মঙ্গলবার ৩০ এপ্রিল ২০২৪
Online Edition

নীড়ে ফেরা

নাজিব কিলানি/তরজমা: কামরুল হাসান

[মানব জীবন সংক্ষিপ্ত। ভুল সিদ্ধান্ত, জড়তা কিংবা বিদ্বেষের বশবর্তী হয়ে জীবনকে বিষময় করে তোলা অনুচিত। জীবন এতোটাই সংক্ষিপ্ত যে, এ কষ্ট বহন অসহনীয়। আমার জীবনের আর কী দাম! জীবনের গুরুত্বপূর্ণ বারোটি বছর কেটে গেলো কারাগারের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে।]

 

কারা প্রকোষ্ঠ। ফাঁসির সেল। মাদুরে চিৎ হয়ে শুয়ে আছে মাসুদ। দৃষ্টি সেলের ছাদের দিকে। অন্ধকার সব কিছুকে ঢেকে ফেলেছে। কারা সহপাঠিরা নিয়তিকে মেনে নিয়ে নাক ডেকে ঘুমায়। তারা স্বপ্নবিভোর। কিন্তু মাসুদ দীর্ঘ রাতে একটুও ঘুমায় না। কারণ তার বারো বছরের কারাভোগের আজই শেষ দিন। দীর্ঘ বঞ্চনা, অশ্রুপাত ও লাঞ্ছনার বারো বছর পূর্ণ হবে আজ।

একটি প্রশ্ন সর্বদা তার কানে বাজে- কোনো পুরুষ কি তার স্ত্রীর অপরাধ ক্ষমা করতে পারে? নিশ্চয়ই স্ত্রীর অপরাধ স্বামীর বুকে বর্শার মতো বিদ্ধ হয়। কোনোভাবে তা ভুলতে পারে না। সে ঐ অপরাধের প্রতিষেধক খুঁজে পায় না। মাসুদ সংরক্ষণবাদী মানুষ। সে স্ত্রীর অপরাধকে জীবনের বড় অনাচার বিবেচনা করে। এ কারণেই আজ তার কারাবাস। এ নির্মম পরিণতি।

আজ থেকে বারো বছর আগে। মাসুদ সেই দৃশ্য দেখেছিল। মাসুদের চোখে আজও তা জ¦লজ¦ল করে। যেন তা গতকালের ঘটনা। সে ভুলতে পারে না। তার স্ত্রী দুর্বলতা অথবা প্রতারণায় নিজেকে শয়তানের কাছে বিক্রি করে। কার কাছে সে নিজেকে বিক্রি করেছিল? তারই এক প্রিয় বন্ধুর কাছে। আব্দুস সালাম ফারজ্। সে আসলে বন্ধু ছিল না। সে ছিল ধুর্ত নেকড়ে। যাকে সে বিশ^াস করত অতিমাত্রায়। তার বাড়িতে ছিল বন্ধুর অবাধ যাতায়াত। তাদের সম্পর্ক ছিল দু’সহোদরের মতো। কিন্তু আব্দুস সালাম এ সব অস্বীকার করে। সে নাফিসার প্রতি আসক্ত হয়। শুধু তাই নয়- সে মাসুদকে প্রতারক হিসেবে অভিযুক্ত করে এবং কারাগারের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে নিক্ষেপ করে। অবশ্য মাসুদ মনে করে- সে স্বামী হিসেবে অকোমল। স্ত্রীর প্রতি তার চাহনি সর্বদা কুঞ্চিত। স্ত্রী প্রশ্নে সে সর্বদা সমালোচনামুখর। স্ত্রীর সাথে তার আচরণ দাস-দাসীর মতো। স্ত্রী সাজগোজ করলেই মাসুদ এ নিয়ে উপহাস ও ভৎর্সনা করে। কখনই নাফিসার রান্নার প্রশংসা করে না। নাফিসার কোনো কাজেরই সে প্রশংসা করে না। সে কখনও স্ত্রীকে কিছু গিফট দেয় না। তার সাথে হাসি-ঠাট্রা করে না। কখনও বউকে নিয়ে কায়রোর বাইরে কোনো সিনেমা, পার্ক বা বিনোদন ভ্রমণে যায়নি। সে সর্বতোভাবে চাকুরীতে নিজেকে ব্যাপৃত রাখে। স্বীয় কর্মকীর্তিকেই প্রাধান্য দেয়। তার কাছে স্ত্রী এবং জীবন দু’টোই তার অনাগ্রহের ও উপহাস মাত্র। এতে অন্য কারুর অনুপ্রবেশ ছিল অনাধিকার চর্চা।

এটিই বাস্তবতা। কিন্তু এটিই কি নাফিসার পতনের জন্য যথেষ্ট? মাসুদের মান-সম্মান ধুলোয় মিশিয়ে কলঙ্কিত করতে যথেষ্ট? তাকে এভাবে চপোটাঘাত করা কি তার জন্য সমীচিন ছিল?

একদা পথচারীদের মাঝে ফিসফিসানি শুনি। তারা আমার স্ত্রীকে নিয়ে নানাকথা বলে। প্রথমে আমি এসবে কান দেইনি। কারণ আব্দুস সালাম আমার বিশ^স্ত বন্ধু। আমার বিশ^াস- আব্দুস সালাম এমন বোকামী করতে পারে না। তাছাড়া নাফিসাও তো ভীতুর ডিম। সে খেয়ানতের এমন সাহস দেখানোর কথা নয়। স্বামীকে বাদ দিয়ে অন্য কোনো পুরুষের শয্যা সঙ্গী হবে এটি ভাবা দুস্কর। সে স্বামীকে ভয় পায়। সমীহ করে। ভয়ে ত্রস্ত থাকে। তার কোনো ব্যক্তিত্ব নেই। তবে তার রয়েছে নজড়কাড়া সৌন্দর্য। সেখানেই শংকা।

সন্দেহ ক্রমশ ঘনীভূত হতে থাকে। একদিন এক প্রতিবেশি জানায়- আমার বন্ধু প্রায়শ আমার বাসায় যাতায়াত করে। বিশেষত বাইরে থাকাকালীন সে আমার বাড়ী আসে। এ কথা শুনে মাসুদ ক্ষেপে যায়। কোনো কথা বলতে পারে না। এটি বিশ^স্ততার সাথে যায় না। সততার সাথে এটি বেমানান। আমি এসব উড়ো কথায় কোনো পাত্তা দিই না।

মাসুদ নাফিসার দিকে অর্থপূর্ণ দৃষ্টিতে তাকায়। অপলক তাকিয়ে থাকে। সন্দেহাতীতভাবে সে যে সুন্দরী। অপ্সরী। সে অনিন্দ্য সুন্দরী। সৌন্দর্য তার অসীম। তার সৌন্দর্যের কোনো সীমা-পরিসীমা নেই। তবে সে কখনও চিন্তা করেনি যে তারও জৈবিক চাহিদা থাকতে পারে। সে তার দৈহিক চাহিদা তথা খাবারের ব্যবস্থা রাখে পূর্ণমাত্রায়। তার ধারণা এতেই চলে যাবে সবকিছ্।ু সে ভাবতে পারেনি- এর বাইরেও নারীদের আরো কিছুর চাহিদা থাকে। মাসুদের মনে পড়ে- আব্দুস সালাম অত্যন্ত বুদ্ধিমান ও কমনীয় সুপুরুষ। সে কর্মকর্তা হিসেবে ডিপ্লোমেট। পুরুষ হিসেবেও সচেতন। ভাবতে ভাবতে সে খেই হারিয়ে ফেলে। সংকুচিত হয়ে আসে। নষ্ট চিন্তা মাথায় ঢোকে। ভয় পায়- নাফিসা নিজের সাথে প্রতারণা করতে পারে? সে আব্দুস সালামকে ভয় পায়। তাকে নিয়ে হাজার রকম হিসেব করে। 

অসংখ্য দৃষ্টি আব্দুস সালামের পিছু লাগে। একদা সকালবেলা আব্দুস সালাম মাসুদের বাড়ি আসে। ঝড়ের বেগে এ খবর নাফিসার স্বামী মাসুদের কাছে পৌঁছে। মাত্র কয়েক মিনিট। মাসুদ বাড়ি ফিরে। ঘরে ঢোকে। নাফিসা ও আব্দুস সালামকে দেখে। না। কোনো অনাকাংখিত অবস্থা নয়। কিন্তু তাতে কী! মাসুদ ক্রোধে ফেটে পড়ে। অন্তরে জ¦ালা ধরে। আব্দুস সালাম নাফিসার পক্ষে সাফাই গায়। নাফিসার চেহারা বিষন্নতায় ছেয়ে যায়। মনে হয় এই বুঝি মূর্ছা যাবে। ভয়ে সে যেখানে ছিল সেখানেই দাঁড়িয়ে থাকে। যেন ছায়ামূর্তি।

মাসুদ নিশ্চুপ হয়। তার মনে বাসা বাঁধে দুষ্টু শয়তান। প্রতিশোধ স্পৃহা ও উত্তেজনা তাড়িত হয়। শয়নে-স্বপনে সালামের চেহারা তাকে তাড়া করে। চিৎকার দিয়ে বলতে চায়- আব্দুস সালাম তোমার খিয়ানতের একমাত্র দাওয়াই মৃত্যু।

মাসুদ নাফিসাকে উপেক্ষা করতে শুরু করে। ভাবে- সে নাফিসা থেকে প্রতিশোধ নেবেই নেবে? সে নিজেও এ অপরাধের সহযোগী। সে কি এটি বোঝে না? সে কি নির্বোধ? সে স্বেচ্ছায় এ অপকর্মে লিপ্ত হয়েছে। মাসুদ এসব প্রশ্নের কোনো উত্তর খুঁজে পায় না।

মাসুদ চুপিসারে আব্দুস সালাম ফারজ্কে হত্যার পরিকল্পনা করে। নানা ইস্যুতে মাসুদ আব্দুস সালামকে এক জায়গায় বসানোর চেষ্টা করে। ফলে নাফিসা-সালামকে ঘিরে নতুন নতুন সন্দেহ দানা বাঁধতে থাকে। বিভিন্ন বিষয় প্রমাণের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। রাস্তা ক্রমশ পরিস্কার হতে থাকে। বুদ্ধিমানরা বাঁচার পথ খুঁজতে থাকে। মাসুদ অপরাধ সংশোধন কেন্দ্রে যায়। সেখানে বারো বছর কাটাবে বলে। সে বিয়ের তৃতীয় বৎসরে এক বৎসরের সন্তানকে ফেলে কারাবরণ করে।

মাসুদ মাদুরে পাশ ফিরে। তপ্ত হাই তোলে। কারাগারের প্রথম দিকের স্মৃতি স্মরণ করে। নীল পোশাক, দুষ্ট বন্ধু, কারাগারের সাথী, পাথর ভাঙা কোদাল, যাতনা ক্লিষ্ট শোকাবহ দিন, ভয়ংকর খেয়ানত- যা তাকে ঘরছাড়া করে। আবদুস সালামের খুন, নাফিসা তার স্মৃতিকে আন্দোলিত করে। উহ আল্লাহ! কেন আমি তাকেও হত্যা করলাম না? আব্দুস সালামকে খুন করার সময় কেন নাফিসাকে ছেড়ে দিলাম? কে জানে? সে হয়তো আজ বা আগামীকাল তালাক চাইবে। তখন তার দু’সন্তানের কী হবে? তারা দুর্নাম ছড়াবে। সে কোনো রাখালের সাথে ঘর সংসার করবে। তাকে প্রতারিত করবে। মান-সম্মান সব ধুলোয় মিশিয়ে দিবে। কারাবাসের প্রথম দিকে মাসুদ নিজে নিজেই এসব বলতো। এভাবে দিন কেটে যায়। মাসুদ প্রতিদিন কারাগারে নতুন নতুন অপরাধের সাথে পরিচিত হয়। মাসুদ দেখে- তার কারা সাথীরা দশ রকম অপরাধের সাথে জড়িত। নানা অপরাধে লিপ্ত। কিন্তু আইন তাদেরকে গ্রেফতার করতে পারে না। মাসুদের মনে হয় আসলে পাপ মানুষের আজন্ম স্বভাব। যদি তাই না হবে তবে সমাজে এতোসব অন্যায়-অনাচার সংঘটিত হয় কেন? কারাগারে এসব কদাচারীদের নির্বিঘœ বসবাস সম্ভব হয় কিভাবে?

মাসুদ প্রতিদিন নতুন কথা শোনে। তার আভিজাত্য, দাম্ভিকতা, অহমিকা কমে আসে। মানসিকতার পরিবর্তন হয়। নাফিসা তার কাছে প্রতিনিয়ত নতুন রূপে প্রতিভাসিত হয়। চিন্তার উত্তরণ ঘটে। প্রতিবেশ থেকে মাসুদ অনেক কিছুর শিক্ষা নেয়। সময়ের বিবর্তনে তার আত্মসম্মান চিন্তা প্রবল হয়। পাপাচার অন্য অর্থ ধারণ করে। নিজেকে প্রশ্ন করে- কে আমাকে এসব বাজে চিন্তায় ফেলে দিয়েছে? উহ! সত্যিই আমার বুঝ যথাযথ ছিল না। আমি কখনই তাকে কিছু দিতে চেষ্টা করিনি। এর সকল দায়ভার আমার। আমার একার এ সকল দায়ভার।

মাসুদ গলাখাঁকারি দেয়। মাদুরে নড়াচড়া করে। পাশ ফিরে। সিগারেটের প্যাকেট খোঁজে। সিগারেট জ¦ালায়। সিগারেটের গন্ধে এখনই সেলের সবাই জেগে যাবে। সিগারেট শেষ হওয়ার অপেক্ষা করবে। শেষ হলেই সিগারেটের পেছনটা এক বা দু’জন তাতে সুখটান দিবে। মাসুদ অবশ্য এ নিয়ে ভাবে না। মাসুদের ভাবনা- সিগারেট কাড়াকাড়ির সময় তার এ অনিন্দ্য সুন্দর ভাবনায় ছেদ পড়বে এ নিয়ে।

সিগারেট সেবন শেষ হয়। মাসুদ আবারও মাদুরে গা এলিয়ে দেয়। পূর্বচিন্তার সাথে নতুন চিন্তা যুক্ত হয়। অজানা শিহরণে অন্তর কেঁপে ওঠে। নিজেকে জিজ্ঞেস করে- নাফিসা কেন এতোদিন আমার কাছে ডিভোর্স চায়নি? তার বাচ্চা দু’টোকে কেন সে অনাথ আশ্রমে রেখে আসেনি? কেন সে সুখী জীবন প্রত্যাশা করেনি? আমি যাকে হত্যা করলাম তার রক্ত ও বিষন্ন স্মৃতি কেন সে ভুলতে চেষ্টা করেনি? কেন সে গৃহকোণকেই পছন্দ করল? খেয়ে না খেয়ে অতি কষ্টে দিনাতিপাত করল? ছেলেমেয়ের জন্য সে তার জীবনটাই শেষ করে দিল। কী কষ্টই না করল! সন্তানদের জন্য এ দীর্ঘ সময়ে কোনো প্রকার ত্যাগে সামান্যতম ব্যয়কুণ্ঠ হয়নি। 

এতো বড় ঘটনার পরেও তার মনে আমার জন্য কিয়দ ভালোবাসা থাকতে পারে এটি কি বিশ^াস্য? মজার ব্যাপার- নাফিসা চাইতো আমি যেন তার সাথে সাক্ষাতে অস্বীকৃতি জানাই। অন্তত একবারের জন্য হলেও। আমার পরিবার চাইত কেউ আমাকে অর্থ  সাহায্য না করুক। আপনারা কি জানেন- তার মাথায় কী ছিল? তার প্রত্যাশা ছিল তার প্রতি আমার অবিচার মোচন করা। কোনো অনাচারী মহিলা কি এমন ত্যাগের নজরানা পেশ করতে পারে? মানুষের কাজকর্ম বড়ই বিচিত্র!  হয়তো মানুষ এমন অনেক অপরাধ করে যা কখনই ক্ষমা করা যায় না। অনেক অপরাধ এমন থাকে যা অনিন্দ্যসুন্দর মুহূর্তেও মেনে নেয়া যায় না। কিন্তু এ পর্যন্ত সে আমাকে কোনো প্রস্তাবই দিলো না?

প্রশান্ত রাত। সর্বত্র নিস্তব্ধতা। কারাবন্দীদের কেউ ফজরের সালাতের জানান দেয়। মাসুদ মাদুরে উঠে বসে। আউযুবিল্লাহ বলে আল্লাহর কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করে। তওবা করে। ক্ষমা প্রার্থনা করে। ফজরের সালাত আদায় করে। ওয়াজিফা ও তাসবীহ-তাহলিল করে। দীর্ঘ কারাবাসের পর মুক্তির সময় ঘনিয়ে আসায় আল্লাহর প্রশংসা করে। আবারও মাদুরে শোয়। ফিসফিস কণ্ঠে কান্নাজড়িত হয়ে বলে- এখানে নির্দোষ কেউ নেই, এমন কাউকে এখানে পাওয়া যাবে না যে অনাচার, মিথ্যা ও কদর্যতা মুক্ত। পৃথিবীতে এমন মানুষের অস্তিত্ব পাওয়া দুস্কর। এমন মানুষের অস্তিত্ব কেবলই কল্পনার রাজ্যে পাওয়া যায়। আমরা যে ভুল করি তা দোষের কিছু নয়। বরং বারবার ভুল করা অন্যায় করা, অন্যায় করা অভ্যাসে পরিণত হওয়া অপরাধ। নাফিসার একবার পদস্খলন হয়েছে। সে তার প্রায়শ্চিত্ত করেছে। আমিও ভুল করেছি। দীর্ঘ কারাভোগের মাধ্যমে তার প্রায়শ্চিত্ত করেছি। ব্যস! সব শেষ হয়ে গেছে। যা হবার তা হয়েছে। এখন নতুন করে শুরু করব। জীবনটা বড়ই সংক্ষিপ্ত। হিংসা, বিদ্বেষ, অচলায়তন ইত্যাদির মাধ্যমে একে কঠিন করা উচিৎ নয়। এ সংক্ষিপ্ত সময়ে এত কঠিন বোঝা বহন করা যায় না। আমার আর জীবনের অর্থ কী? জীবনের বারো বৎসর তো কারাগারের অন্ধকার প্রকোষ্ঠেই কেটে গেল। হায় খোদা! আমি নাফিসাকে কত কিছ্ ুবলেছি। আমি নাফিসার সব অপরাধ ক্ষমা করে দিচ্ছি। কথা দিচ্ছি- নিশ্চয়ই আমি তাকে ভালোবাসব। শুধুই ভালোবাসব। সকল শুভ কামনা তার জন্য। আমি তাকে অবশ্যই ভালোবাসব যে আমার সন্তানের সুখের জন্য বিনিদ্র রজনী যাপন করেছে। আমার কারণে যাবতীয় কষ্ট-ক্লেশ, ক্লিষ্টতা মেনে নিয়েছে। তাকে আমি ভালোবাসব না কেন? একটি! একটি মাত্র অপরাধ। একটি অপরাধের প্রতিবিম্ব আমার কষ্টের ছায়াপথে বিচরণ করছে। আমার কষ্ট ও দুঃখময় অভিজ্ঞতাকে দ্রবীভূত করছে। উহ! মানবিক দুর্বলতা কী কষ্টের! যাতনার! কিন্তু আমরা কী করতে পারি? জীবনের ধারা তো এমনই।

মাসুদ কারা ফটকে মুক্তি প্রাপ্য বন্দীদের লাইনে দাঁড়ানো। তার কারাভোগ শেষ। দীর্ঘ কারাভোগের সময়টুকু প্রতীক্ষা করেই কেটে গেল। সময়টা ছিল শুধুই প্রতীক্ষার আর আফসোসের। মাসুদ এখন কৌতুহলি। শীঘ্র তার দু’ছেলের সাথে দেখা হবে। নাফিসার সাথেও দেখা হবে। দীর্ঘ অপেক্ষা ও নিঃসঙ্গতার অবসান হবে। এ মহেন্দ্রক্ষণের জন্যই এত প্রতীক্ষা। তার আগ্রহ লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ে। দ্বিগুণ থেকে বহুগুণ। তার বড় ছেলের বয়স আজ পনেরো বছর। মেয়েটির তেরো। তারা বড় হয়েছে। কিশোর-কিশোরী হয়েছে। অল্পক্ষণপরে সে তাদের মাঝ দিয়ে হেঁটে যাবে স্বাচ্ছন্দ্যে। দুনিয়া তার পথকে সংকুচিত করবে না। কিন্তু... তখন কি আমার ছেলে-মেয়েদের মধ্যে লজ্জা বা আড়ষ্টতা কাজ করবে যে, তারা জনৈক খুনির পাশ দিয়ে হেঁটে চলছে, যাবজ্জীবন জেলখাটা আসামীর পাশ দিয়ে হাঁটছে, তাদের অনাচারী মায়ের স্বামীর সাথে হাঁটছে? বিষয়টি তাকে ক্ষত-বিক্ষত করে। সুখ চিন্তা তাড়িয়ে দেয়। মুহূর্তে তার সুখের পৃথিবী ঘোলাটে হয়ে আসে। অথচ সে তাদেরই বাবা। তারাও তারই সন্তান। সামাজিক রীতি-নীতি কিংবা কলংকতিলক কখনও এ আবেগের প্রতিবন্ধক হতে পারে না। পিতৃত্বের ভালোবাসার অন্তরায় কখনও এসব সামাজিক আইন-কানুন হতে পারে না। 

কারা ফটক। মাসুদ দু’সন্তানের জন্য দু’বাহু প্রসারিত করে। চুমোতে চুমোতে তাদের কপাল ও কপোল ভরে দেয়। নয়নাশ্রু ছেড়ে দেয়। এ আবেগ দীর্ঘ কয়েক বৎসরের ভালোবাসা বঞ্চিত থাকার আবেগ। মাসুদের বুক কাঁপে। ফিসফিস করে বলে- তোমাদের মা কোথায়?

দু’জনের কেউ জবাব দেয় না। মাসুদ মাথা ঝাঁকায়। আস্থার সাথে। বলে- ও! বুঝেছি! হায়রে অভিমানী আমার! এখনও তার রাগ কমেনি! কারণ আমি কারাগারে তাকে সাক্ষাতের অনুমতি দেইনি। তার ইচ্ছা আমিই তার কাছে গিয়ে আপোস রফা করি। এটি সে চাইতেই পারে। বাবারা! এমন ভালো মায়ের জন্য এটুকু আমার ন্যুনতম দায়িত্বের মধ্যেই পড়ে বৈকি।

ছেলে-মেয়ে উভয়েই কেঁদে উঠে। মাসুদের চোখ থেকেও ফোটায় ফোটায় অশ্রু ঝরে। তারা কেউই এর বেশি কিছু করে না। কেউ কোনো কথাও বলে না। বাড়ির দরজার কাছে গিয়ে মাসুদ সন্তানদ্বয়কে বলে:

-- তোমরা দরজার বাইরে একটুখানি দাঁড়াও। আমি নাফিসাকে সারপ্রাইজ দিতে চাই। এ যে বড়ই মধুর সময়। এ মধুক্ষণ।

ধীর পদক্ষেপে ঘরের দিকে এগিয়ে যায় মাসুদ। ছেলেরা বাবার হাত টেনে ধরে। যেতে বাধা দেয়। বাধা উপেক্ষা করে মাসুদ এগিয়ে যায়। এখানে-সেখানে স্ত্রী নাফিসাকে খোঁজে। বিরক্তির সাথে বলে:

-- ছাড়ো বাবা! এখন ঝামেলা করো না। আমার ছোটো ময়নাকে যে খুব মনে পড়ছে। কতদিন দেখি না তারে। 

গোটা ঘর শূন্য। বিরান ঘরে কারো কোনো সাড়া শব্দ নেই। তবে ঘরের সবই সাজানো গোছানো। সোফা আছে সোফার জায়গায়, শয্যা তার যথাস্থানে, আসবাবপত্র আছে সব ঠিকঠাক। টেবিল ও দেয়ালে শোভা পাচ্ছে দৃষ্টিনন্দন সব পোষ্টার, আলনায় নতুন নতুন পোশাকাদি। কাঁচের পানপাত্র, সিগারেটের দামী এস্ট্রে। টেবিলের উপর রয়েছে খামে আবদ্ধ একটি চিঠি। চিঠির উপর মাসুদের নাম লিখা। মাসুদ দ্রুত খামটি হাতে নেয়। খাম ছিড়ে। চিঠি খোলে। চিঠি পড়তে শুরু করে-

আমার আর থাকা হলো না। কারণ শীঘ্র অপরাধের অপচ্ছায়া আমাদের মাঝে শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে যাবে। তখন পূর্বোক্ত ঘটনা তোমার জন্য ভুলে যাওয়া সহজ হবে না। তাই তোমার মুখোমুখি হতে সাহস পেলাম না। যদিও ঘটনা অনেক দিনের তবুও চাইনি- আমার অপরাধী চেহারা তোমার মুখোমুখি হোক। সত্যিই আমি তোমাকে ভালোবাসি অনেক বেশি। তবুও চলে গেলাম। আর কখনই ফিরে আসব না। শুভ হোক, কল্যাণময় হোক আমাদের এই বিচ্ছেদ।

- নাফিসা

মাসুদ দৃষ্টি ঘুরিয়ে নেয়। বিশাল গৃহটাও তার কাছে ছোট মনে হয়। যেন বন্দীসেলের চেয়েও ছোট। যে সেলে সে এতদিন ছিল। ক্ষোভে চিৎকার দিয়ে ওঠে:

-- নিশ্চয়ই সে কল্পনা প্রবণ। তাই সে ফেরারী, তার ফিরে আসা উচিৎ। কদর্যময় অতীতকে আমি বেঁধে ফেলেছি। এরপর আর কেউ ওসব নিয়ে আমাদেরকে কষ্ট দিতে পারবে না। ভয়  দেখাতে পারবে না। কেউ হিংসাও করতে পারবে না।

মাসুদ পলক ফেলে। দেখে তার পুত্র-কন্যা তারই পাশে দাঁড়িয়ে। তারা ত্রস্ত। চিন্তিত। তাদের চেহারায় পেরেশানীর ছাপ সুস্পষ্ট। তাদেরকে লক্ষ্য করে মাসুদ বলে:

-- তোমরা বসে আছো কেন? এসো তোমার মাকে খুঁজতে বেরিয়ে পড়ি। তাকে ফিরে আসতেই হবে। তাকে ফিরিয়ে আনতেই হবে...

 

[নাজিব কিলানি (১৯৩১-১৯৯৫খৃ.) আধুনিক আরবি সাহিত্যের ঝড় তোলা লেখক। তিনি একজন উপন্যাসিক হলেও আরবি ছোটগল্পে রয়েছে তার ব্যাপক অবদান। মিসর, মিসরের সামাজিকতা, সামাজিক অবৈরিতা, মানবতা, মানবিকতা, অহিংসা, বৈষম্য মুক্ত সমাজ বিনির্মাণ তার লেখার মূল অনুপ্রেরণা। অত্যাচারিত জনগোষ্ঠীর আর্ত-চিৎকার তার লেখার প্রাণশক্তি। এ গল্পটি তার মাওয়িদুনা গাদান গল্পগ্রন্থের ইনদাল আওদাহ্ শীর্ষক গল্পের অনুবাদ।]

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ