শুক্রবার ০৩ মে ২০২৪
Online Edition

ভারতীয় বেনারসি শাড়ি হাতিয়ে নিচ্ছে হাজার কোটি টাকা

মুহাম্মদ নূরে আলম : ঈদ উপলক্ষে ভারতীয় বেনারসি শাড়ি হাতিয়ে নিচ্ছে হাজার কোটি টাকা। দেশীয় বেনারসি হাউসগুলো হুমকির মুখে পড়ার আশঙ্কা। বেনারসি শিল্পের সাথে জড়িত দোকান মালিক ও বিক্রেতারা জানান ঈদ উপলক্ষে শুধুমাত্র ভারতীয় বেনারসি শাড়ি, লেহেঙ্গা, থ্রিপিস দিয়ে বাংলাদেশ থেকে হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নিবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। আবার অনেক ব্যবসায়ী স্বীকার করেন বেনারসি শাড়ি দেশে হলেও ভারতীয় সিল স্টিকার বেলে দিয়ে বিক্রি হওেচ্ছ। ফলে দেশী বেনারসি শিল্প তার নিজস্ব সুনাম হারাচ্ছে। রাজধানীর মিরপুরের বেনারসি পল্লী। ঈদ সামনে রেখে এখন ব্যস্ত দোকানগুলো। যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে সম্পূর্ণ বাঙালিয়ানায় নিজেকে সাজাতে বাঙালি নারীদের ব্যস্ততা যেমন বেড়েছে, তেমনি ব্যস্ত ঐতিহ্যবাহী নানা ধরনের শাড়ির কারিগররা। রাত-দিন চরকা ঘুরাচ্ছেন সুতার ললি তৈরিতে, ভিমে (শাড়ি  তৈরি ও নকশা তোলার যন্ত্র) একের পর এক শাড়ি ও নকশা বুনে যাচ্ছেন। দোকানিদের অর্ডার শেষ করতে দম ফেলার ফুরসত নেই তাদের।
গতকাল সোমবার মিরপুরের বেনারসি পল্লীর শাড়ির দোকানগুলো ঘুরে ঈদ আয়োজনের এমন ব্যস্ততা দেখা গেল। আর সেই শাড়ি যদি হয় একেবারে নতুন ও ভিন্ন রকমের তাহলে তো কথাই নেই। তেমনই এসেছে নানা আঙ্গিকে সোনালি, মেরুন, মেজেন্টা, সবুজ ও অ্যাশ কম্বিনেশনের বেনারসি স্বর্ণকাতান শাড়ি, অপেরা শাড়ি। পছন্দের জিনিসটি ক্রয় করতে সকাল থেকে রাত পর্যন্ত মার্কেটে ভিড় জমাচ্ছেন বিভিন্ন শ্রেণীপেশার ক্রেতা সাধারণ।
আবার ক্রেতাদের আকৃষ্ট করতে বিপণি বিতানগুলো সাজানো হয়েছে বাহারি সাজে। তবে রোজার প্রথমদিকে আশানুরূপ ক্রেতার দেখা না মিললেও ১৩ রোজার পর বিক্রি বাড়ার প্রত্যাশা বিক্রেতাদের। বাঙালি নারীদের পোশাকে শাড়ি একটি বিশেষ স্থান দখল করে আছে। তাই যত কেনাকাটাই হোক না কেন, অনেক বাঙালি নারী ভাবেন শাড়ি ছাড়া ঈদের কেনাকাটা অপূর্ণই থেকে যায়। তাই ঈদবাজারে শাড়ির দোকানে তরুণীসহ সব বয়সী নারীর বিপুল চাহিদারই প্রতিধ্বনি যেন। সরেজমিন সোমবার রাজধানীর মিরপুর-১০ নম্বরের বেনারসি পল্লী ঘুরে দেখা যায়, বিয়ের শাড়ি কেনার জন্য এখনও বেশিরভাগ মানুষের প্রথম পছন্দ মিরপুরের বেনারসি পল্লী।
তবে ঈদ সামনে রেখে তরুণী থেকে শুরু করে মধ্যবয়সীদের আনাগোনায় জমজমাট বেনারসি পল্লী। সাধ ও সাধ্য মিলিয়ে শাড়ি কিনতে ক্রেতার ভিড়। দেশি তাঁত, জামদানি, টাঙ্গাইল শাড়ির পাশাপাশি সিল্ক, কাতানও বিক্রি হচ্ছে প্রচুর। এছাড়া পছন্দের শাড়ির সঙ্গে মানানসই অলংকার ও আনুষঙ্গিক কেনাকাটার ধুম পড়েছে রাজধানীর বিপণিবিতানগুলোয়। একসঙ্গে অনেক রকম শাড়ি পাওয়া যায়। এখানে বাড়তি দামও রাখে না, আর তেমন ভিড়ভাট্টা নেই। দোকানগুলোর পরিসরও বেশ বড়। এসব কারণেই শাড়ি কিনতে হলে মিরপুরের বেনারসি পল্লী থেকেই কেনাকাটা করি বলছিলেন চিকিৎসক সানজিদা আহমেদ। গতকাল সোমবার তিনি শাশুড়ির জন্য ঈদের শাড়ি কিনলেন মিরপুর ১০ নম্বরের বেনারসি পল্লী বেনারসি কুটি থেকে। তবে বেনারসি কুটির এই শাড়িটি মিরপুরের নয়, ভারতীয়।
খোঁজখবর নিয়ে দেখা গেল, মিরপুর ১০ ও ১১ নম্বরে বেনারসি পল্লী দোকানগুলোতে মিরপুরের কাতান বেনারসির সঙ্গে ভারতের শাড়ি বিক্রি হচ্ছে প্রায় সমানে সমান। পল্লী কর্মচারী সমিতির সদস্য সুলতান মাহমুদের  মতে, দেশি ও ভারতীয় কাপড়ের পরিমাণ প্রায় আধাআধি। ১০ নম্বরে দেড় শতাধিক দোকান নিয়ে বিশাল এলাকাজুড়ে মিরপুর বেনারসির শাড়ির বাজার। প্রতিটি দোকানই বেশ বড়। তবে গতকাল দুপুর পর্যন্ত অধিকাংশ দোকানে বেচাকেনা খুব কমই দেখা গেল।
বিক্রেতারা জানালেন, ১৫ রোজার পর থেকে বিক্রি শুরু হবে বলে তাঁরা আশা করছেন। ‘পরশমণি শাড়ির ব্যবস্থাপক জানালেন, এখানকার শাড়ির বাজার ঈদকেন্দ্রিক নয়, এটি বিয়েকেন্দ্রিক বাজার। নবেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত চার মাস তাঁদের মূল ব্যবসার মৌসুম। এ সময় বিয়েশাদি বেশি হয়। ঈদে এখানে খুচরা বিক্রি খুব বেশি বাড়ে না। তবে ঈদের সময় পাইকারি বিক্রি কিছুটা বাড়ে।
ঈদে লোকে একসঙ্গে অনেক রকম কেনাকাটা করেন। বেনারসি পল্লীতে কেবল এক রকম পণ্যের দোকান। তার ওপর ঈদে সবাই কাতান-বেনারসি কিনতে আগ্রহ দেখান না। সে কারণে অনেকেই এখন থ্রিপিস, মিরপুরের বাইরে দেশের বিভিন্ন এলাকা যেমন পাবনা, টাঙ্গাইল, রূপগঞ্জের সুতি, সিল্ক, জামদানি শাড়ি লুঙ্গি এসবও এখন দোকানে তুলছেন। ক্রেতাদের চাহিদার কারণেই কিছু কিছু ভারতীয় শাড়িও রাখা হয় বলে জানালেন আল-হামদ বেনারসির ম্যানেজার। তবে এবার ঈদে মিরপুরের কাতান-বেনারসি শাড়ির মধ্যে ঐতিহ্যবাহী নকশার শাড়িগুলোই বেশি চলছে বলে জানালেন দিয়া ফ্যাশনের ম্যানাজার। এসব কাতান-বেনারসি শাড়ি[র মধ্যে রয়েছে কাঞ্জিভরম, কাঞ্জিলাল, গাদোয়াল, খাড্ডি, পৌরি, অপেরা, লাচ্ছা, কোরা ইত্যাদি। দাম ৩ হাজার টাকা থেকে ৩০ হাজার টাকা পর্যন্ত। দাম নির্ভর করে শাড়ির সুতা ও কাজের ওপর।
মিরপুর ১১ নম্বর বেনারসি পল্লীতে দোকানের সংখ্যা কম। এখানে হানিফ সিল্কের দোকানে ঈদের শাড়ি কিনতে এসেছিলেন ব্যাংক ,কর্মকর্তা মণিরা খাতুন। তিনি এখানকার নিয়মিত ক্রেতা। বললেন, নিশ্চিন্তে দেশি শাড়ি কেনা যায়। এরা ভারতীয় শাড়ি দেশি বলে চালিয়ে দেয় না। এই মার্কেটে দামও খুব বেশি রাখে না। স্বত্বাধিকারী মোহাম্মদ হানিফ জানালেন, এবার ঈদ উপলক্ষে রূপসী বাংলা ও বাংলার রূপ বিশেষ ধরনের নকশার দুই রকমের বেনারসি শাড়ি এনেছেন তাঁরা। এর দাম ৫ হাজার থেকে ২৫ হাজার টাকা পর্যন্ত। শাড়ির দাম গতবারের চেয়ে এবার বাড়েনি।
 বেনারসি পল্লী ঘুরে আরও দেখা যায়, ঈদ সামনে রেখে পুরনো শাড়িগুলোর সঙ্গে এসেছে নতুন রং ও বাহারি ডিজাইনের বিভিন্ন ধরনের শাড়ি। ঈদ উপলক্ষে পাওয়া যাচ্ছে বিয়ের স্বর্ণকাতান, বেনারসি জর্জেট, গাদওয়াল, কাঞ্জিভরম, অপেরা কাতান, পাছারা কাতান, তসর কাতান, ধুপিয়ান, বালুচুরি তাঁত, মসলিন কাতান, ঢাকাই জামদানি, স্বর্ণ কাতান, ভেলভেট কাতান, চুন্দ্রি কাতান, পিওর কাতান, ফুলকলি কাতান, মসলিন জামদানি, জুট কাতান, চেন্নাই কাতানসহ বিভিন্ন ধরনের শাড়ি।
এছাড়া রয়েছে কাতান থ্রি-পিস, শেরওয়ানি, পাঞ্জাবি, পায়জামা, লুঙ্গি, গামছা, ছোটদের ড্রেসসহ রকমারি পোশাকের সমাহার। তবে নারীদের পছন্দের শীর্ষে রয়েছে বিভিন্ন ধরনের কাতান শাড়ি। ঈদ উপলক্ষে বেনারসি স্বর্ণকাতানের চাহিদা বেশি। এছাড়া বিক্রিও ভালো। সোমবার বেনারসি পল্লীতে শাড়ি কিনতে মগবাজার থেকে এসেছেন চায়না বেগম। তিনি জানালেন, তাঁতীদের হাতে তৈরি হওয়ার কারণে এখানকার শাড়ির মানটা অনেক ভালো হয়। এ ছাড়া শাড়ির দামটাও হাতের নাগালের মধ্যে থাকে। কানাডা থেকে সাত দিন হল দেশে ফিরেছেন আবির হাসান। তিনি বিয়ের জন্য শাড়ি কিনতে এসেছেন বেনারসি পল্লীতে। তিনি জানান, বিয়ের শাড়ির জন্য সবচেয়ে ভালো মিরপুরের বেনারসি পল্লী। সাধ ও সাধ্যের মধ্যে পছন্দসই শাড়ি পাওয়া যায় এখানে। এ ছাড়া বিয়ের শাড়ি বলে কথা। তাই নিজের পছন্দসই শাড়ি শুধু এখানেই পাওয়া যায়। মিরপুরে বেনারসি পল্লীর যাত্রা শুরু সেই ১৯০৫ সালে। মানে একশ’ বছরেরও বেশি সময় ধরে এখানে বেনারসি, কাতান, জামদানিসহ দারুণ সব শাড়ি বেচাকেনা চলছে।
১৯৯০ সাল পর্যন্ত গদিঘর তেমন ছিল না বললেই চলে। গদিঘরগুলোয় বেনারসি শাড়ির খুচরা ও পাইকারি কেনাবেচা হতো সাধারণত। পরবর্তী সময়ে চাহিদা বাড়তে থাকায় এগুলোর সংখ্যা বাড়তে থাকে। পুরনোদের সঙ্গে নতুন নতুন উদ্যোক্তা যোগ দেয়। পরবর্তী সময়ে কারখানাগুলো অন্য জায়গায় সরে যায় ও গদিঘরগুলো আধুনিক শোরুমে পরিণত হয় এবং দেশে-বিদেশে এখানকার পরিচিতি ও জনপ্রিয়তা বাড়তে থাকে।বর্তমান ঈদ ট্রেন্ড চলছে একটু গর্জিয়াস ঘরানার। ক্রস, লেইস, ডলার, স্টোনের ব্যবহারের পাশাপাশি পাতলা আরামদায়ক সুতি কাপড়ের ওপরও রয়েছে নানা ভ্যারিয়েশন। নতুন কাপড়ের মধ্যে রয়েছে সিকোয়েন্স, ডিজিটাল, জুমার, লামলাম কটন, লেদার প্রিন্টসহ নানা ধরনের কাপড়। এর মধ্যে সিকোয়েন্স কাপড় বেশ গর্জিয়াস। ইন্ডিয়ান কটন রয়েছে কয়েক ধরনের। ইন্ডিয়ান কটনগুলোর পাড়ে চওড়া এম্ব্রয়ডারি ও হাতের কাজ করা। ভেলভেট কাপড়ে জর্জেটের ওপর নকশা করা হয়েছে ভেলভেট দিয়ে। কটনের মধ্যে রয়েছে চোখধাঁধানো নানা ডিজাইন। নতুন আসা লেদার প্রিন্ট খুব আরামদায়ক। নেট কাপড়ের ওপর লেদারের ফুলের মতো বসানো কাপড় জুড়ে।
ডিজাইনারদের সূচিকর্মের মুন্সিয়ানাতে থাকবে নিত্যনতুন ভাবনার বহিঃপ্রকাশ। ঈদে গতানুগতিক বাঙালিয়ানায় পোশাকী কারুকাজে আনা হয়েছে গর্জিয়াস লুক। ঈদের জন্য এবার ফেব্রিক হিসেবে অনেকে বেছে নিয়েছে লিলেন কটন, এন্ডি সিল্ক, হাফ সিল্ক, জয় সিল্কসহ বিভিন্ন ডিজাইন ফেব্রিক। শতাধিক সালোয়ার কামিজ আর পাঞ্জাবির ডিজাইনে এবার কাটিং, ফিটিংস এবং নেক লাইন বৈচিত্র্যতা থাকছে সমসাময়িক ট্রেন্ড অনুযায়ী। শাড়িতে টাঈালের তাঁত, জামদানিসহ থাকছে ভারি কারুকার্জের ঈদ কালেকশন। সালোয়ার কামিজ আর কুর্তার প্যাটার্নে এবার থাকছে লং এবং গাউন স্টাইল, কিছু কাটিং-এ থাকছে ঘের এবং বডি ফিটিংস।
এবার দেশীয় ফ্যাশন হাউস রঙ-বিশ্বরঙ এনেছে বিশেষ আয়োজন। ঈদ মানেই অনাবিল আনন্দ, তাই ঈদকে কেন্দ্র করে ‘বিশ্বরঙ’-এর ব্যাপক প্রস্তুতি চলছে বছরজুড়ে। কেন না ঈদকে ঘিরেই আমাদের দেশের মূল ফ্যাশন সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে। বছরজুড়ে ফ্যাশন নিয়ে যত নতুন ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা হয়, তার বহিপ্রকাশ ঘটে প্রতিবারের ঈদে। তাই সুদীর্ঘ ২৩ বছর ধরে নিত্য নতুন ট্রেন্ড নিয়ে ‘বিশ্বরঙ’ ঈদ আয়োজন করে থাকে।
নন্দিনীতে এবার রয়েছে কালার ফুল ডিজাইনের ভিন্নধর্মী পোশাক। সুতির ওপর নানা রঙের সুতার কাজ করা সালোয়ার কামিজ। গাউন স্টাইলের পোশাকগুলো রাখা হয়েছে এখানে। মসলিন, পিওর এবং জর্জেটের ওপর কাজ করা হয়েছে গাউনগুলোতে। এ পোশাকটি জাঁকজমক ঈদ পার্টিতে পরে যাওয়া যাবে অনায়াসে। হাতের কাজের সালোয়ার কামিজ এবারো দেখা যাবে। পাতলা সুতি, মসলিন, নরম সিল্ক কাপড় বেশি ব্যবহার হয়েছে। জামদানি দিয়েও তৈরি হয়েছে সালোয়ার-কামিজ। দেশি এ কাপড়গুলোয় কোনো কৃত্রিম তন্তু ব্যবহার করা হয়নি।লম্বা কামিজের চলটা এবার অনেক বেশি। তবে এর থেকে ভিন্ন কিছুও পরতে চাইবেন অনেকে। এ ভাবনা থেকেই বাজারে এসেছে ফ্রক কাটের কিছু কামিজ। অবশ্য লম্বা কামিজও করা হয়েছে। উজ্জ্বল রঙে এবারো ব্যতিক্রম নয়। আর এসব পোশাকে ব্যবহার হয়েছে মূলত অ্যামব্রয়ডারির নকশা। কিছু অ্যাপ্লিক, স্ক্রিন প্রিন্ট, ব্লক প্রিন্টও ব্যবহার হয়েছে। আবহাওয়ার কারণেই এবার সাজটাও দেখা যাবে হালকা। হালকা বেস মেকআপে গাঢ় কাজল আর উজ্জ্বল লিপস্টিক, এমনটাই হতে পারে সাজের ধরন।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ