শত বছরের ঐতিহ্যবাহী নদীবন্দর সদরঘাট
মুহাম্মদ নূরে আলম:
সদরঘাট বাংলাদেশের আদি ঢাকা শহরের নদীবন্দর যাকে ঘিরে উনিশ শতকে একটি ব্যবসায়িক জনপদ গড়ে ওঠে। এই নদীবন্দরটি বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে অবস্থিত। ১৮২০ সালের দিকে সদরঘাটের পূর্বদিকে ম্যাজিস্ট্রেট ও কালেক্টরেট অফিস পর্যায়ক্রমে স্থানান্তরিত হয়। এর উত্তর দিকের এলাকাগুলো নতুন নগরকেন্দ্র হিসেবে গড়ে ওঠে। ‘ইঞ্জিনের ধস্ ধস্, বাঁশির আওয়াজ, যাত্রীর ব্যস্ততা, কুলি-হাঁকাহাঁকি’-এমন এক চিরচেনা দৃশ্যপট অহর্নিশি উৎকীর্ণ থাকে সদরঘাটে। সারাদেশ, বিশেষ করে, দক্ষিণাঞ্চলের সঙ্গে রাজধানীর নদী-কেন্দ্রিক যোগাযোগ ব্যবস্থার পরিকেন্দ্র এই সদরঘাট। প্রায় সহ¯্র বর্ষ পূর্বে যে ঢাকার নগরপত্তন হয়েছিল ’ঢক্কা’ বৃক্ষবহুল বুড়িগঙ্গা তীরে, তার সদর দরোজা ছিল সদরঘাট। সেই সদরঘাট কালপরিক্রমায় যাত্রী পরিবহনের বিবেচনায় এখন বিশ্বের অন্যতম লঞ্চ সার্ভিস স্টেশন। ট্রেন ও সড়ক যোগাযোগ মসৃণ হওয়ার পূর্বাবধি ঢাকায় গমনাগমনের মূল পথ ছিল সদরঘাট। প্রায় শতবর্ষ আগে প্যাডেল স্টিমার’ ‘মাসহুদ’ আর ‘অস্ট্রিচ’ ছিল দূরপাল্লার প্রধান জলযান। ১৯৬৭ সালে বিআইডব্লিউটিএ সদরঘাটে আধুনিক নৌ-টার্মিনাল নির্মাণ করে। এখন নিত্য নতুন বিলাসবহুল লঞ্চ নামছে প্রতিযোগিতা করে। সদরঘাটের গোড়াপত্তন কবে হয়েছে তা ইতিহাসে অনির্দিষ্ট হলেও এর বয়স প্রায় হাজার বছর বলেই মনে করেন কোনো কোনো গবেষক। মূলত জনপদ, প্রাচীন সভ্যতাগুলোর উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ নদীকে কেন্দ্র করে এবং সভ্যতার অগ্রগতিও হয়েছে নদীর গতির সঙ্গে তাল মিলিয়েই। তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পাল্টেছে অনেক কিছু। তখন নদীর পাড়ে কোনো স্থায়ী ঘাট না থাকলেও এখন সেখানে একটি টার্মিনাল গড়ে উঠেছে। আশপাশে উঠে গেছে উঁচু উঁচু সব ভবন। ফলে নদী থেকে এখন আর আগের মতো রাস্তা দেখা যায় না। তবে আগের মতোই এখনো ব্যস্ততা আছে সদরঘাটে। সাধারণ মানুষ এ নগরীকে ঢক্কা বা ঢাকা নামেই ডাকতে থাকে। নদী বিধৌত এ বাংলায় যতো দিন যায় ততোই গুরুত্বপূর্ণ নদীবন্দর হতে শুরু করে সদরঘাট। যাতায়াত, পণ্য পরিবহন আর বাণিজ্যিক স্থান হিসেবে সদরঘাট হয়ে যায় অসংখ্য মানুষের জীবন ও জীবিকার উৎস।
সদরঘাটের গোড়াপত্তন কবে হয়েছে তা ইতিহাসে অনির্দিষ্ট। তবে এর বয়স প্রায় হাজার বছর বলেই মনে করেন কোন কোন গবেষক। মূলত জনপদ, প্রাচীন সভ্যতাগুলোর উত্পত্তি ও ক্রমবিকাশ নদীকে কেন্দ্র করে এবং সভ্যতার অগ্রগতিও হয়েছে নদীর গতির সাথে তাল মিলিয়েই। নদী তীরে যেমন গড়ে উঠেছে জনপদ, গড়ে উঠেছে নগর-রাষ্ট্র, সৃষ্টি হয়েছে বাণিজ্যিক কেন্দ্র। ঢাকা নগর হিসেবে গড়ে উঠেছিল ‘ঢক্কা’ নামের বৃক্ষবহুল বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে। বুড়িগঙ্গা নদীর প্রাচীনত্বের উল্লেখ পাওয়া যায় ‘বৃদ্ধগঙ্গা’ নামের দুই হাজার বছর আগে রচিত কলিকা পুরাণে। মূল ভূখ-ের কেন্দ্রস্থলে নদীটির অবস্থান এবং সারাদেশের সঙ্গে নৌ-যোগাযোগের পথ সহজতর, নিরাপদ ও সংক্ষিপ্ত হওয়ায় প্রতিরক্ষা, প্রশাসনিক, ব্যবসা-বাণিজ্যসহ সব ধরনের রাজকীয় ও অর্থনৈতিক কর্মকা- পরিচালনার জন্য বুড়িগঙ্গা নদীর ভৌগোলিক অবস্থানগত গুরুত্ব বিবেচনা করে সেই সময়ের নগর স্থপতিরা বেছে নেন এই স্থানটি। তারা জানতেন ‘বাণিজ্যে বসতে লক্ষ্মী’। এ কারণে নগরটি মধ্যযুগের ভারতবর্ষে মর্যাদাপূর্ণ হয়ে ওঠে। ‘আকবরনামা’ গ্রন্থে ঢাকা একটি থানা বা সামরিক ফাঁড়ি হিসেবে এবং ‘আইন-ই-আকবরী গ্রন্থে সরকার বাজুহার একটি পরগনা হিসেবে ঢাকার উল্লেখ রয়েছে। ১৬১০ খ্রিস্টাব্দে ইসলাম খান চিশতি সুবাহ্ বাংলার রাজধানী রাজমহল থেকে ঢাকায় স্থানান্তর করেন এবং সম্রাটের নামানুসারে এর নামকরণ করেন জাহাঙ্গীরনগর। প্রশাসনিকভাবে জাহাঙ্গীরনগর নামটি ব্যবহৃত হলেও সাধারণ মানুষের মুখে ঢাকা নামটিই থেকে যায়। সব বিদেশি পর্যটক এবং বিদেশি কোম্পানির কর্মকর্তারাও তাদের বিবরণ এবং চিঠিপত্রে ঢাকা নামটিই ব্যবহার করেন। বুড়িগঙ্গা ও এর উৎসনদী ধলেশ্বরী অন্য বড় বড় নদীর মাধ্যমে বাংলার প্রায় সবক’টি জেলার সঙ্গে ঢাকার সংযোগ স্থাপন করেছে। ঢাকা ছিল ভাটি অঞ্চলের অন্তর্ভুক্ত। প্রাচীন ঢাকা শহরটি পুকুরতলীর (বর্তমান বাবুবাজার) সীমিত এলাকা ঘিরে গড়ে ওঠে। কিন্তু মুঘল সুবাহ রাজধানী হওয়ার পর এর পরিধি বৃদ্ধি পায়। এ সময় বুড়িগঙ্গা তীর ঘেঁষে গড়ে ওঠা শহরটি পশ্চিমের দুর্গ থেকে শুরু করে পূর্বদিকে বর্তমান সদরঘাট পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। মুঘল আমলের বহু আগেই বুড়িগঙ্গার তীরে ঢাকা শহরের গোড়াপত্তন হয়েছিল। আর সদরঘাট এলাকাটি পূর্ব থেকেই ব্যবসা বাণিজ্যের কেন্দ্রস্থল হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। এখানে নদীপথে আমদানি রফতানি ছাড়াও যাত্রীবাহী বিভিন্ন জলযান অহরহ যাতায়াত করত। ১৭৬৫ সালে বুড়িগঙ্গা নদীতীরে একটি বাঁধ নির্মাণ করা হয়েছিল। ১৮৫৭ সালের কিছুকাল পর তদানীন্তন ঢাকার বিভাগীয় কমিশনার সিটি বাক্ল্যান্ড বাঁধটি সম্প্রসারণ করে আরও পোক্তভাবে ফরাশগঞ্জ থেকে বাবুবাজার পর্যন্ত সম্প্রসারণ করেন। তখন থেকেই এই বাঁধটি ‘বাকল্যান্ড বাঁধ’ নামে পরিচিত হয়ে আসছে। আর সদরঘাট হয়ে ওঠে সবকিছুর প্রাণকেন্দ্র। বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে ১৭৬৫ খ্রিস্টাব্দে যে ঢাকার লোকসংখ্যা ছিল ৯ হাজার, কালের সাক্ষী বুড়িগঙ্গা নদীর তীরের সেই ঢাকার লোকসংখ্যা আজ প্রায় দুই কোটি। আয়তন এখন ৯০০ বর্গ কিলোমিটার ছাড়িয়ে গেছে। লোকসংখ্যা ও আয়তন বেড়েছে। আর সংকুচিত হয়ে আসছে বুড়িগঙ্গা, সদরঘাট। সদরঘাট কেন্দ্রিক ছিল এককালে মানুষের জীবন-জীবিকা। সদরঘাট নিয়ে মানুষের আবেগ ছিল অভাবনীয়। চলার পথে এখানে মিশে আছে বহু মানুষের অজস্র স্মৃতি ও প্রেম। রচিত হয়েছে গান- ‘যদি সুন্দর একখান মুখ পাইতাম, সদরঘাটের পানের খিলি তারে বানাই খাওয়াইতাম...’।
সদরঘাট বাংলাদেশ-এর আদি ঢাকা শহরের একটি নদীবন্দর যাকে ঘিরে উনিশ শতকে একটি ব্যবসায়িক জনপদ গড়ে ওঠে। এই নদীবন্দরটি বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে অবস্থিত। একবিংশ শতকের শুরুতেও এটির গুরুত্ব অক্ষুণœ রয়েছে। এর সন্নিহিত এলাকা পুরনো ঢাকা নামে প্রসিদ্ধ। এর অতি নিকটে রয়েছে পুস্তক প্রকাশনার ঘাঁটি বাংলাবাজার, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, বলধা গার্ডেন এবং আহসান মঞ্জিল এবং, সর্বোপরি, বিভিন্ন নদী পরিবাহিত পণ্য, বিশেষ করে মাছ ও ফলের সুবিশাল সব আড়ৎ। সারাদেশ, বিশেষ করে, দক্ষিণাঞ্চলের সঙ্গে ঢাকা শহরের নদীকেন্দ্রিক যোগাযোগ ব্যবস্থার পরিকেন্দ্র এই সদরঘাট। অসংখ্যা লঞ্চ ঘাটে ভীড় করে আছে। ডিঙ্গি নৌকাগুলো যাত্রী নিয়ে এপার-ওপার করছে, কুলিদের শোরগোল সব কিছু মিলে সদরঘাট এমন একটি জায়গা যা কখনো নীরব থাকে না। সদরঘাট ছাড়াও বুড়িগঙ্গা তীরের আরেক ঘাট ওয়াইজঘাট থেকেও লঞ্চ-স্টিমার ছাড়ত সেই ব্রিটিশ আমলেই। একবিংশ শতকের শুরুতেও এটির গুরুত্ব অক্ষুণœ রয়েছে। পুরান ঢাকার বাসিন্দা আজিম বখশ্ বলছিলেন, ‘ঢাকার সবচেয়ে পুরোনো এলাকা ফরাশগঞ্জ। তখনকার দিনে ঢাকার সাংস্কৃতিক কেন্দ্র ছিল এখানে। লঞ্চঘাট, নাট্যমঞ্চ, গানের দল, পাঠাগার, খেলার দল সব মিলিয়ে উৎসবমুখর পরিবেশ থাকত। সেই দিন তো আর ফিরিয়ে আনা যাবে না। তবু বর্তমান মানুষের কাছে সেই দিনগুলোর বার্তা পৌঁছে দিতে চাই আমরা। এই নদীবন্দর থেকে বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলের পটুয়াখালী, বরগুনা, ভোলা, ঝালকাঠি, হুলারহাট, মাদারীপুর, চাঁদপুর, খুলনা, হাতিয়া, বাগেরহাটসহ মোট ৪৫টি রুটে লঞ্চ ও স্টিমার চলাচল করে। মালামাল বহনকারী বার্জগুলোও সদরঘাটকে মাল ওঠানো-নামানোর কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার করে। পাশপাশি সরদঘাট ফলমূল, শাকসবজি ও বিবিধ সামগ্রীর একটি বৃহৎ দৈনিক বাজারে পরিণত হয়েছে। স্টিমার-লঞ্চ ছাড়াও ডিঙি নৌকাগুলো সদা ব্যস্ত যাত্রী নিয়ে এপার-ওপার খেয়া বাইতে। সব সময় লেগে থাকে কুলিদের শোরগোল। কয়েকশ বছরের ঐতিহ্য থাকলেও নানা অব্যবস্থাপনার কারণে এখানে আসা যাত্রীদের প্রায়শই নানা সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। আর লঞ্চ টার্মিনালের মূর্তিমান এক আতঙ্কের নাম কুলি। সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনালে কুলিদের দৌরাত্ম্য যেন অনিঃশেষ। কখনো বাড়ে কখনো কমে। যাত্রীর অনিচ্ছা সত্ত্বেও তারা মালামাল বহন করে টাকা আদায় করে। অভিযোগ রয়েছে অনেক সময় নিজের মাল নিজে বহন করেও এসব কুলিকে টাকা দিতে হয়। কোনো যাত্রী ব্যক্তিগতভাবে মালপত্র লঞ্চে নিতে চাইলে কুলিরা তাতেও বাধা দেয়। এছাড়া আগেই দরদাম ঠিক করে নিলেও লঞ্চে গিয়ে কুলিরা বেশি অর্থ দাবি করে। এছাড়াও সদরঘাট রয়েছে ফল ব্যবসায়ীদের দখলে। পাশাপাশি ছিনতাইকারী আর পকেটমারের উপদ্রব নতুন কিছুই নয়। ইতিহাস ঘেঁটে জানা যায়, বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে প্রায় সহস্র বর্ষ পূর্বে রেল ও সড়ক যোগাযোগবিহীন যে নগরীর পত্তন ঘটেছিল সেই নগরীতে প্রবেশের সদর দরজা ছিল সদরঘাট। ১৬১০ সালে ‘ঢক্কা বৃক্ষবহুল’ এ নগরীকে জাহাঙ্গীরনগর নাম দিয়ে রাজধানী ঘোষণা করেন সুবাদার ইসলাম খান। কিন্তু সে নাম কাগজে কলমেই সীমাবদ্ধ থেকে যায়। কিন্তু কালের বিবর্তনে লোহা-লক্কর আর জঞ্জালের এই ঢাকায় সদরঘাট তার জৌলুশ ধরে রাখতে পারেনি। পৌনে দুই কোটি জনসংখ্যার এই শহরে ধীরে ধীরে সদরঘাট হয়ে উঠলো অসৎ আর দালালদের আড্ডাখানা। সদরঘাট গিয়ে কুলিদের খপ্পরে বা পকেটমারের শিকার হননি এমন মানুষ খুঁজে পাওয়াই দুষ্কর । বিআইডব্লিউটিএ সূত্রে জানা গেছে, ১৯৬৭ সালে সদরঘাট নৌ-টার্মিনাল নির্মাণ করার পর থেকে টার্মিনালের ইজারার মাধ্যমে কুলি ব্যবস্থাপনা পরিচালিত হয়ে আসছিল। কুলিদের পরিশ্রমের টাকায় ভাগ বসাত ইজারাদাররা। অন্যদিকে মধ্যস্বত্বভোগী এ ইজারাদারদের যোগসাজশে টার্মিনালে নিয়মিত চুরি-ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটত। হকার, কুলি, পকেটমারের অত্যাচারে যাত্রীদের নাভিশ্বাস উঠতে শুরু হয়েছিল। এই চরম অরাজকতাপূর্ণ পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে সুষ্ঠু বন্দর ব্যবস্থাপনার উদ্যোগ নেয় বিআইডব্লিউটিএ। সদরঘাট থেকে অবৈধ কুলি ও হকার উচ্ছেদ করে যাত্রীদের উন্নত ও আধুনিক সেবা প্রদানের লক্ষ্যে টার্মিনালে 'শ্রম যার মজুরি তার' নীতিতে শ্রম ব্যবস্থাপনা চালু করা হয়। এরপর বিআইডব্লিউটিএ ৮০ জন পোর্টার (কুলি) নিয়োগ করেছে। এই পোর্টারদের কাজ হল চুক্তিভিত্তিক যাত্রীদের লাগেজ ও মালপত্র পরিবহন করা। গত শুক্রবার, ২৯ মার্চ সরেজমিনে যেয়ে দেখা যায় সদরঘাটের প্রধান গেটের পাশের দেয়ালে বড় করে লেখা আছে 'হকারমুক্ত টার্মিনাল'। আকাশি রঙের পোশাক পরে পোর্টাররা সেখানে দায়িত্ব পালন করছে। কোন যাত্রীকে সাহায্য করার প্রয়োজন হলে তারা এগিয়ে যাচ্ছেন।টার্মিনালের যাত্রী হয়রানির বিষয়ে বরগুনাগামী যাত্রী সাদেক হোসেন (৫০) বলেন, ‘আমি ২০ বছর ধরে ঢাকায় আসা-যাওয়া করি। পূর্বে লঞ্চ থেকে নামলেই কুলিরা এসে সামনে দাঁড়াতো। নিজের মাল নিজে বহন করবো বললেও তাদের হাত থেকে নিস্তার পেতাম না। তাদের দিয়েই মালামাল টানাতে হবে এবং তাদের ইচ্ছেমত টাকা দিতে হবে। মানে অনেকটা মগের মুল্লুকের মত অবস্থা ছিল। বর্তমানে সেই অবস্থা নাই। এখন নীল বাহিনী (পোর্টার) হওয়ার পর তেমন টানাটানি নেই। চাইলে নিজের মালামাল নিজে নিতে পারি। আর না পারলে ওদের ডেকে নেই। ঢাকা নদী বন্দর সূত্রে জানা গেছে, ‘যাত্রীদের নিরাপত্তা দিতে সদরঘাট টার্মিনালে ডিএমপি পুলিশ ফাঁড়ি ও নৌ পুলিশ ফাঁড়ি স্থাপন করা হয়েছে। একই সঙ্গে ৩২ জন আনসার মোতায়েন রয়েছে। লঞ্চঘাটের ১৪টি প্রবেশপথে ৩২টি সিসি ক্যামেরা ও ২২টি মাইক স্থাপন করা হয়েছে। এর মাধ্যমে পুরো টার্মিনাল মনিটরিং করা হয় এবং মাইকের মাধ্যমে প্রয়োজনে জরুরি ঘোষণা দেওয়া হয়।
মাহমুদা আক্তার নামে বরিশালের এক যাত্রী বলেন, ‘আগে এখানে দাঁড়াতে ভয় পেতাম। এখানে নেমে ডানে ব্যাগ রেখে ডানে তাকাতেই দেখতাম ব্যাগ নাই। চোর-বাটপার এখন কিছুটা কমেছে। সিসি ক্যামেরা লাগানোতে এখন কিছুটা নিশ্চিন্তে থাকা যায়।’ ঢাকা নদী বন্দরের যুগ্ম পরিচালক এ কে এম আরিফুর রহমান বলেন, ‘টার্মিনালকে হকারমুক্ত বেশ আগে ঘোষণা করা হলেও তা পুরোপুরি কার্যকর ছিল না। পূর্বে অফিসাররা যখন ভিজিটে যেতেন তখন হকাররা আগে থেকে এক ধরণের বাঁশি ফুঁ দিত এবং সব হকাররা সতর্ক হয়ে লুকিয়ে যেত। ফলে টার্মিনাল হকারদের দৌরাত্ম্য মুক্ত ছিল না। কিন্তু বর্তমানে কোনভাবেই এখানে হকার নেই। শতভাগ হকার মুক্ত। আর পোর্টার (কুলি) নিয়োগ দেয়ার পরে যাত্রীদের হয়রানী কমে গেছে বহু গুণে। টার্মিনাল পূর্বে বিভিন্ন ব্যানার পোস্টারে ভরপুর ছিল এবং পরিবেশ অত্যন্ত নোংরা ছিল। বর্তমানে সে দৃশ্য আমূল পরিবর্তন হয়ে গেছে। নৌ-পুলিশ, পুলিশ ফাঁড়ি, আনসার, পোর্টার এবং সিসি ক্যামেরা চালুর কারণে টার্মিনালে চুরি-ছিনতাই কমে গেছে। যাত্রীরা নিরাপদে চলাচল করতে পারছেন। লঞ্চ চলাচল ছাড়াও স্টিমারে করে বিভিন্ন মালামাল ও শাকসবজি পরিবহন করা হয় এ ঘাট দিয়ে। ফলে ঘাটকে কেন্দ্র করে ফলমূল, শাকসবজি ও বিবিধ সামগ্রীর একটি বৃহৎ বাজার গড়ে ওঠেছে। লঞ্চ-স্টিমার ছাড়াও এখানকার তিনটি নৌকাঘাট দিয়ে বুড়িগঙ্গা নদীর এপার-ওপার খেয়া পারাপার করা হয়। দ্রুতগতির বাস পরিবহনের এই যুগেও পটুয়াখালী, বরগুনা, ভোলা, ঝালকাঠি, মাদারীপুর, চাঁদপুর, খুলনা, হাতিয়া, বাগেরহাটসহ দক্ষিণাঞ্চলের ২২ জেলার মোট ৪৫টি নৌ-রুটে প্রতিদিন গড়ে ৮০ হাজার যাত্রী যাওয়া-আসা করেন। ঈদসহ বিশেষ উৎসব উপলক্ষে এ সংখ্যা আরও বেড়ে যায়। সদরঘাটের ২৪টি পন্টুন ও ১৪টি গ্যাংওয়ে দিয়ে দুই ঈদে প্রায় ৪০ লাখ যাত্রী যাতায়াত করেন। প্রমোদতরীর মতো অভিজাত লঞ্চগুলোতে যাতায়াতে থাকে গৃহের প্রশান্তি। এ কারণে সড়কপথে জ্যাম ও ক্লান্তিকর ভ্রমণের পরিবর্তে দক্ষিণাঞ্চলের মানুষ যাতায়াত মাধ্যম হিসেবে এখনো নৌপথকেই বেছে নেন।