বুধবার ০১ মে ২০২৪
Online Edition

কুরআন এবং হাদীসের দৃষ্টিতে প্রতিবেশীর প্রতি দায়িত্ব ও কর্তব্য

আলহাজ্ব এ.কে.এম মোয়াজ্জেন হোসেন : আমরা সমাজবদ্ধ হয়ে বাস করি। মানুষকে নিজের প্রয়োজনের তাগিদেই সমাজবদ্ধ হয়ে বাস করতে হয়। নানা করণে সমাজবদ্ধভাবে বাস করে থাকি। আমাদের আশপাশের লোকদেরকে বলা হয় প্রতিবেশি। প্রতিবেশির সংজ্ঞা দিতে গিয়ে মহানবী হযরত মুহাম্মদ সা. বলেছেন- “আশপাশের ৪০ ঘর পর্যন্ত প্রতিবেশি বলে বিবেচিত হবে’’। [আলকাফি : ২/৬৬৯ হা. ১, ২. মিশকাতুল আনওয়ার : হা. ২১৪, মকাসেদো হাসানা : হা. ৩৪৯] আর এই প্রতিবেশির প্রতি আমাদের রয়েছে অনেক দায়িত্ব-কর্তব্য। রাসূলুল্লাহ সা. একাধিক হাদীসে প্রতিবেশির প্রতি দায়িত্ব ও কর্তব্যের ব্যাপারে আলোকপাত করেছেন। হযরত ইবনে আব্বাস রা.  বলেন : আমি রাসুলে পাক সা. কে বলতে শুনেছি, “যে ব্যক্তি তার প্রতিবেশীকে অভূক্ত রেখে নিজে পেটপুরে খায়, সে মুমিন নয়। ” [মিশকাত] এ হাদীসের আলোকে সুস্পষ্ট ভাবে বুঝা যাচ্ছে যে, প্রকৃত মুমিন হতে হলে, প্রতিবেশীর প্রতি দায়িত্ব পালন করতে হবে। মুসলিম শরীফের একটি হাদীসে আছে রাসূল সা. হযরত আবু জর রা. কে বলেন – “হে আবু জর! যখন তুমি সালন পাকাবে, তাতে একটু বেশি করে পানি ঢেলে দিও এবং তা দ্বারা পাড়া-প্রতিবেশীর প্রতি লক্ষ্য রেখ। ”[মুসলিম শরিফ] প্রতিবেশীর প্রতি আমাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য কতটুকু তা এ হাদীস দ্বারা প্রতীয়মান হযেছে।  প্রতিবেশীদের যাতে তরকারী দিতে পারি, সেজন্য মহানবী, দয়ার নবী রাসুল সা. বেশি ঝোল রাখতে বলেছেন। যাদের সামর্থ্য নেই তারা এমন করতে পারেন। তবে বিত্তবানগণ আরো অনেক কিছু করতে পারেন। প্রতিবেশীদের প্রতি একটু দৃষ্টি দিলে, তারা অনেক উপকৃত হবেন। হযরত আবু হুরায়রা রা. বলেন, একজন লোক নবী কারীম সা. এর নিকট আরজ করলেন, হে আল্লাহর রাসুল সা. অমুক মহিলা বেশি বেশি নফল নামাজ আদায় করে, নফল রোযা রাখে, দান-খয়রাত করে, এসব বিষয়ে সে বেশ খ্যাত। কিন্তু সে প্রতিবেশীকে মুখের দ্বারা কষ্ট দেয়। রাসুলুল্লাহ সা. তার পরিণাম সম্পর্কে বললে “সে জাহান্নামী” ঐ ব্যক্তি আবারো বলল, হে রসূল সা.। অমুক স্ত্রীলোকের সম্বন্ধে এ কথা বলা হয় যে, সে (ফরজ ও ওয়াজিব আমল পুরোপুরি আদায় করে তবে) নফল রোযা কখনো কখনো রাখে, নামায কম আদায় করে এবং পনিরের যৎসামান্য পরিমাণ দান-খয়রাত করে। কিন্তু সে মুখের দ্বারা প্রতিবেশীকে কষ্ট দেয় না। এ কি পরিমাণ হবে? উত্তরে রাসুল সা. বললেন সে জান্নাতে প্রবেশ করবে। [মিশকাত শরীফ] সুতরাং বুঝা যাচ্ছে যে, অনেক নফল ইবাদত করা সত্বেও প্রতিবেশীকে কথার দ্বারা কষ্ট দিলে তাকে জাহান্নামে যেতে হবে। আবার নফল ইবাদত কম করলেও প্রতিবেশীকে কষ্ট না দিলে, উক্ত হাদীসে বেহেশতের সুসংবাদ দেওয়া হয়েছে।
এ ব্যাপারে আমাদের সবাইকে সজাগ এবং সাবধান হওয়া খুবই জরুরি। আমাদের ঘরের সবচেয়ে নিকটস্থ প্রতিবেশীর প্রতি দায়িত্ব ও কর্তব্য সবচেয়ে বেশি। কারণ, তারা আমাদের আত্মীয়ের চেয়েও বেশি গুরুত্বপুর্ণ। আমার আপনার বিপদে তারাই সর্বপ্রথম এগিয়ে আসে, যা আত্মীয়-স্বজনের পক্ষে সম্ভব নহে। তাই এসব প্রতিবেশীর প্রতি আমাদের সুদৃষ্টি দেওয়া উচিৎ। 
হযরত আয়েশা রা. বলেন, আমি হযরত রাসুলুল্লাহ সা. কে জিজ্ঞেস করলাম ইয়া রাসুল সা. আমাদের দুজন প্রতিবেশী আছেন। আমি উপঢৌকন পাঠাতে চাই একজনের কাছে। এখন আমি কার কাছে পাঠাবো? আল্লাহর নবী, রাসুল সা. জবাবে বললেন, “ঐ প্রতিবেশীকে পাঠাবে, যা ঘর তোমার অধিক নিকটে”। [বুখারি শরীফ] উপরোক্ত হাদৈিস একথা প্রমাণিত হল, যে নিকটবর্তী প্রতিবেশীর উপর দায়িত্ব কর্তব্য অনেক বেশি। হযরত আবদুর রহমান বিন আবু কুরাদ রা. বলেন, নবী কারীম সা. ইরশাদ করেছেন, “যে ব্যক্তি আল্লাহ এবং তাঁর রাসুলকে ভালোবাসতে চায়, সে যেন কথাবার্তা বলার সময় সত্য বলে, তার কাছে আমানত রাখ হলে তা যেন যথাযথভাবে মালিকেকে পৌঁছে দেয় এবং নিজের প্রতিবেশীর সাথে যেন ভাল ব্যবহার করে।” (মিশকাত) আলোচ্য এ হাদীস দ্বারা বোঝা যায় যে প্রতিবেশীর সাথে খারাপ আচরণ করলে, আল্লাহ ও তার রাসুলের প্রতি ভালোবাসা প্রকাশ পায় না। তাই আল্লাহ এবং রাসুল সা. ভালোবাসতে হলে প্রতিবেশীকে ভালোবাসতে হবে। তাদের সাথে উত্তম আচরণ করতে হবে। হযরত উকবা বিন আমির রা. বলেন, রাসুলুল্লাহ সা. বলেছেন, “যে, দু’ব্যক্তির মুকাদ্দমা কিয়ামতের দিন সবার আগে পেশ করা হবে, তারা হবে প্রতিবেশী।” অর্থাৎ কিয়ামতের দিন মানুষের অধিকার সংক্রান্ত ব্যাপারে আল্লাহর সামনে সর্বপ্রথম এমন দু’ব্যক্তিকে হাজির করা হবে, যারা দুনিয়ায় একে অপরের প্রতিবেশী ছিল, কিন্তু তাদের পারস্পরিক দায়িত্ব তারা পালন করেনি। বরং একে অপরকে কষ্ট দিয়েছে, নিপীড়ন করেছে। ঐ দু’ব্যক্তির মামলাই সর্বপ্রথম আল্লাহর দরবারে পেশ করা হবে। প্রতিবেশীর সাথে আমাদের সুসম্পর্ক রাখতে হবে। প্রতিবেশীকে মাঝে মাঝে কিছু উপহার প্রদান করা উচিৎ। এতে দুজনের মধ্যে সম্প্রীতির সেতু বন্ধন সৃষ্টি হবে। যার যা সামর্থ আছে, সে অনুযায়ী উপহার দিতে হবে।
তবে অন্যের উপহারকে কোন বাবেই তুচ্ছ মনে করা যাবে না। এ প্রসঙ্গে হযরত আবু হুরায়রা রা. বর্ণনা করেন, নবী কারীম সা. ইরশাদ করেন, “হে মুসলিম রমনীগণ! কোন প্রতিবেশী যেন অপর প্রতিবেশীর দেয়া কোন উপঢৌকন কে তুচ্ছ মনে না করে। যদিও তা একটি বকরীর সামান্য পয়াও হয়।” [মুসলিম] প্রতিবেশীকে অন্যায়ভাবে কষ্ট দেয়াতে আল্লাহ তা’আলা অসুন্তুষ্ট হন। প্রতিবেশীদের মধ্যে ঝগড়া-বিবাদ থাকা ইসলাম কামনা করে না। বরং প্রতিবেশীরা পরস্পর সৌহার্দ ও সহমর্মিতার সাথে বসবাস করবেন, ইসলাম এটাই কামনা করে। আমরা প্রত্যেককে এক অপরের প্রতি সহযোগীতার হাত প্রসারিত না করলে, সমাজে শান্তি নষ্ট হয় যাবে। অশান্তিতে ভরে যাবে সমাজ তথা দেশ এবং সারা দুনিয়া। আমার দ্বারা আমার প্রতিবেশী যদি ভাল আচরণ না পায় তাহলে আমার ঈমানের পরিচয় কোথায়? আমার মধ্যে কতটুকু মনূষ্যত্ব আছে? প্রকৃত ঈমানদার মানুষের দ্বারা কখনো তার প্রতিবেশী কষ্ট পেতে পারে না।
এ প্রসঙ্গে হযরত আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত , রাসুলুল্লাহ সা. তাঁর পাক জবানে বলেছেন, “আল্লাহর শপথ! ঐ ব্যক্তির ঈমান নেই। প্রশ্ন করা হলো-হে আল্লাহর রাসুল! কার ঈমানন নেই। তিনি ইরশাদ করেন, “যার প্রতিবেশী তার অনিষ্ট থেকে নিরাপদ নয়”। [বোখারী শরীফ, ও মুসলিম শরীফ] উপরোক্ত আলোচনা এবং মহামূল্যবান হাদীসের বর্ননা দ্বারা একথা প্রতিয়মান হয়েছে যে, প্রতিবেশীদের সন্তুষ্টি আর অসন্তুষ্টির সাথে সৃষ্টিকর্তা আল্লাহর সন্তুষ্টি আর অসন্তুষ্টি জড়িত। অপরদিকে প্রতিবেশিকে কষ্ট যারা দেয়, তাদের জন্য জাহান্নামের হুঁশিয়ারী এসেছে। আমরা সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীব। আমরা প্রতিবেশীসহ অন্য কাউকে কোন ভাবে কষ্ট দিব না। সকলের সাথে সদ্বব্যবহার করবো। নিশ্চয় আল্লাহ সৎ পথ প্রদর্শক। 

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ