বুয়েটের হলে ছাত্রলীগের টর্চার সেল-মিনিবার!
তোফাজ্জল হোসেন কামাল : দেশজুড়ে আলোচনায় শেরেবাংলা হলের ‘২০১১’ নম্বর রুম। একটি মাস্টার্স ও মেয়েদের হলসহ বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) যে আটটি আবাসিক হল রয়েছে, তার মধ্যে শেরেবাংলা হল একটি। এই আটটি হলের মধ্যে স্নাতক ছাত্রদের ৫টি হলেই আছে টর্চার সেল। শিক্ষার্থীদের র্যাগিং ও ভিন্ন রাজনৈতিক মতাদর্শের ছাত্রদের জন্য এসব টর্চার সেল ব্যবহার করা হতো বলে জানা গেছে। এ ছাড়াও মদ খাওয়ার জন্য রাজনৈতিক নেতাদের ব্যবহারের জন্য ছিল একাধিক কক্ষ। এসব কক্ষকে সাধারণ শিক্ষার্থীরা বার বা মিনিবার বলে আখ্যা দিয়েছেন। আর এসব হল নিয়ন্ত্রণ করতো সরকার দলীয় ছাত্র সংগঠন। তিতুমীর হল, শেরেবাংলা হল, আহসানুল্লাহ হল, এমএ রশিদ হল, সোহরাওয়ার্দী হলে পরিদর্শন ও শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে উঠে এসেছে এমন চাঞ্চল্যকর তথ্য।
মেধাবী ছাত্র আবরার ফাহাদকে শেরেবাংলা হলের ২০১১ নম্বর কক্ষে ৭ অক্টোবর রাতে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। আবাসিক শিক্ষার্থীরা জানান, ২০১১ এর মত একাধিক কক্ষ রয়েছে টর্চারের জন্য। তবে হলের ছাদেই বেশরভাগ র্যাগিং ও পেটানোর ঘটনা ঘটতো। গত এক বছরে ওই হলে তিন জন ছাত্রকে শিবির সন্দেহে মারধর ও পুলিশে দেওয়ার ঘটনা ঘটেছে। হলের নিরাপত্তা প্রহরী নুরুল ইসলাম বিষয়টি নিশ্চিত করেন।
এছাড়াও র্যাগিং ও মদ খেয়ে নেতাদের মারপিট করা ছিল নিয়মিত ব্যাপার। শিক্ষার্থীরা জানান, কিছুদিন আগে অভিজিৎ কর নামের এক ছাত্রকে চুল বড় থাকার কারণে কান ফাটিয়ে দেয়া হয়। যিনি এই কান্ড করেছেন তিনি মদ্যপ অবস্থায় ছিলেন।
শিক্ষার্থীরা জানান, শেরে বাংলা হলের ফারহান জাওয়ান এর কক্ষ নম্বর ৩০০৪। এই কক্ষকে বলা হয় মিনি বার। ২০০৪ ও ২০০৫ কক্ষকে ফুল বার বলেন শিক্ষার্থীরা। এছাড়াও মেকানিক্যাল অনুষদের ছাত্র দিহান এর কক্ষও মদের আখড়া নামে পরিচিয়। হলের ছাত্ররা জানান, মদ, গাজা ও ইয়াবা সেবন ছিল ছাত্রদের নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। এছাড়াও বহিরাগত ছাত্ররাও নেশা করার জন্য দিন-রাত আসা যাওয়া করতেন। সাধারণত ক্রিকেট স্ট্যাম্প, হকিস্টিক, ও কোমরের বেল্ট দিয়ে টর্চার করা হতো শিক্ষার্থীদের। এছাড়াও চড়-থাপ্পড় ছিল অতিসাধারণ ঘটনা। তবে কক্ষগুলো তালাবদ্ধ থাকায় ভিতরের চিত্র দেখা সম্ভব হয়নি। আবরার হত্যার পর শেরে বাংলা হলের কমপক্ষে ৫০ জন আবাসিক শিক্ষার্থী গাঁ ঢাকা দিয়েছেন বলে জানা গেছে।
এখন পর্যন্ত এই হত্যাকান্ড সংশ্লিষ্ট যতগুলো ভিডিও প্রকাশ পেয়েছে তাতে শুধুমাত্র ১৭ ব্যাচের ছাত্রদেরকে দেখা গেছে। ভিডিওতে একজনকে ১৫ ব্যাচে দেখা গেছে তা হলো মেহেদি হাসান রবিন।
সাধারণ শিক্ষার্থীরা দাবি করেন, নিহত আবরার ফাহাদ ১৭ ব্যাচের ছাত্র ছিলেন তাই একই ব্যাচের ছাত্রকে পেটানোর ঘটনা অস্বাভাবিক। হয়তো তারা লাশ বহন করেছে তবে তারা সরাসরি হত্যাকান্ডের সঙ্গে জড়িত নয়।
নাম প্রকাশ না করে এক শিক্ষার্থী জানান, এই ধরণের ঘটনা নিয়মিত ঘটতো। হল প্রভোস্ট সব জানতেন, তিনি চাইলে হত্যাকান্ডটি ঠেকাতে পারতেন।
শেরেবাংলা হল প্রভোস্ট জাফরুল্লাহ খান বলেন, আমি মাত্র ৭ মাস আগে হলের দায়িত্ব পেয়েছি। আমার এই সময় এমন কোনো ঘটনা হয়নি। শিক্ষার্থীদের অভিযোগ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, তারা আমাকে অভিযোগ করতে পারতেন। তবে হলে কোনো অভিযোগ বাক্স নাই বলেও তিনি স্বীকার করেন।
জানা গেছে, শেরেবাংলা হলের ২০১১ নম্বর কক্ষে থাকতেন বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের আইনবিষয়ক উপসম্পাদক ও সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ছাত্র অমিত সাহা, উপদপ্তর সম্পাদক ও কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ছাত্র মুজতাবা রাফিদ, সমাজসেবা বিষয়ক উপসম্পাদক ও বায়োমেডিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ছাত্র ইফতি মোশারফ ওরফে সকাল এবং প্রত্যয় মুবিন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক শিক্ষার্থী জানান, এটি ছিল হল শাখা ছাত্রলীগের ঘোষিত টর্চার সেল। একটু ব্যতিক্রম হলে শেখানোর নাম করে জুনিয়রদের র্যাগ দেওয়া হতো।
এই কক্ষ থেকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা আলামত হিসেবে স্ট্যাম্প, চাপাতি ও মদের বোতল উদ্ধার করেছেন। মদ্যপ অবস্থায় অনিক সরকার সবচেয়ে বেশি পেটায় আবরার ফাহাদকে।
শিক্ষার্থীরা জানান, ২০১৮ সালের মাঝামাঝি সময়ে ১৭ ব্যাচের ছাত্র সাখওয়াত অভিকে জোরপূর্বক সমাবেশে যেতে বাধ্য করেন ছাত্রলীগ নেতা অমিত সাহা। সমাবেশে যেতে দেরি করলে অমিত তাকে প্রহার করলে হাত ভেঙে যায়। আঘাতে হাত ভাঙলেও তাকে বলতে বাধ্য করা হয়- সিঁড়ি থেকে পড়ে হাত ভেঙেছে।
এরকম নির্যাতন চললেও শিক্ষার্থীরা কেউ ভয়ে প্রতিবাদ করেনি। কারণ বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক মেহেদী হাসান রাসেল এই হলের ছাত্র হওয়ায় সবকিছুই নিয়ন্ত্রণ ছিল তার হাতে।
হলে যে এরকম ঘটনা চলতো তা হল প্রশাসনের পোস্টারিংয়ে প্রমাণ পাওয়া যায়। র্যাগিংকে অপরাধ হিসেবে উল্লেখ করে হল প্রাধ্যক্ষের নম্বর দিয়ে ডিজিটাল ব্যানারও টাঙানো হয়েছে হল প্রাঙ্গণে।
আবরার বুয়েটের তড়িৎ ও ইলেকট্রনিক প্রকৌশল বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের (১৭তম ব্যাচ) ছাত্র ছিলেন। তিনি থাকতেন বুয়েটের শেরে বাংলা হলের নিচতলায় ১০১১ নম্বর কক্ষে। রোববার রাতে আবরারকে পিটিয়ে হত্যা করেন বুয়েট ছাত্রলীগের একদল নেতা-কর্মী।
সোমবার রাতে আবরার হত্যার ঘটনায় ১৯ জনকে আসামী করে তাঁর বাবা বরকত উল্লাহ ঢাকার চকবাজার থানায় মামলা করেন। আটক ১০ জনকে মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয় বলে জানিয়েছেন লালবাগ বিভাগের উপকমিশনার মুনতাসিরুল ইসলাম।
বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে সাম্প্রতিক কিছু চুক্তির সমালোচনা করে ফেসবুকে আবরারের কিছু স্ট্যাটাস এই হত্যার কারণ বলে সোমবার দিনভর বুয়েটের ক্যাম্পাসে আলোচনা ছিল। এ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপক আলোচনা চলছে।
হলের শিক্ষার্থী ও একাধিক প্রত্যক্ষদর্শীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, আবরারের বাড়ি কুষ্টিয়ায়। রোববার বিকেলে তিনি বাড়ি থেকে বুয়েটের হলে ফেরেন। কয়েক ঘণ্টার মাথায় রাত আটটার দিকে আবরারসহ দ্বিতীয় বর্ষের সাত-আটজন ছাত্রকে শেরেবাংলা হলের দোতলার ২০১১ নম্বর কক্ষে ডেকে পাঠান তৃতীয় বর্ষে অধ্যয়নরত বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সাত-আটজন নেতা। তাঁরা আবরার ফাহাদের মুঠোফোন নিয়ে ফেসবুক ও মেসেঞ্জার ঘেঁটে দেখেন। এরপর ক্রিকেট স্টাম্প দিয়ে আবরারকে পেটাতে শুরু করেন। কিছুক্ষণ পর চতুর্থ বর্ষে অধ্যয়নরত বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের আরও কয়েকজন নেতা-কর্মী আসেন। তাঁরা আরেক দফা পেটান আবরারকে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন প্রত্যক্ষদর্শী বলেন, পেটানোর একপর্যায়ে আবরার নিস্তেজ হয়ে পড়েন। তখন ছাত্রলীগের নেতারা আবরারের হলের সহপাঠীদের ডেকে আনেন এবং তাঁদের দিয়ে নিথর দেহটি দোতলা ও নিচতলার মাঝামাঝি সিঁড়িতে নিয়ে রাখেন। এরপর ছাত্রলীগের নেতারা বাইরে যান রাতের খাবার খেতে। পরে যখন নিশ্চিত হলো আবরার বেঁচে নেই, তখন সিঁড়ি থেকে লাশ নিয়ে রাখা হয় হলের ক্যানটিনে। ভোরে নেয়া হয় ঢাকা মেডিকেল কলেজের মর্গে।