও, উজান গোলীয়াসহ ছোট-বড় ৩৩টি হাওরের বোরো ফসল ঢলের পানিতে তলিয়ে যায়। সারা বছরের হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রমের এবং লালিত স্বপ্নের একমাত্র ফসল কৃষকের চোখের সামনে তলিয়ে যাওয়ায় হাওরাঞ্চলের হাজার হাজার কৃষকের স্বপ্ন ভেঙ্গে চুরমার হয়ে গেছে। তারা এখন নির্বাক। অনেক কৃষকের এখন সম্বল হচ্ছে চোখের পানি ও আর্তনাদ। তাদের আহাজারিতে ও বুকফাঁটা কান্নাতে হাওরের বাতাস ভারী হয়ে উঠছে। হাওর এলাকায় সৃষ্টি হয়েছে এক হৃদয়বিদারক দৃশ্য। হাওরবাসীদের মধ্যে নেমে এসেছে চরম হতাশা ও অমানিশার অন্ধকার। স্ত্রী-পুত্র কন্যাদের নিয়ে তাদের আগামী দিনগুলো কিভাবে কাটবে এ নিয়ে কৃষকের দুঃচিন্তার অন্ত নেই। তাদের ধারণা, হাওর এলাকায় ফসল বিনষ্টের ফলে হাজার হাজার কৃষককে অনাহারে-অর্ধাহারে কাটাতে হবে। দুর্নীতিবাজ প্রকৌশলী ও ঠিকাদারদের অনিয়ম ও দুর্নীতির কারণে ঠিকমতো বাঁধ নির্মাণ ও মেরামত না হওয়ায় প্রতিবছর আগাম বন্যায় হাওরাঞ্চলের ব্যাপক ফসলহানি ঘটে। তারপরও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের টনক নড়ে না। এবার পাহাড়ী ঢলে হাওরাঞ্চলে ব্যাপক ফসলহানি ঘটায় পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তা আর ঠিকাদারদের বিরুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকরা ফুঁসে উঠছে। দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা না নেয়ার ফলে স্থানীয় প্রশাসন, জনপ্রতিনিধি, সংসদ সদস্য ও মন্ত্রীদের প্রতি সাধারণ মানুষের ক্ষোভ দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। এদিকে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকাবাসী আগামী ফসল না উঠা পর্যন্ত সকল প্রকার কৃষি ঋণ ও বিভিন্ন এনজিও'র কিস্তি আদায় বন্ধ রাখার জন্য সরকারের প্রতি জোর দাবি জানিয়েছেন। প্রাথমিক পর্যায়ে খালিয়াজুরী, মদন এবং মোহনগঞ্জ উপজেলায় বন্যায় ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য ২৭ টন চাল এবং ৫০ হাজার টাকা বরাদ্দ দেয়ার পর গত দু'দিন জেলা প্রশাসক মোঃ নূরুল আমিন ক্ষতিগ্রস্ত এলাকাগুলো পরিদর্শন করে পুনরায় খালিয়াজুরী উপজেলার জন্য ১০ মেঃ টন চাল, নগদ ২৫ হাজার টাকা, মদন উপজেলার জন্য ৫ মেঃ টন চাল, নগদ ১০ হাজার টাকা, মোহনগঞ্জ উপজেলার জন্য ৫ মেঃ টন চাল, নগদ ১০ হাজার টাকা অতিরিক্ত বরাদ্দ দিয়েছেন। এ ছাড়াও মাটি ভরাট করে বাঁধ রক্ষার জন্য ৮ হাজার খালি বস্তা খালিয়াজুরিতে পাঠানো হয়েছে। কৃষকের কান্নায় সুনামগঞ্জের বাতাস ভারী মহসিন রেজা মানিক, সুনামগঞ্জ থেকে : একে একে তলিয়ে যাচ্ছে সুনামগঞ্জের সব ফসলি হাওর। একমাত্র ফসলকে হারিয়ে দিশেহারা হয়ে পড়েছে কৃষকরা। হতাশা আর কান্নায় ভারী হয়ে উঠছে হাওরপাড়ের বাতাস। স্বজন হারানোর ব্যথার মতোই নাড়া দিচ্ছে তাদের হৃদয়কে। ছ'মাস যে ফসলকে নাড়িছেড়া ধনের মতো পরিচর্যা করেছে, ঘাম জড়ানো সেই কষ্টের ফসল বৈশাখ আসার আগেই অকাল বন্যায় তলিয়ে গেল। প্রকৃতির কাছে এই পরাজয় কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না। তাই শেষ হয়ে যাওয়ার মধ্যেও যেটুকু অবশিষ্ট রয়েছে তাই রক্ষার জন্য প্রাণপণ লড়ে যাচ্ছে তারা। তবুও যেখানে শেষ রক্ষা হচ্ছে না তখন ধিক্কার জানাচ্ছে হাওর রক্ষার কাজে নিয়োজিত ঠিকাদার ও পানি উন্নয়ন বোর্ড কর্মকর্তাদের। কৃষকদের অভিমত পাউবো'র অনিয়ম আর দুর্নীতির কারণেই অকালে হারাতে হচ্ছে তাদের একমাত্র বোরো ফসল। কোথাও আবার এ ক্ষোভ বিষ্ফোরণোম্মুখ আকার ধারণ করছে। যেখানেই ঠিকাদার আর পাউবো কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দেখা মিলছে সেখানেই তাদের ওপর চড়াও হচ্ছে কৃষক। গতকাল দুপুরে তাহিরপুরের শনির হাওরের পুটিচূড়া বাঁধে কৃষকদের গণধোলাইয়ের শিকার হযেছেন উপজেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি নূরুল আমিন। তিনি ছিলেন এই হাওর রক্ষা কমিটির সেক্রেটারি। কৃষকদের অভিযোগ, ঠিকাদারদের সাথে আঁতাত করে হাওরের বাঁধ নির্মাণে অনিয়ম করেছেন তিনি। বুধবার দুপুরে তিনি যখন গাড়ি করে বাঁধে উপস্থিত হলেন তখন সহস্রাধিক কৃষক বাঁধ রক্ষার চেষ্টায়রত। ক্লান্ত কৃষকদের সকল ক্ষোভ গিয়ে পরে ওই আওয়ামী লীগ নেতার উপর। বাঁধের উপরেই তাকে বিবস্ত্র করে গণধোলাই দেয় কৃষকরা। তবে আওয়ামী লীগ নেতা নূরুল আমিন বলেছেন, এক কোটি টাকা ব্যয়ে শনির হাওরের বাঁধ নির্মাণের জন্য কাজ পেয়েছে ঠিকাদার তছকির মিয়া। তিনি কাজে অনিয়মের কথা উল্লেখ করে বলেন, আঁতাত নয় বরং কৃষকদের প্রতিনিধি হয়ে ঠিকাদারের কাজ তদারকি করার জন্য তাকে হাওর রক্ষা কমিটির সেক্রেটারি করা হয়েছিল। কৃষকদের এই জনরোষের কারণে কোথাও দেখা মিলছে না পাউবো কর্মকর্তা-কর্মচারীদের। তবে পাউবো কর্মকর্তা জানিয়েছেন, অনিয়মের জন্য ঠিকাদারের বিল আটক রাখার জন্য ওপর থেকে নির্দেশ এসেছে। এদিকে গতকাল দুপুরে তলিয়ে গেছে আরও ৩টি হাওর। ধর্মপাশা উপজেলা পইলতার হাওর, লুচরি ডোবা, হাসোয়ার হাওর গতকাল দুপুরে বাঁধ ভেঙ্গে তলিয়ে য়ায়। এ নিয়ে গত কয়েক দিনে জেলার প্রায় ৫৫টি হাওরের বাঁধ ভেঙ্গে তলিয়ে গেছে প্রায় ৬৫ হাজার হেক্টর জমির ফসল। জামালগঞ্জের হালির হাওর, পাকনার হাওর, তাহিরপুরের মাটিয়ান হাওর, শনির হাওরের অবস্থাও অবনতির দিকে। জামালগঞ্জের আব্দুল আহাদ জানিয়েছেন, বাঁধের পাড়ে কোন ঠিকাদার বা পাউবো কর্মকর্তাকে পাওয়া যাচ্ছে না। এলাকায মাইকিং করে কৃষকদের সংগঠিত করে স্বেচ্ছাশ্রমে চলছে বাঁধ নির্মাণের কাজ। তাহিরপুরের মাটিয়ান হাওর পাড়ের কৃষক আলিম উদ্দিন জানায, হাওরের বাঁধ রক্ষার জন্য দিন-রাত কাজ করছে প্রায় দুই হাজার কৃষক। তবে উমেদপুরের কাছে বাঁধের একটি অংশ এখনও ঝুঁকিপূর্ণ। যে কোন সময় সেখানে ফাটল ধরতে পারে। সুনামগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ড কর্মকর্তা আব্দুল হাকিম জানায়, ঠিকাদারদের ফুট পর্যন্ত কাজ করার জন্য সিডিউল দেয়া হয়েছে। কিন্তু সুরমা নদীর পানি বর্তমানে ৬.৮৯ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। বাঁধের কাজ সম্পর্কে তিনি জানান, ৮০ ভাগ কাজ ইতোমধ্যে শেষ হয়েছে, মাত্র তার আগেই জোয়ারের পানি চলে এসেছে। অনিয়মের বিষয়টি তিনি এড়িয়ে গিয়ে বলেন, ঠিাকাদারদের দিয়ে কাজ করানো হয়। আমাদের দায়িত্ব তদারকি করা। তবে বাঁধ নির্মাণের অনিয়মের জন্য সুনামগঞ্জ জেলা প্রশাসক ফয়জুর রহমান ঠিকাদারদের বিল আটক রাখার জন্য নির্দেশ দিয়েছেন বলে জানান তিনি। বাঁধ রক্ষা নিয়ে ২০ গ্রামে উত্তেজনা নিজেদের হাওরের ফসল রক্ষার জন্য পানির চাপ কমাতে অন্য হাওরের বাঁধ কেটে দেয়া হচ্ছে এই গুজবে সুনামগঞ্জের দুটি উপজেলার ২০টি গ্রামের মধ্যে মঙ্গলবার রাতে উত্তেজনা দেখা দেয়। এ ঘটনায় দুই উপজেলার পুলিশ সোমবার রাতভর হাওরের ফসল রক্ষা বাঁধে পাহারা দিয়েছে। গতকাল মঙ্গলবারও সারাদিনও বাঁধে টহল দেয় পুলিশ। পুলিশ জানায়, সুনামগঞ্জের ধরমপাশা উপজেলার গুরমার হাওরের বাঁধ ভেঙ্গে পানি ঢুকতে শুরু করলে হাওরপাড়ের লোকজন এজন্য জামালগঞ্জের হালির হাওরপাড়ের লোকদের সন্দেহ করে। এ নিয়ে এলাকায় গুজব ছড়িয়ে পড়ে হালির হাওরের পানির চাপ কমাতে জামালগঞ্জ উপজেলার আছানপুর, মাহমুদপুর, সুন্দরপুর, হরিণকান্দি গ্রামের লোকজন গুরমার হাওরের বাঁধ ভেঙ্গে দিয়েছে। এতে ধরমপাশা উপজেলা দুগনুই, সাজদাপুর, কামারগাঁও গ্রামের লোকজন প্রতিশোধ নিতে জামালগঞ্জ উপজেলার হালির হাওরের বাঁধ ভেঙ্গে দেয়ার জন্য সশস্ত্র বাঁধে অবস্থান করে। এ খবর শোনে জামালগঞ্জ উপজেলার কয়েকটি গ্রামের লোক নিজেদের ফসল রক্ষার জন্য অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে হালির হাওরের ছুঁইচ্যাখালি, শয়তানখালি, সুন্দরপুর বাঁধে ছুটে আসে। দুই উপজেলার কৃষকদের মধ্যে উত্তেজনার বিষয়টি স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা অবগত হলে সংশ্লিষ্ট এলাকার পুলিশ প্রশাসনকে জরুরি ভিত্তিতে বাঁধে টহল দিতে পাঠিয়ে দেন। পরে ধরমপাশা উপজেলা চেয়ারম্যান আব্দুল আউয়াল জামালগঞ্জের বেহেলী ইউপি চেয়ারম্যান ধর্মরাজ চৌধুরীও ঘটনাস্থলে ছুটে গিয়ে বিষয়টি গুজব বলে লোকদের শান্ত করেন।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ