রবিবার ২৮ এপ্রিল ২০২৪
Online Edition

লক্ষ্য হোক আঞ্চলিক দারিদ্র্যবৈষম্য নিরসন

মো. আবুল হাসান/খন রঞ্জন রায় : বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবর্ষ অনুষ্ঠান জাঁকজমকপূর্ণ করতে সরকার ও দেশবাসী প্রস্তুতি গ্রহণ করছে। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলাকে সত্যিকার অর্থে ক্ষুধা-দারিদ্রমুক্ত, শান্তি ও সম্প্রীতির বেলাভূমিতে পরিণত করবে। এই উদ্দেশ্যে সরকার গঠনমূলক নানা কর্মসূচিও বাস্তবায়ন করে যাচ্ছে।
অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত তার ২০১৮-২০১৯ অর্থবছরের বাজেট বক্তৃতায় দেশে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর হার ২০১০ সালের ৩১ দশমিক ৫ থেকে ২৪ দশমিক ৩ শতাংশে নেমে এসেছে বলে জানিয়েছেন। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুারোর (বিবিএস) প্রাথমিক হাউজহোল্ড ইনকাম অ্যান্ড এক্সপেন্ডিচার সার্ভে (এইচআইইএস) ২০১৬ এর জরিপে বিস্তারিত ওঠে এসেছে। তবে জাতীয় পর্যায়ে দারিদ্র হার কমে এলেও আন্তঃবিভাগীয় বা আন্তঃআঞ্চলিক দারিদ্রবৈষম্য অনেক ক্ষেত্রে বেড়েছে। কোনো কোনো প্রশাসনিক বিভাগ বা অঞ্চলে ২০১০ সালের দারিদ্র হার ২০১৬ সালে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে কমে এলেও কোনো বিভাগ বা অঞ্চলে এ সময়ে দারিদ্র হ্রাসের হার খুবই সামান্য। আন্তঃআঞ্চলিক উন্নয়ন বৈষম্য প্রকট আকার ধারণ করেছে। ২৮ জুন পাস হওয়া ৪ লাখ ৬৪ হাজার ৭৩ কোটি টাকার বাজেটে এ বৈষম্য নিরসনে কোনো বিশেষ ব্যবস্থা রাখা হয়নি।
এইচআইইএস ২০১৬ অনুযায়ী, সবচেয়ে দারিদ্রপীড়িত বিভাগ বা অঞ্চলগুলোর প্রথমে রংপুর অঞ্চল, এখানে দারিদ্রের হার ৪৭ দশমিক ২, দ্বিতীয় ও তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে যথাক্রমে ময়মনসিংহ বিভাগ এবং রাজশাহী বিভাগ। ময়মনসিংহ বিভাগে দারিদ্র হার ৩২ দশমিক ৮ শতাংশ। রাজশাহী বিভাগে দারিদ্র হার ২৮ দশমিক ৯ শতাংশ, যা ২০১০ সালে ছিল ২৯ দশমিক ৮ শতাংশ। খুলনা ও বরিশাল বিভাগে দারিদ্র হার যথাক্রমে ২৭ দশমিক ৫ এবং ২৬ দশমিক ৫ শতাংশ।
বিশ্বব্যাংক, বিবিএস ও বিশ্ব খাদ্য সংস্থা কর্তৃক যৌথভাবে তৈরি এবং ২০১৪ সালে প্রকাশিত বাংলাদেশের পোভার্টি ম্যাপ বা দারিদ্র মানচিত্রেও দেশের সর্বোচ্চ দারিদ্রপীড়িত জেলা ছিল কুড়িগ্রাম। দারিদ্র হার ছিল ৬৩ দশমিক ৭ শতাংশ। দারিদ্র হারে শীর্ষ অবস্থানে থাকা কুড়িগ্রাম জেলার পরই দিনাজপুর জেলার অবস্থান। এখানে দারিদ্র হার ৬২ দশমিক ৩ শতাংশ, যদিও ২০১৪ সালে দেশের সবচেয়ে দারিদ্রপীড়িত সাতটি জেলার তালিকায় দিনাজপুরের নাম ছিল না। রংপুর, গাইবান্ধা ও লালমনিরহাটে দারিদ্র হার যথাক্রমে ৪৩ দশমিক ৪৬ দশমিক ৭ ও ৪২ দশমিক শূন্য শতাংশ। ২০১৪ সালের দারিদ্র মানচিত্রে রংপুর, গাইবান্ধা ও লালমানিরহাট জেলায় দারিদ্র হার ছিল যথাক্রমে ৪৮ শতাংশ, ৩৪ দশমিক ৮ শতাংশ ও ৩৪ দশমিক ৫ শতাংশ। একাধিক কারণে রংপুর বিভাগ দেশের দরিদ্রতম বিভাগে পরিণত েেহছ। প্রাচীনকাল থেকে জীবন নির্বাহের জন্য কৃষির উপর নির্ভরশীলতা ছিল অত্র এলাকার মানুষজন।
দারিদ্রপীড়িত বিভাগগুলোর মধ্যে দ্বিতীয় অবস্থানে ছিল বরিশাল বিভাগ। এখানের দারিদ্র হার ছিল ৩৯ দশমিক ৪ শতাংশ। ২০১০ সালে খুলনা বিভাগে দারিদ্র্যের হার ছিল ৩২ দশমিক ১ শতাংশ। ঢাকা, সিলেট ও চট্টগ্রাম বিভাগে দারিদ্র হার জাতীয় পর্যায়ে দারিদ্র্যের হারের নিচে। ঢাকা বিভাগে দারিদ্র্য হার সবচেয়ে কম। এখানে দারিদ্র্যের হার ১৬ দশমিক শূন্য শতাংশ। অথচ ২০১০ সালে ঢাকা বিভাগ (বর্তমান ময়মনসিংহ বিভাগসহ) দারিদ্র্য হার ছিল ৩০ দশমিক ৫ শতাংশ। সিলেট বিভাগে দারিদ্র্য হার ১৬ দশমিক ২, যা ২০১০ সালে ২৮ দশমিক ১ শতাংশ। চট্টগ্রাম বিভাগে দারিদ্র্য হার ১৮ দশমিক ৪ শতাংশ, যা ২০১০ সালে ছিল ২৬ দশমিক ২ শতাংশ।
কোনো বিভাগ বা অঞ্চলে দারিদ্র্য হ্রাস বা বৃদ্ধিতে ইকোনমিক ইউনিটের অবস্থান গুরুত্বপূর্ণ। যে বিভাগে ইকোনমিক ইউনিটের সংখ্যা যত বেশি, সে বিভাগে অর্থনৈতিক কর্মচাঞ্চল্য তত বেশি। ইকোনমিক সেন্সাস ২০১৩ অনুযায়ী ঢাকা বিভাগে সর্বোচ্চসংখ্যক ইকোনমিক ইউনিট অবস্থিত। এর পরিমাণ ২৫ লাখ ৯৯ হাজার ৩৭২ টি। দ্বিতীয় সর্বোচ্চসংখ্যাক ইকোনমিক ইউনিট চট্টগ্রামে, যার সংখ্যা ১৩ লাখ ৮৪ হাজার ৭৫৭টি। দরিদ্রতম বিভাগ রংপুরে ইকোনমিক ইউনিটের সংখ্যা ১০ লাখ ৮৮ হাজার ২৫৫টি। রংপুর বিভাগসহ যেসব বিভাগে ইকোনমিক ইউনিটের সংখ্যা যত কম, সেসব বিভাগে বেকারত্বের হার তত বেশি। অর্থনীতির সংখ্যা মোতাবেক বেকারত্ব ও দারিদ্র্য একই মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ।
আঞ্চলিক বৈষম্য শব্দটি আমাদের স্বাধীনতাপূর্ব রাজনীতিতে প্রচন্ড দাপটে ছিল। আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের পটভূমিই বৈষম্যের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ থেকে। রাষ্ট্রের সম্পদের যোগান ও উন্নয়নের সিংহভাগ রসদ দিচ্ছিল পূর্ব পাকিস্তান। পাট, তুলা, রেশম, কাঠ, চামড়া এবং অন্যান্য সম্পদ ছিল পাকিস্তানের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের মোটা উৎস। সেই অর্থে পশ্চিম পাকিস্তানি দিন দিন সমৃদ্ধ হচ্ছে এবং পূর্ব পাকিস্তান হচ্ছে নিঃস্ব। এক সাগর রক্তের বিনিময়ে পাকিস্তান থেকে আলাদা হয়ে পূর্ব পাকিস্তান বাংলাদেশ হয়ে যায়। স্বাধীন গণতান্ত্রিক কাঠামোর ওপর গড়ে উঠল, স্বাভাবিকভাবেই আঞ্চলিক বৈষম্য কথাটি আমাদের রাজনীতিতে আর রইল না। পশ্চিম পাকিস্তানের সঙ্গে পূর্ব পাকিস্তানের দূরত্ব ছিল দেড় হাজার মাইল। স্থলপথে কোনো যোগাযোগ ছিল না। কিন্তু স্বাধীন বাংলাদেশে এরকম আঞ্চলিক দূরত্ব নেই। যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নত ছিল না বলে আগে উত্তরবঙ্গ থেকে দক্ষিণবঙ্গে যেতে সময় লাগত। এখন তো যোগাযোগ ব্যবস্থা অনেকটাই উন্নত। ভালো রাস্তাঘাট হয়েছে। বঙ্গবন্ধু যমুনা সেতুর বদৌলতে দুই বঙ্গের দূরত্ব ও পার্থক্য এখন অনেক ঘুঁচে গেছে। কেবল ঘোঁচেনি দারিদ্র ও বঞ্চনা। রংপুর, ময়মনসিংহ, রাজশাহী, খুলনা, বরিশাল কোনো কোনো এলাকা এখনও উন্নয়ন বঞ্চিত এবং দরিদ্র।
ভয়াবহ আঞ্চলিক উন্নয়ন ভেদাভেদের দ্রুত বিহিত ব্যবস্থা না হলে একই দেশের ভেতরে বিবাদ, সংঘাত ও বিদ্বেষ বেড়ে যেতে পারে এবং আঞ্চলিক বৈষম্যের মরা ঘোড়া আবার জেগে উঠতে পারে। আঞ্চলিক বৈষম্যের দরুন বহু দেশে বিচ্ছিন্নতাবাদ মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। উন্নয়নের ক্ষেত্রে অসমতার কারণে সেসব দেশে এক অঞ্চল থেকে আরেক অঞ্চল থেকে আলাদা হয়ে যাওয়ার দাবি ওঠে। ভারতে নাগাল্যান্ড, মেঘালয়, মনিপুর ইত্যাদি বিভিন্ন আলাদা প্রদেশ (রাজ্য) প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, শুধু জাতিগত পার্থক্যের জন্য নয়, আঞ্চলিক বৈষম্যের জন্যও। পশ্চিম বাংলা থেকে আলাদা হয়ে গোর্খাল্যান্ড প্রতিষ্ঠার দাবি উঠেছে মূলত এই অর্থনৈতিক বৈষম্যের কারণে। বিহার প্রদেশ একাধিক রাজ্যে ভাগ হয়েছে একই কারণে।
অবশ্য বাংলাদেশে ভারতের মতো দলিত শ্রেণির অস্তিত্ব নাই। সাঁওতাল, মুন্ডাসহ পার্বত্য উপজাতি গোষ্ঠীগুলোয় উন্নয়নের ধারা সংখ্যাগরিষ্ঠ সম্প্রদায়ের সমান হওয়া চেষ্টা হচ্ছে। অর্থনৈতিক ও সামাজিক বৈষম্য থেকে যাতে জাতিগত বৈষম্য দেখা না দেয় এবং দেশের অখ-তা ও সার্বভৌমত্বের ওপর এর কোনো প্রভাব না পড়ে, সেদিকে সর্তক দৃষ্টি সরকারে থাকলেও তা যথার্থ নয়। যদি হতো তবে এই সরকারের আমলে দেশের অর্থনীতির যে অভাবিত উন্নতি ঘটেছে, সেক্ষেত্রে রংপুর, ময়মনসিংহ, রাজশাহী, খুলনা, বরিশাল বিভাগে তার ছোঁয়া কেন লাগেনি তার তদন্ত হওয়া উচিত। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সর্বাধিক উচ্চারিত শব্দ হচ্ছে ‘সোনার বাংলা’ গড়তে সোনার মানুষের দরকার। সোনা অর্থাৎ খাঁটিÑ যেখানে কোনো খাদ থাকবে না। থাকবে না আঞ্চলিক বৈষম্য, জাতিগত বৈষম্য, ধর্মীয় বৈষম্য; বাঙালি-আদিবাসী, হিন্দু-খ্রিস্টিয়ান, বৌদ্ধ-বাহাই কিংবা শিখ ধর্মাবলম্বী সবার সমান অধিকার থাকবে। এক স্রাষ্টার সৃষ্টি মানুষ হিসেবে যদি অপরকে বিবেচনা করতে না পারি, তাহলে বৈষম্যের সূত্রপাত বা বীজ মহীরূহে পরিণত হবে।
সোনার মানুষের সাথে কর্মপ্রাপ্তি ও দরিদ্রতা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। দারিদ্রের সাথে শিক্ষার রয়েছে গভীর সর্ম্পক। সাধারণ শিক্ষা বেকার সৃষ্টি করে। অভিভাবক (পিতা-মাতা), শিক্ষার্থী, সন্তান (ছেলে-মেয়ে), তিনটি প্রজন্মকে নিঃস্ব করে দেয়। ডিপ্লোমা শিক্ষা কর্মে হাতছানি দেয়। দেশ-বিদেশে উচ্চ বেতনে চাকরি পেতে কোনো বেগ পেতে হয় না। নিজে শিল্প, খামার, হাসপাতাল, ক্লিনিক গড়ে তুলতে পারে। পৃথিবীর কোনো দেশেই ডিপ্লোমা ডিগ্রিধারী একজনও কর্মহীন নেই। জাপান, জার্মানি, কোরিয়া, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের পাশাপাশি ডিপ্লোমা ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা করেছে। মোট শিক্ষার্থী ৬০/৭০ শতাংশকে ডিপ্লোমা ইনস্টিটিউটে ভর্তির নির্দেশনা দিয়েছে। প্রতিটি বাড়ি, গ্রাম, ইউনিয়ন, জেলা, বিভাগকে দারিদ্রমুক্ত করতে পেরেছে দক্ষ জনশক্তি গড়ে তোলার বদৌলতে।
বাংলাদেশে প্রতিবছর রংপুর, ময়মনসিংহ, রাজশাহী, খুলনা, বরিশাল ৫টি বিভাগ থেকে প্রায় ১০ লক্ষ ছেলে-মেয়ে এসএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়। তার অর্ধেক তরুণকে ডিপ্লোমা ইনস্টিটিউটে ভর্তির নির্দেশনা ও সুযোগ করে দিতে হবে। আর তা হলে আগামী ৫ বছরেই দারিদ্রপীড়িত বিভাগসমূহে ডিপ্লোমা ডিগ্রিধারীর সেবা শুরু হবে। কর্মক্ষম তরুণরাই আঞ্চলিক উন্নয়ন বৈষম্য দূরীকরণে সৃজনশীল ভূমিকা রাখবে। বাংলাদেশে অনেক সমস্যাই সমাধান হয়, ডিপ্লোমা ডিগ্রি অর্জনের প্রাথমিক শর্তও বিভাগীয় ডিপ্লোমা শিক্ষা বোর্ড প্রতিষ্ঠা। আমাদের রাজনীতিকরা একটু উদার ও দূরদর্শী হয়ে একাজটি করতে পারলেই বাংলাদেশের হাজারো সমস্যার অবসান ঘটবে।
লেখক : সভাপতি ও মহাসচিব, ডিপ্লোমা শিক্ষা গবেষণা কাউন্সিল, বাংলাদেশ।
[email protected]

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ