শুক্রবার ০৩ মে ২০২৪
Online Edition

প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফর

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চারদিনের সরকারি সফরে বর্তমানে ভারতের রাজধানী নয়াদিল্লিতে রয়েছেন। গত বৃহস্পতিবার দিল্লি পৌঁছানোর পর তাকে উষ্ণ সংবর্ধনা জানানো হয়েছে। অন্যদিকে সফরে যাওয়ার প্রাক্কালে ঢাকায় আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আবদুল মোনেম বলেছেন, দুই প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে অনুষ্ঠেয় বৈঠকে তিস্তা চুক্তিসহ অভিন্ন নদ-নদীর পানিবণ্টন এবং আসামের এনআরসি বা নাগরিক পরিচয়পত্রকেন্দ্রিক বাংলাদেশের উদ্বেগের কথা তুলে ধরা হবে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোনেম আরো জানিয়েছেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সফরকালে দু’দেশের মধ্যে ১০-১২টি চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হওয়ার কথা রয়েছে। মন্ত্রী অবশ্য সম্ভাব্য চুক্তিগুলো সম্পর্কে বিস্তারিত জানাতে অপারগতা প্রকাশ করেছেন। 

এদিকে অতীতের তিক্ত অভিজ্ঞতাসহ বাস্তব বিভিন্ন কারণেই প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরে বাংলাদেশ লাভবান হতে পারবে কি না সে বিষয়ে দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে যথেষ্ট সংশয়ের সৃষ্টি হয়েছে। বিশ্লেষকরা প্রসঙ্গক্রমে গত আগস্টে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এস জয়শংকর বাংলাদেশ সফরের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির আমন্ত্রণপত্র পৌঁছে দেয়ার এবং সফরের কর্মসূচি চূড়ান্ত করার উদ্দেশ্যে এসেছিলেন ড. জয়শংকর। ঢাকা ছেড়ে যাওয়ার আগেরদিন, ২১ আগস্ট এক সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সানন্দে সম্মতি জানিয়েছেন এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে ‘ফলপ্রসূ আলোচনা’ হয়েছে বলে জানানোর পাশাপশি ড. জয়শংকর বলেছিলেন, ভারত ও বাংলাদেশের সম্পর্ক খুবই  ইতিবাচক পথে রয়েছে দেখে তার ভালো লেগেছে। 

ড. জয়শংকর আরো জানিয়েছিলেন, অভিন্ন ৫৪টি নদ-নদীর পানিবন্টনের নতুন উপায় বা ফর্মুলা খুঁজে বের করতে ভারত ও বাংলাদেশ সম্মত হয়েছে, যার মাধ্যমে উভয় দেশেরই লাভ হবে। তিস্তার পানিবণ্টন প্রশ্নে ভারতের একটি অবস্থান ও প্রতিশ্রুতি আছে কথাটা স্মরণ করিয়ে দিয়ে ড. জয়শংকর বলেছিলেন, এই অবস্থান ও প্রতিশ্রুতিতে কোনো পরিবর্তন হয়নি। তাছাড়া আকাশ, সড়ক ও নৌপথের যোগাযোগ দু’দেশের প্রবৃদ্ধিতে অবদান রেখেছে বলেও মন্তব্য করেছিলেন ড. জয়শংকর। বলেছিলেন, লাভবান হওয়ার একই কারণে উভয় দেশই যোগাযোগের ক্ষেত্রে সহযোগিতা আরো বাড়াতে আগ্রহী। এই সহযোগিতাকে প্রতিবেশিদের মধ্যে অংশিদারিত্বের ‘নতুন উদাহরণ’ হিসেবে উল্লেখ করেছিলেন ড. জয়শংকর। বলেছিলেন, এটা দক্ষিণ এশিয়া এবং বিশ্বের জন্য রোল মডেলের ভূমিকা পালন করবে বলে তিনি মনে করেন। 

ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর এ ধরনের বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বর্তমান সফর উপলক্ষে আরো একবার প্রাধান্যে এসেছে তিস্তাচুক্তিসহ অভিন্ন নদ-নদীর পানি বন্টনের বিষয়টি। কারণ, রাজনৈতিক অর্থে তিস্তাচুক্তির ব্যাপারে ভারতের দিক থেকে বহু বছর ধরেই বাংলাদেশের সামনে বিরাট এক মুলা ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। সর্বশেষ ঘটনাপ্রবাহে পশ্চিম বঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের অসম্মতি ও বিরোধিতাকে চুক্তি না হওয়ার কারণ হিসেবে সামনে এনেছে ভারত। মমতা জানিয়ে চলেছেন, তার রাজ্যের কৃষি ও সেচকাজের জন্য নাকি আরো বেশি পানি দরকার। কথাটার সহজ অর্থ হলো, মুখ্যমন্ত্রী মমতাবন্দ্যোপাধ্যায় অন্তত তিস্তাচুক্তি স্বাক্ষর করতে দেবেন না। 

একই কারণে মনে করা হচ্ছে, ১০ থেকে ১২টি বা তার চাইতেও বেশিসংখ্যক চুক্তি ও সমঝোতা স্মরক স্বাক্ষরিত হলেও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এবারের সফরকালে বিশেষ করে তিস্তা চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। ঢাকাস্থ ভারতীয় দূতাবাসও এ বিষয়ে স্পষ্ট ধারণা দিয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরের প্রাক্কালে ছয় পৃষ্ঠার দীর্ঘ যে বিবৃতি দূতাবাস প্রকাশ করেছে তার কোথাও তিস্তা চুক্তি সম্পর্কে একটি শব্দেরও উল্লেখ পাওয়া যায়নি। যার অর্থ, চুক্তিটির ব্যাপারে আশান্বিত হওয়ার কোনো অবকাশ নেই।  

ওদিকে গঙ্গার পানির ন্যায্য হিস্যা থেকেও বঞ্চিত হচ্ছে বাংলাদেশ। অনেক ধুমধাম করা হলেও ১৯৯৬ সালের ডিসেম্বরে স্বাক্ষরিত ৩০ বছর মেয়াদি পানিবন্টন চুক্তিকে শুরু থেকেই অকার্যকর করে এসেছে ভারত। পরিণতিতে বাংলাদেশের বহু এলাকা মরুভূমিতে পরিণত হয়েছে। শুকিয়ে গেছে অনেক নদ-নদী ও খাল। অনেক সময় বর্ষার ভরা মৌসুমেও পদ্মার গভীরে পর্যন্ত সামান্য পানি থাকে না। এবার বন্যা ও প্রবল বর্ষণে বাংলাদেশ যখন চরম বিপন্ন অবস্থায় রয়েছে ঠিক তেমন এক সময়ে ভারত হঠাৎ ফারাক্সা বাঁধের সবগুলো গেট খুলে দিয়েছে। ফলে পদ্মার ওপর দিয়ে তো প্রবল বেগে পানি বয়ে চলেছেই নদীটির আশপাশের হাজার হাজার গ্রামও তলিয়ে গেছে। 

আমরা মনে করি, প্রধানমন্ত্রীর উচিত জাতীয় স্বার্থে আরো বলিষ্ঠ অবস্থান নেয়া এবং ‘চাহিবা মাত্র’ কেবলই সবকিছু দিয়ে দেয়ার পরিবর্তে ভারতের কাছ থেকে অভিন্ন সকল নদ-নদীর পানির প্রাপ্য হিস্যা আদায় এবং তিস্তাচুক্তি স্বাক্ষরের লক্ষ্যে প্রচেষ্টাকে জোরদারসহ সমঅধিকার অন্যান্য দাবি-দাওয়া আদায়ের চেষ্টা করা। দুই প্রতিবেশির মধ্যে সত্যিকারের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ককে নিশ্চিত ও সংহত করার স্বার্থেই এটা জরুরি এবং অত্যাবশ্যক বলে আমরা মনে করি।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ