বুধবার ০১ মে ২০২৪
Online Edition

নববর্ষের মেলা

আখতার হামিদ খান : বাঙালি ও বৈশাখী মেলা একই মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ। বাঙালি তার নিজস্ব জাতিসত্তার অস্তিত্বকে টিকিয়ে রাখার জন্য যতগুলো উৎসব পালন করে তার মধ্যে বৈশাখবরণ বা বাংলা সনকে বরণ অন্যতম। বৈশাখ বরণের সঙ্গে যে অনুষ্ঠানটি অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত, তা হলো আমদের ঐতিহ্যবাহী বৈশাখী মেলা। বৈশাখ মাসের পয়লা দিন যে মেলা অনুষ্ঠিত হয়, তাকেই বৈশাখী মেলা বলা হয়। পয়লা বৈশাখ উপলক্ষে যেসব অনুষ্ঠান আয়োজন করা হয়, তার মধ্যে যেমন পান্তা-ইলিশ থাকে তেমনি মেলাও বসে। এ মেলায় শুধু দুই বাংলার তরুণ-তরুণীরা অংশগ্রহণ করে না বরং যেসব মানুষ বাঙালিত্বকে হৃদয়ে লালন করে, বাঙালির কৃষ্টি-কালচার ও ঐতিহ্যকে ভালোবাসে তারা সবাই বৈশাখী মেলায় অংশগ্রহণ করে। তাই তো দেখা যায় বৈশাখী মেলায় অংশগ্রহণকারীরা সব বয়সের হয়ে থাকে।
১৫৮৬ খ্রিষ্টাব্দের ৫ নভেম্বর থেকে হিজরি, চন্দ্রাসন ও ইংরেজি সৌরসনকে ভিত্তি করে বাংলা সন প্রবর্তিত হয়। নতুন সনটি প্রথমে ফসলি সন নামে পরিচিত থাকলেও পরবর্তী সময়ে তা বঙ্গাব্দ নামে পরিচিতি পায়। তাই বলা যায়, বাংলা নববর্ষ যেহেতু সম্রাট আকবরের সময় থেকে পালন করা হতো এবং সে সময় বাংলার কৃষকেরা চৈত্র মাসের শেষ দিন পর্যন্ত জমিদার, তালুকদার এবং অন্যান্য ভূস্বামীদের খাজনা পরিশোধ করত। এ উপলক্ষে তখন মেলা ও অন্যান্য অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হতো। পরবর্তী সময়ে বৈশাখ উপলক্ষে যে মেলার আয়োজন করা হতো, সে মেলাকে ‘বৈশাখী মেলা’ নামে নামকরণ করা হয়। সুতরাং বৈশাখী মেলার সূচনার সঠিক তারিখ নির্ধারিত করা না গেলেও এ মেলা যে বাংলা বঙ্গাব্দ পালনের সূচনা থেকেই সূচিত হয়েছে তাতে সন্দেহ থাকার খুব বেশি অবকাশ নাই। বাংলা নববর্ষের মূল আকর্ষণ বৈশাখী মেলা। মূলত নতুন বছর বরণকে উৎসবমুখর করে তোলে এ মেলা। বৈশাখী মেলা মূলত সর্বজনীন লোকজ মেলা হিসেবে স্বীকৃত। এ মেলা অত্যন্ত আনন্দঘন হয়ে থাকে। উপস্থিত দর্শকদের আনন্দ দেওয়ার জন্য নানাবিধ আয়োজন করা হয়। এসব আয়োজনের মধ্যে স্থানীয় কৃষিজাত দ্রব্য কারুপণ্য, লোকশিল্পজাত পণ্য, কুটির শিল্পজাতসামগ্রী, সব রকম হস্তশিল্পজাত ও মৃৎশিল্পজাত সামগ্রী উপস্থিত করার রেওয়াজ রয়েছে। এ ছাড়া শিশু-কিশোরদের খেলনা, মহিলাদের সাজসজ্জার সামগ্রী ইত্যাদি এবং বিভিন্ন লোকজ খাদ্যদ্রব্য যেমন চিড়া, মুড়ি-মুড়কি, খই, বাতাসা ইত্যাদি বিভিন্ন প্রকার মিষ্টি প্রভৃতির বৈচিত্র্যময় খাবারের সমারোহ থাকে। মেলায় বিনোদনেরও ব্যবস্থা থাকে। বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলের লোকগায়ক ও লোক নর্তকদের উপস্থিত করা হয়। তাঁরা যাত্রা, পালাগান, কবিগান, জারিগান, গম্ভীরা গান, গাজির গানসহ বিভিন্ন ধরনের লোকসংগীত, বাউল-মারফতি-মুর্শিদি-ভাটিয়ালি ইত্যাদি বিভিন্ন আঞ্চলিক গান পরিবেশন করেন। লাইলী-মজনু, ইউসুফ-জোলেখা, রাধা-কৃষ্ণ প্রভৃতি আখ্যানও উপস্থাপিত হয়।
শিশু-কিশোরদের আকর্ষণের জন্য থাকে বায়োস্কোপ, পুতুলনাচ, নাগরদোলা। শহরাঞ্চলে নগর সংস্কৃতির আমেজে এখনো বৈশাখী মেলা বসে এবং এই মেলা বাঙালিদের কাছে এক অনাবিল আনন্দের মেলায় পরিণত হয়। বৈশাখী মেলা বাঙালির আনন্দঘন লোকায়ত সংস্কৃতির ধারক। বৈশাখবরণ উপলক্ষে এবং বিনোদন দেওয়ার মানসে বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে বৈশাখী মেলার প্রচলন আছে। তবে এমন অনেক স্থান রয়েছে, যেখানে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে বৈশাখী মেলা বসছে এবং সেসব স্থান দেশবাসীর কাছে বিশেষ মর্যাদা পেয়েছে।
বৈশাখী মেলা বসায় যেসব স্থান সবার কাছে পরিচিতি পেয়েছে তার সংখ্যাও নেহাত কম নয়। এসব বিখ্যাত স্থানের মধ্যে কয়েকটি হলো নারায়ণগঞ্জ, মুন্সিগঞ্জ, মানিকগঞ্জ, সাভার, রংপুরের পায়রাবন্দ, দিনাজপুরের ফুলছড়ি ঘাট এলাকা, মহাস্থানগড়, কুমিল্লার লাঙ্গলকোট, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, মহেশপুর, খুলনার সাতগাছি, ময়মনসিংহ-টাঙ্গাইল অঞ্চল, সিলেটের জাফলং, মণিপুর, বরিশালের ব্যাসকাঠি-বাটনাতলা, গোপালগঞ্জ, মাদারীপুর, বাগেরহাটের ষাটগম্বুজ এলাকা ইত্যাদি।
বৈশাখী মেলার প্রচলন গ্রাম থেকে শুরু হলেও এর আয়োজন এবং এতে অংশগ্রহণের ব্যাপ্তি এখন নাগরিক সমাজের মধ্যেই অধিকতর প্রবল। তাই বলে গ্রামীণ পরিম-ল থেকে তা পুরোপুরি হারিয়ে গেছে, এমনটিও বলা যাবে না। তবে বৈশিষ্ট্যগতভাবে গ্রামীণ বৈশাখী মেলা এখন যতটা না লোকজ উৎসব, তার চেয়ে অনেক বেশি অর্থনৈতিক কর্মকা- দ্বার নিয়ন্ত্রিত ব্যবসায়িক উপলক্ষ। অবশ্য ইতিবাচকভাবে দেখলে এটাও বলা যায়, বৈশাখী মেলার সঙ্গে অর্থনৈতিক কর্মকা- যুক্ত হওয়ার ফলে এর জৌলুসই শুধু বাড়েনি, ক্রমশ এর ব্যাপ্তি সম্প্রসারিত হচ্ছে। ধারণা করা চলে, তৃণমূল পর্যায়ে মানুষের দৈনন্দিন গেরস্থালির সঙ্গে নিবিড়ভাবে সম্পর্কিত এসব অর্থনৈতিক অনুষঙ্গের কারণেই হয়তো বৈশাখী মেলা দিনে দিনে আরও শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড়াতে এবং সর্বজনীনতার আরও উচ্চতর মাত্রা অর্জনে সক্ষম হবে। নববর্ষ উদ্‌যাপনের অংশ হিসেবে বর্তমানে যে বৈশাখী মেলার আয়োজন হয়ে থাকে, সেখানে উৎসবের আমেজটাই মুখ্য এবং সেটা দোষেরও কিছু নয় বরং বলা চলে, নববর্ষ উদ্‌যাপনই হচ্ছে বাঙালির সবচেয়ে বড় অসাম্প্রদায়িক ও সর্বজনীন উৎসব। ফলে এ উৎসবের জৌলুস ও ঔজ্জ্বল্য বস্তুত আমাদের জাতিগত মর্যাদার প্রতীক।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ