শনিবার ১১ মে ২০২৪
Online Edition

কুমারখালীর প্রাচীন বিদ্যাপীঠ ইউনাইটেড হাইস্কুল বাঁশগ্রাম শিক্ষার আলো ছড়িয়ে যাচ্ছে

কুমারখালী (কুষ্টিয়া): উপজেলার অন্যতম প্রাচীন বিদ্যাপীঠ বাঁশগ্রাম ইউনাইটেড হাইস্কুল -সংগ্রাম

মাহমুদ শরীফ, কুমারখালী (কুষ্টিয়া): কুমারখালীর দক্ষিণাঞ্চলের অন্যতম প্রাচীন বিদ্যাপীঠ বাঁশগ্রাম ইউনাইটেড হাইস্কুল। প্রতিষ্ঠার পর থেকেই শিক্ষার আলো ছড়িয়ে চলেছে প্রাচীন এই বিদ্যাপীঠটি। জানা যায়, ১৯৪০ সালে প্রমত্তা কালীগঙ্গা নদীবিধৌত বাঁশগ্রামে প্রতিষ্ঠিত হয় “ওল্ড স্কীম জুনিয়ার মাদরাসা’’। ইংরেজি ও অংক সংযুক্ত আরবি ও উর্দু ভাষাভিত্তিক মাদ্রাসার দায়িত্বগ্রহণ করেন মাওলানা হামিদুর রহমান। নয়া উপনিবেশের আবর্তে এই মাদরাসার প্রতি সহানুভূতিশীল ছিলেন মুন্সী বেলায়েত হোসেন, মোজাহার উদ্দিন মোল্লা, আজব আলী বিশ্বাস, আব্দুস সোবাহান মন্ডল, খন্দকার আফছার উদ্দিন, শাহ মহম্মদ মাহতাব উদ্দিন, বেলায়েত মন্ডল, খন্দকার আব্দুল জলিল, আহম্মদ মোল্লা, ময়েজ উদ্দিন মোল্লা, রওশন আলী খান, সোলেমান খান, ইউসুফ আলী বিশ্বাস, আব্দুস সামাদ, আব্দুস ছোবহান বিশ্বাস, নেহেদালী বিশ্বাস, খয়বার হোসেন বিশ্বাস, মোহসিন আলী বিশ্বাস, শেখ জনাব আলী, শেখ ইয়াসিন আলী, মুন্সী ডা. আব্দুল মোতালিব, মুহা: ইসমাইল হোসেন বিশ্বাস, খন্দকার হারুনুর রশীদ, লুতফর রহমান জোয়াদ্দার, মুহা: মঈন উদ্দিন বিশ্বাস, মুহা: আয়েন উদ্দিন বিশ্বাস, মুহ: মোকাদ্দেস হোসেন বিশ্বাস,মহর আলী মন্ডল, আব্দুল জলিল মন্ডল,আব্দুস ছাত্তার (অনাথ), মুহম্মদ ওসমান গনী, আব্দুল গনী,তাইজ উদ্দিন শেখ, আফতাব খান প্রমুখ।
৬০ দশকেই ইংরাজি ভিত্তিক শিক্ষার প্রয়োজনে এতদঞ্চলের ছাত্র-ছাত্রীদের ভীষণ দুর্ভোগ সহ্য করতে হয়েছে। বাঁশগ্রাম হাইস্কুলের প্রধান উদ্যোক্তা মোঃ আব্দুল বারী নিজেও সীমাহীন দুঃখ-কষ্ট সহ্য করে উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা অর্জন করেন। শিক্ষার কারিগর মুহা: মোকাদ্দেশ হোসেন ও চাচা কবি ডাঃ মোতালিবের অনুপ্রেরণায় উদ্বুদ্ধ হয়ে অনাগত প্রজন্মের দোড়গোড়ায় উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা পৌঁছে দিতে তিনি এ অঞ্চলের সকল শে্িরণর জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করেন; তবে এই ঐক্যবদ্ধকরণের কাজটি ছিল জটিল। প্রধান বাধা ছিল গ্রাম্য প্রধানদের মাঝের বিভাজন এবং দ্বিতীয় বাধা ছিল সম্পত্তি প্রদানে মালিকদের অনীহা। এ দুটি জটিল সমস্যার সমাধানের নিয়ামক ছিলেন সাবেক ছাত্রনেতা বারী সাহেবের বিপুল জনপ্রিয়তা ও সাংগঠনিক দক্ষতা। তিনি সমাজ শাসকদের বুঝাতে সক্ষম হয়েছিলেন যে
প্রচলিত মাদরাসা শিক্ষা ব্যবস্থার সাথে বিজ্ঞান ভিত্তিকজ্ঞান সংযুক্ত করতে ব্যর্থ হলে সমাজ আধুনিক প্রযুক্তি থেকে পিছিয়ে পড়বে।
৪০ দশকের মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠার সময় যাঁরা ছিলেন প্রবীণ তাঁরা হাইস্কুল প্রতিষ্ঠার এ পর্যায়ে প্রয়াত এবং মাঝারি বয়সের প্রধানগণ পরিনত বয়সের অধিকারী। তাঁদের সকলের সক্রিয় পৃষ্ঠপোষকতা এবং একদল নিবেদিত যুব সমাজের সহযোগিতায়  ১৯৭০ সালের পহেলা জানুয়ারি থেকে ১৯৭৩ সাল পর্যন্ত অষ্টম শ্রেণি ভিত্তিক এবং ১৯৭৪ সাল থেকে দশম শ্রেণি নিবন্ধন প্রাপ্তির মাধ্যমে পূর্ণোদ্যমে চালু করা হয় ইউনাইটেড হাইস্কুল বাঁশগ্রাম।
বিদ্যালয়ের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান ছিল ভীষণ আনন্দদায়ক। বাঁশের খুটি ছিল ভিত্তি এবং বারী সাহেব যখন তা স্কুলের নির্ধারিত জায়গায় স্থাপন করেন তখন প্রবীষ জনের মধ্যে থেকে আহমদ আলী বিশ্বাস, মুহা: মোকাদ্দেস হোসেন, মুহা: আব্দুল জলিল মন্ডল, শেখ জনাব আলী, মুহা: ইসমাইল হোসেন  প্রমুখ এই প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করেন। নবীণদের মধ্যে ছিলেন আব্দুল মালেক সিদ্দিক, আব্দুল আজিজ, আলাউদ্দিন বিশ্বাস (আলম), নজরুল ইসলাম তফাজ্জল, গোলাম সরোয়ার বিশ্বাস, আশরাফ উদ্দিন লাল, অমুল্য বিশ্বাস, আহাম্মদ আলী, আফিজুল ইসলাম, (চেরাগ আলী), হাতেম আলী মন্ডল, আবু বক্কর পিন্টু, বাবুরালী খাঁন, আমীনুল ইসলাম বাটুল, মুহা: সেলিম, জহির উদ্দিন জোয়ার্দ্দার, মুছাব আলী মন্ডল, সদর উদ্দিন, আশরাফ আলী, আমজাদ আলী, মুহাম্মদ ইছাহক, আব্দুস ছোবহান, মুন্সী আইয়ুব আলী, আবদুল গফুর ম-ল, মকবুল হোসেন জোয়ার্দ্দারসহ আরো অনেকে। বাঁশের খুঁটির উপর টিনের চালা দিয়ে তৈরী ঘরে ক্লাস শুরুর কিছুদিন পরেই  ঝড়ে সম্পূর্ণ অকেজো হয়ে যায় স্কুলের অবকাঠামো। ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের পর্যাপ্ত টিন দিয়ে পুনরায় চালু করা হয় স্কুলের কার্যক্রম। প্রথম পরিচালনা পর্ষদে চেয়ারম্যানের পদ  উল্লেখ না থাকায় কমিটির সেক্রেটারিকে নির্বাহী দায়িত্ব দেয়া হয়।
১৯৭৪ সাল থেকে ১৯৮০ সাল পর্যন্ত আব্দুল ওয়াহেদ মিঞা সাচিবিক দায়িত্ব পালন করেন। প্রথম হেড মাস্টার হিসেবে আবদুল মালেক সিদ্দিক ১৯৭৫ সালের আগস্ট মাস পযন্ত এবং তারপর ৩১/০৩/২০১০ সাল পর্যন্ত এই পদ অলংকৃত করেন শ্রী প্রকাশ চন্দ্র বিশ্বাস। ১৯৮০ সালে স্কুল কমিটিতে চেয়ারম্যানের পদ প্রবর্তিত হলে এডভোকেট বারী সাহেব ১৯৮০ থেকে ১৯৮৫, কুমারখালী থানার সার্কেল অফিসার এবং উপজেলা চেয়ারম্যান আবদুল হান্নান পর্যায় ক্রমে ১৯৮৫ থেকে ১৯৮৭, আবদুল মালেক সিদ্দিক ১৯৮৭ থেকে ১৯৯৫ এবং ১৯৯৫ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত মিসেস শিরিন বারী চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেন। মিসেস বারীর সময়ই এই প্রতিষ্ঠান বড় ধরনের সরকারি অনুদান লাভ করে যদ্দারা পুরানা টিনের ঘর রেখেই কালী নদীর তীর ঘেঁসে দোতালা দালান  তৈরী করা হয়। সাবেক চেয়ারম্যান এডভোকেট বারী সাহেব “মোকাদ্দেশ হোসেন মেমোরিয়াল ও আবুল বাসার মেমোরিয়াল ট্রাস্টের” পক্ষ থেকে পাঁচ লাখ টাকা দিয়ে বিজ্ঞান ভবন নির্মান করেন। এর পর আবদুর রউফ ২০০১ থেকে ২০০৯ সাল ও মিসেস জান্নাতুন নাহার উর্মি ২০০৯ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেন।
ইউনাইটেড হাইস্কুল বাঁশগ্রামেসহ শিক্ষার ব্যবস্থা বিদ্যমান। ফলাফল অতীব সন্তোষজনক বিধায় ঊর্ধতন কর্তৃপক্ষ হাইস্কুলে ম্যাট্রিক পরীক্ষার সেন্টার অনুমোদন করেছেন। বর্তমান  ছাত্রছাত্রী সংখ্যা ৪৮৭ এবং শিক্ষকম-লীসহ সম্মিলিত কর্মচারীর সংখ্যা ১৮ জন। বিদ্যালয়ের সহকারী প্রধানশিক্ষক সালমা খাতুন জানান, গত জেএসসি পরীক্ষায় অত্র বিদ্যালয় থেকে ১১৫ জন ছাত্র-ছাত্রী অংশগ্রহণ করে। এরমধ্যে ২১ জন জিপিএ ৫ পেলেও ১ জন রয়েছে ফেল। বর্তমানে বিদ্যালয়ের ভবন সংখ্যা ৬টি। যার একটি পাকা। রুম সংখ্যা সন্তোষজনক। শিক্ষক-কর্মচারী রয়েছে ১৮ জন। বর্তমানে শিক্ষার্থীর সংখ্যা প্রায় ৭ শত। পাঠাগারে নিজস্ব বইয়ের সংখ্যা ৩ হাজার। সাথে রয়েছে একটি ব্র্যাকের পাঠাগার। সাহিত্য সাংস্কৃতি চর্চা, বিভিন্ন দিবস পালন করা হয়, মাঠের অবস্থা খুবই ছোট, উপকরণের সংকট বিদ্যমান। শিক্ষার্থীদের নির্দিষ্ট পোশাক আবশ্যক।
 বাঁশগ্রাম বাজারের পাশে নদীর পাড়ে অবস্থিত বিদ্যালয়ের জমির পরিমাণ ১ একর ৫২ শতাংশ। বিদ্যুৎ, ল্যাট্রিন, পানি সুবিধা রয়েছে। ৬টি ডেস্কটপ ও ১টি ল্যাপটপ ছাত্র-ছাত্রীদের তথ্য প্রযুক্তি ক্লাসে ব্যবহৃত হয়। রয়েছে  শিক্ষক সংকট। বেঞ্চ ও আসবাবপত্রেরও সংকট বিদ্যমান। শিক্ষা উপকরণ ব্যবহারের ক্ষেত্রে কোন অনিহা নেই। ম্যানেজিং কমিটির সভা নিয়মিত অনুষ্ঠিত হয়। বিদ্যালয়ে নেই কোন নিজস্ব আয়ের উৎস।
বিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষার্থী সরকারের বড় বড় অবস্থানে কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখছে। পুরোনো প্রতিষ্ঠান হলেও আজও কারিগরি শিক্ষা চালু করা সম্ভব হয়নি। শিক্ষকবৃন্দ জানান, বর্তমানে শিক্ষার্থীরা টিনএজ হওয়ায় সমস্যা কিছুটা ঘটেই থাকে। কুমারখালীর দক্ষিণাঞ্চলের প্রাচীন এই বিদ্যাপীঠটি তার ভবিষ্যত অনেক উজ্জ্বল করবে এমনটাই প্রত্যাশা।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ