বুধবার ০১ মে ২০২৪
Online Edition

শেরে বাংলা এ.কে ফজলুল হকের রাজনৈতিক জীবন

জোবায়ের আলী জুয়েল : ২৬ অক্টোবর শেরে বাংলার ১৪৪তম জন্মবার্ষিকী স্মরণে:
পৃথিবীতে এমন কিছু কিছু মানুষ জন্মগ্রহণ করেন, যাঁরা দেহগতভাবে মানুষের চর্মচক্ষু হতে আড়াল হন মাত্র কিন্তু আদর্শগতভাবে মানুষের স্মৃতির সিংহ দ্বারে অক্ষয় আসন দখল করে থাকেন। শেরে বাংলা এ.কে. ফজলুল হক বাঙালির কাছে স্মৃতির অমূল্য সঞ্চয়।
এ.কে ফজলুল হক শেরে বাংলা নামেই বেশি পরিচিত। তিনি তাঁর সুদীর্ঘ জীবনে একজন দক্ষ জননেতা ও রাষ্ট্রপরিচালক হিসেবে সুনাম অর্জন করেন। ব্রিটিশ ভারতে, পাকিস্তান আমলে তাঁর বলিষ্ঠ রাজনীতির মাধ্যমে তিনি বাঙালির অন্যতম জনপ্রিয় নেতা হিসেবে পরিগণিত হন। বাকেরগঞ্জ জেলার দক্ষিণাঞ্চলের বর্ধিষ্ণু গ্রাম সাটুরিয়ায় ১৮৭৩ সালের ২৬ অক্টোবর মামার বাড়িতে তাঁর জন্ম। পূর্ব-পুরুষদের বাড়ি ছিল বরিশালের চাখার গ্রামে। তিনি ছিলেন মুহম্মদ ওয়াজেদ ও সায়িদুন্নিসা খাতুনের একমাত্র পুত্র। আরবি ও ফারসিতে প্রথম পড়াশোনা।
তারপর ১৮৯০ সালে বরিশাল জিলা স্কুল থেকে এন্ট্রান্স, ১৮৯২ সালে প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে এফ.এ এবং ১৮৯৪ সালে বি.এ পরীক্ষায় (রসায়ন, গণিত ও পদার্থ বিদ্যা- তিনটি বিষয়ে অনার্স সহ) পাস করেন।
১৮৯৫ সালে গণিত বিদ্যায় বিশেষ পারদর্শিতার সঙ্গে এম.এ পাস করলেন কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। ১৮৯৭ সালে ঐ একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে হক সাহেব আইন পাস করে উকিল হলেন। প্রথম জীবনে তিনি শিক্ষানবিশরূপে ওকালতী শুরু করেছিলেন “বাংলার বাঘ” স্যার আশুতোষ মুখার্জীর নিকট। ১৯০১ সালে তাঁর পিতা পরলোক গমন করলে হক সাহেব বরিশালে এসে ওকালতী শুরু করলেন। সেই সঙ্গে তিনি বরিশাল রাজেন্দ্র কলেজে অধ্যাপনা করতেন। তিনি বরিশাল থেকে সাপ্তাহিক “বালক” পত্রিকার সম্পাদনাও করতেন।
পূর্ব-বাংলা আর আসামের গভর্নর ছিলেন তখন স্যার ব্যামফিল্ড ফুলার। তিনি হক সাহেব কে রাজনীতির আসর থেকে ডেকে নিয়ে ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেটের চাকরি দিয়েছিলেন। প্রথম জীবনে জিন্নাহ্ ও প্রেসিডেন্সি ম্যাজিস্ট্রেটের চাকরি নিয়েছিলেন বোম্বেতে।
হক সাহেব কিছুদিন ঢাকায় চাকরি করে পরে ময়মনসিংহ জেলার জামালপুর মহকুমার এসডিও নিযুক্ত হয়েছিলেন। তখন জামালপুরের সাব-ডিভিশনাল পুলিশ অফিসার ছিলেন পাকিস্তানের প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট ইস্কান্দার মীর্জার পিতা টুনী মীর্জা। টুনী মীর্জার সঙ্গে ফজলুল হকের খুবই বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ছিলো। নবাব স্যার সলিমুল্লাহ আর স্যার আশুতোষ মুখার্জীর পরামর্শে তিনি শেষ পর্যন্ত সরকারি চাকরিতে ইস্তফা দেন।
তাঁরা দু’জনেই ফজলুল হককে নিজ সন্তানের মতো দেখতেন। ফজলুল হক কংগ্রেসে যোগ দেন ১৯১৪ সালে। তিনি এককভাবে কংগ্রেস, মুসলিম লীগ আর খেলাফত আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন। ফজলুল হকের অগ্নিঝরা বক্তৃতা ভারতের আপামর জনসাধারণের মধ্যে আলোড়ন সৃষ্টি করেছিলো। কৃষকের দুরবস্থা আর তাদের ওপর জমিদারদের উৎপীড়ন দেখে তিনি ১৯১৫ খ্রিষ্টাব্দে কৃষক, শ্রমিক, রায়ত প্রজাদেরকে নিয়ে আন্দোলন শুরু করলেন। গঠন করলেন কৃষক প্রজাদল। এই দল গঠনে তার সহকর্মী ছিলেন বাণীকণ্ঠ সেন, খান বাহাদুর হাসেম আলী খান, আবু হোসেন সরকার, আবুল মনসুর আহমেদ, মওলানা আকরম খাঁ, সৈয়দ বদরুদ্দোজা, অধ্যাপক হুমায়ুন কবীর, খান বাহাদুর ইসমাইল, কবি মোজাম্মল হক, সৈয়দ নওশের আলী, চৌধুরী শামসুদ্দিন, আশরাফ উদ্দিন চৌধুরী, মাওলানা মনিরুজ্জামান, মাওলানা আব্দুল্লাহ-হেল বাকী, যোগেন্দ্র নাথ ম-ল, মাহমুদুন্নবী চৌধুরী প্রমুখ নেতৃবৃন্দ। হক সাহেবের সংগ্রামী নেতৃত্বে বাংলার কৃষককুল উপকৃত হয়েছিলো।
১৯২৪ খ্রিষ্টাব্দে হক সাহেব সর্বপ্রথম বাংলার শিক্ষামন্ত্রি নিযুক্ত হন। ১৯৩৪ সালে বাংলার বিখ্যাত ধনী ও অর্থমন্ত্রি নলিনী রঞ্জন সরকারকে ভোটে পরাজিত করে তিনি কোলকাতায় সর্বপ্রথম মুসলিম মেয়র নির্বাচিত হন। ১৯৩৫ সালে তিনি আইন সভার সদস্য নির্বাচিত হন।
১৯৩৭ সালে হক সাহেব বাংলা প্রদেশে মন্ত্রিসভা গঠন করেন। এই কোয়ালিশন মন্ত্রিসভায় সদস্য ছিলেন নবাব হবিবুল্লাহ, নবাব মোশারফ হোসেন, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, সৈয়দ নৌশের আলী, স্যার বিজয় প্রসাদ সিংহ রায়, মহারাজা শ্রী শচন্দ্র নন্দী, নলিনী রঞ্জন সরকার, প্রসন্নদেব রায়কত, মৌলভী তমিজ উদ্দিন খান ও শামসুদ্দিন আহমেদ। ১৯৩৭ সাল থেকে ১৯৪১ সাল পর্যন্ত হক সাহেব কৃষক প্রজা আর মুসলিম লীগ উভয় দলেরই সভাপতি রূপে নেতৃত্ব দেন।
১৯৪০ সালে বিখ্যাত “লাহোর প্রস্তাবটি” মুসলিম লীগ সম্মেলনে উত্থাপন করেছিলেন শের-ই-বাংলা এ.কে ফজলুল হক। এই লাহোর প্রস্তাবের মূল ভিত্তি ছিলো- ভারতের উত্তর পশ্চিম মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চল নিয়ে গঠিত হবে একটি পৃথক স্বাধীন মুসলিম রাষ্ট্র আর উত্তর ও পূর্বাঞ্চলে সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চল নিয়ে গঠিত হবে আর একটি স্বাধীন মুসলিম রাষ্ট্র। ইসলামের কৃষ্টির দৃষ্টিভঙ্গী নিয়ে রচিত হবে এ দু’টি রাষ্ট্রের শাসনতন্ত্র। এভাবে দু’টি মুসলিম স্বাধীন দেশ সুযোগ-সুবিধা মতো রচনা করবে তাদের শাসন প্রণালী। এই অধিবেশনে সভাপতি ছিলেন কায়েদ-ই-আযম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ। বিপুল হর্ষধ্বনি আর করতালির মাধ্যমে হক সাহেবের এই প্রস্তাবটি পাস হয়। কিন্তু দেশ স্বাধীন হওয়ার পর দেখা গেলো যে, এই লাহোর  প্রস্তাবের ভিত্তিমূলই সরিয়ে ফেলেছেন মুসলিম লীগ নেতারা।
বিশ্ববিখ্যাত বিজ্ঞানী আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায় ১৯৩৮ সালে ফজলুল হক সম্পর্কে ভবিষ্যৎ বাণী করেন- “আমি বলছি বাঙালি জাতির ভবিষ্যতের কথা। সমস্ত রাজনৈতিক সত্যের উপর আরেকটা বড় সত্য আছে। সেটা বাঙালি জাতির অস্তিত্ব। বাঙালি জাতির ভবিষ্যৎ অস্তিত্ব নির্ভর করে হিন্দু মুসলিম ঐক্যের উপর। ফজলুল হক এই ঐক্যের প্রতীক। আমি সংগ্রেসীদের ভারতীয় জাতীয়তা বুঝিনা। আমি বুঝি বাঙালির জাতীয়তা। এ জাতীয়তা প্রতিষ্ঠা করতে পারে একমাত্র ফজলুল হক। ফজলুল হক মাথার চুল থেকে পায়ের নখ পর্যন্ত খাঁটি বাঙালি। সেই সঙ্গে ফজলুল হক মাথার চুল থেকে পায়ের নখ পর্যন্ত খাঁটি মুসলমান।
খাঁটি বাঙালিত্বের সাথে খাঁটি মুসলমানের এমন অপূর্ব সমন্বয় আমি আর দেখি নাই। ফজলুল আমার ছাত্র বলে একথা আমি বলছি না। সত্য বলেই একথা বলছি। খাঁটি বাঙালির ও খাঁটি মুসলমানত্বের সমন্বয়ই ভবিষ্যৎ বাঙালির জাতীয়তা।
ফজলুল হক ঐ সমন্বয়ের প্রতীক। বাঙালি যদি ফজলুল হকের মর্যাদা না দেয়, তবে বাঙালির বরাতে দুঃখ আছে”।
এ.কে ফজলুল হক, কাজী নজরুল ইসলাম ও মুজাফফর আহমদের সঙ্গে “নবযুগ” নামে একটি দৈনিক পত্রিকা প্রকাশ করেন ১৯২০ সালে।
ব্রিটিশ আমলে সরকারবিরোধী নীতির কারণে এ পত্রিকার জামানত বহুবার বাজেয়াপ্ত হয়। ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের ফলে উদ্ভূত পরিস্থিতি লক্ষ্য করে হক সাহেব অত্যন্ত মর্মাহত হন। তিনি স্থায়ীভাবে ঢাকায় বসবাস করতে শুরু করেন। পূর্ব পাকিস্তানের এ্যাডভোকেট জেনারেলের দায়িত্ব পালন করেন ১৯৪৭-১৯৫২ সাল পর্যন্ত। অল্পদিনের মধ্যে তিনি আবার রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন।
১৯৪৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে পূর্ব-পাকিস্তানের ছাত্ররা অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলা ভাষার স্বীকৃতির দাবীতে আন্দোলন শুরু করে। ফজলুল হক তৎকালীন মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে আন্দোলনের একজন বিশিষ্ট নেতারূপে আবির্ভূত হন।
১৯৫৩ সালের ২৭ জুলাই ফজলুল হক “শ্রমিক-কৃষক দল” গঠন করেন। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের হয়ে মওলানা ভাষানী ও সোহ্রাওয়ার্দীর সঙ্গে মিলিত হয়ে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেন।
১৯৫৪ সালের নির্বাচনের পর তিনি পূর্ব বাংলার মুখ্যমন্ত্রী হন। ১৯৫৫ সালের আগস্টে হক সাহেবকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভায় যোগ দেয়ার আমন্ত্রণ জানানো হয়। ১৯৫৬ সালে তিনি পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর হন এবং ১৯৫৮ সালে সে পদ থেকে অপসারিত হন। তারপর থেকেই তিনি রাজনীতি থেকে অবসর নেন।
ফজলুল হক ছিলেন নিবেদিত কর্মবীর। জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত এ দেশে ও দেশবাসীর কল্যাণে কাজে লাগিয়েছেন তিনি। কিন্তু তাঁকে যখন গভর্নরের পদ থেকে সরিয়ে দেয়া হয়, তিনি তখন খুবই ব্যথা পান মনে। রাজনীতির ওপর এক দুর্বার অভিমান আচ্ছন্ন করে তাঁকে। এছাড়া তখন তাঁর বয়সও হয়েছিলো অনেক। এসব কারণে রাজনীতির অঙ্গন থেকে নিজেকে সরিয়ে নেন ফজলুল হক।
১৯৬১ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর ছিলো জনসম্মুখে শেরে বাংলা ফজলুল হকের শেষ অনুষ্ঠান। এ দিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক হলের ছাত্ররা এক অনুষ্ঠান করে সংবর্ধনা দেয় ফজলুল হককে। এ সভায় জ্ঞানগর্ভ একটি ভাষণ দেন ফজলুল হক। এখানে ফজলুল হককে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে সম্মানীয় “ডক্টরেট” ডিগ্রী প্রদান করা হয়। তাছাড়া তাঁকে ফজলুল হক হলের আজীবন সদস্য পদও প্রদান করা হয়।
কিছুদিন পর থেকে ফজলুল হকের স্বাস্থ্য দ্রুত ভেঙে যেতে থাকে। ১৯৬২ সালের ২৭ মার্চ চিকিৎসার জন্য ফজলুল হককে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। একমাস অসুস্থ থাকার পর ১৯৬২ সালের ২৭ এপ্রিল শুক্রবার সকাল ১০টা বেজে ১০ মিনিটে মৃত্যুবরণ করেন তিনি। সেই সাথে শেষ হয়ে যায় বাংলার মানুষের প্রাণপ্রিয় নেতার বিশাল এক কর্মময় জীবন।
ফজলুল হক ছিলেন এদেশের কৃষক-শ্রমিক ও সাধারণ মানুষের প্রিয় নেতা। তিনি নিজেকে নিঃশেষে বিলিয়ে দিয়েছিলেন দেশ ও দেশবাসীর কল্যাণে। তাই এ দেশের বাংলার মানুষ অনন্তকাল ধরে শেরে বাংলা এ.কে ফজলুল হককে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করবে।
লেখক: কলামিস্ট, সাহিত্যিক, গবেষক ও ইতিহাসবিদ

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ