বুধবার ০১ মে ২০২৪
Online Edition

ফি ধরলে বিপদ বাড়বে

ড. রেজোয়ান সিদ্দিকী : করোনা ভাইরাস পরিস্থিতি মোকাবিলায় সরকার যে একেবারে দিশেহারা হয়ে পড়েছে সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নাই। আজ এই সিদ্ধান্ত নেয় তো, কাল তা পরিবর্তন করে। সকালে সিদ্ধান্ত নেয়। দুপুরে বদলায়। আবার দুপুরে যে সিদ্ধান্ত নেয় রাতে তা ঠিক থাকে না। কখনও মনে হয়, সরকার চাইছে সত্য প্রকাশ হোক। কিন্তু সত্য প্রকাশ হলে দেখা যায়, সরকার ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর ঘাড় মটকে দেবার চেষ্টা করছে। একবার বলছে, ডাইনে যাও, আবার বলছে বামে। কখনও বলছে, করোনা রোগী শনাক্ত করার জন্য বাড়ি বাড়ি লকডাউন হবে। কখনও সিদ্ধান্ত নিচ্ছে লকডাউন হবে এলাকায় এলাকায়। 

এই যেমন ধরা যাক, লকডাউন হয়ে গেলো পূর্ব রাজাবাজারে। কত কা-ই না সেখানে ঘটেছে। আর এসব করার জন্য এখানে যাদের স্বেচ্ছাসেবী নিয়োগ করা হয়েছিল তারাও কেউ কেউ টুপাইস কামিয়ে নেয়ার চেষ্টা করেছে। করেছে চাঁদাবাজিও। চাঁদা দিয়ে লকডাউন এলাকায় ঢোকার চেষ্টা হয়েছে। যাদের শাক-সবজি বিক্রি করার অনুমোদন দেয়া হয়েছিল, তারাও শিকার হয়েছেন এমন বিরূপ পরিস্থিতির। কিন্তু এখন কী হবে? পূর্ব রাজাবাজারে লকডাউন তো শেষ। এই ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে গোটা এলাকা আবার স্বাভাবিক হয়ে গেছে। ব্যারিকেড ডিঙিয়ে পুলিশ বা আনসারদের চোখ ফাঁকি দিয়ে অনেকেই আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে ঢুকেছে। প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র দিয়ে ফিরে গেছে। এটাই বোধ হয় স্বাভাবিক। 

কিন্তু এখন! এখন লকডাউন নেই। মানুষের আনাগোনা আগের মতো শুরু হয়েছে। কোভিড রোগীও বাজার করতে  এসেছেন এবং আসছেন। যারা অফিসে যাচ্ছিলেন না, তারা অফিসে যেতে শুরু করেছেন। যারা অন্য কোনো পথে জীবিকা উপার্জন করেন, তারাও জীবিকার ধান্ধায় রাস্তায় বের হয়ে গেছেন। সকালে বের হচ্ছেন। রাতে ঘরে ফিরছেন। সারাদিন বহু মানুষের সঙ্গে মিশছেন। কোনো কোভিড রোগীর সংস্পর্শে আসছেন না তো? এলে তো ফের পূর্ব রাজাবাজার এলাকায় রোগ ছড়িয়ে পড়বে। 

এখন নতুন করে লকডাউন দেয়া হচ্ছে ওয়ারি এলাকায়। সরকার স্বীকার করেছে, এর সবই পরীক্ষামূলক। বাংলাদেশের মানুষের উপর আর কত পরীক্ষা চলবে? এই রোগের মহামারি শুরু হওয়ার পর থেকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা থেকে শুরু করে দেশের বিশেষজ্ঞরা অবিরাম একটি কথাই বলে আসছেন। তা হলো, টেস্ট, টেস্ট আর টেস্ট। পরীক্ষা করো। কোভিড রোগী শনাক্ত করো। দ্রুত তাদের কোয়ারেন্টাইনে পাঠাও। কিংবা রাখো আলাদা করে। এই ব্যবস্থাটা লাঠি দিয়ে পিটিয়ে হবে না। কিন্তু এই কায়দাটাই সরকার জানে ভাল। মনে করে, অর্ডার দিয়ে দিলাম, কিছু আওয়ামী গু-াপা-া লেলিয়ে দিলাম। চাঁদাবাজি ধুমছে চলল। ধুমছে বললাম, সফল হয়েছি, সফল হয়েছি। আর সফল হয়ে গেলাম। 

পৃথিবীতে কোভিড-১৯ নিয়ন্ত্রণে যারা সফল হয়েছে, তারা সবাই যে কাজটি করেছে, তা হলো, টেস্ট, আইসোলেশন, মাস্ক ও সামাজিক দূরত্ব। শিক্ষিত, সচেতন মানুষের এতে কোনো অসুবিধা হয়নি। সরকার লকডাউন দিয়ে কোভিডে আক্রান্ত লোকদের সম্পূর্ণ পৃথক করে ফেলেছে। পাঠিয়ে দিয়েছে আইসোলেশনে। হাসপাতালগুলো রেডি থেকেছে। যার হাসপাতাল প্রয়োজন তাকে হাসপাতালে নেয়া হয়েছে। দেশ বা শহরের সঙ্গে বহির্বিশ্বের যোগাযোগ সম্পূর্ণ বন্ধ করে দিয়েছে। যানবাহন বন্ধ। বিমান যোগাযোগ বন্ধ। যে যেখানে আছো, স্থির থাকো। বাইরের সংযোগ চলবে না। 

তারপর কোভিড-১৯ আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসা করা হয়েছে। ১৪ দিন আইসোলেশনে থেকে অধিকাংশ রোগীই সুস্থ হয়ে গেছেন। এভাবে এক সময় গোটা দেশ করোনামুক্ত হয়েছে। চীন ও নিউজিল্যান্ড নিজেদের করোনামুক্ত ঘোষণা করেছিল। কিন্তু কোন ফাঁকে চীনে ফের পাওয়া গেল ১৪ জন করোনা রোগী। নিউজিল্যান্ডে ২ জন। আবারও পূর্বের ব্যবস্থা। চীন এখনও শঙ্কামুক্ত নয়। নিউজিল্যান্ড নজরদারি বাড়িয়েছে। 

দেশ হিসেবে এরা দরিদ্র নয়। ফলে কারো ঘর থেকে বের হবার প্রয়োজন হয়নি। সরকার লাখে লাখে লোককে পরীক্ষা করেছে, কোভিড আছে কি নেই। আমরা সবসময় ফালাফালি করি। এই সিঙ্গাপুরকে ছাড়িয়ে গেছি। এই যুক্তরাষ্ট্রকে ছাড়িয়ে গেছি। এই আমাদের মৃত্যুহার অনেক কম। কিন্তু এখানেও সত্য অনেক পেছনে পড়ে গেছে। এই যে বিপন্ন মানুষ তিনটা, চারটা, পাঁচটা হাসপাতালে ঘুরে ঘুরে শেষ পর্যন্ত কোথাও ভর্তি হতে পারেনি। এসব হাসপাতাল, সরকারি বা বেসরকারি, তাদের চিকিৎসা দিতে অস্বীকার করেছে। অ্যাম্বুলেন্সে মারা গেছে বহু মানুষ। তার মধ্যে চিকিৎসক আছে। সাংবাদিক আছেন। সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা আছেন। ডাক্তার কন্যার পিতা আছেন। হাসপাতালের মালিক আছেন। 

একেকটা মৃত্যুর ঘটনার পর আমরা সরকারের উচ্চমহলের হুঙ্কার শুনেছি। কোনো হাসপাতাল যদি রোগী ফিরিয়ে দেয়, তাহলে তার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে। কিন্তু গত চার মাসে একটি কঠোর ব্যবস্থারও নিদর্শন দেখিনি।  যুক্তিটা অদ্ভুত। তুমি কোভিড পজেটিভ হলে তোমার প্রবেশ নিষেধ। কেন? কোভিড পজেটিভ রোগীর জন্য তো থাকার কথা বেড। তাদের দেখভালের জন্যও তো থাকার কথা ডাক্তার নার্স। কিন্তু এমন অভিযোগ শত শত যে কোভিড ইউনিটে ১৫ দিন ভর্তি থেকেও কোনো ডাক্তার নার্সের দেখা পাননি রোগী। হঠাৎ কখনও কোনো বয় উঁকি দিয়ে চলে গেছে। কোথাও কোথাও তাদের যে খাবার দেয়া হয়েছে তা পুরোই অখাদ্য। ফলে দেখা গেছে শের-এ বাংলা চিকিৎসা মহাবিদ্যালয়ে করোনা আক্রান্ত রোগীরা নিজেরাই রুটি কলা কিনতে দোকানে দোকানে ঘুরেছেন। জানি না এরা আরও কত মানুষকে সংক্রমিত করতে বাধ্য হয়েছেন। কিন্তু সরকার কারো বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থাই নেননি। আর বগি-আওয়াজ শুনেছি, কিন্তু কোনো ব্যবস্থা দেখিনি। 

বিশ্বব্যাপী কোভিড মহামারি দেখা দেয়ার পরও বাংলাদেশ বিমান সীমান্ত উন্মুক্ত রেখেছিল। করোনা আক্রান্ত দেশ থেকে বিমান ভর্তি করে বাংলাদেশে এসেছে। তাদের কোয়ারেন্টাইনে রাখা সম্ভব হয়নি। দ্রুতই তারা নিজগ্রামে চলে গেছে। আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব, চায়ের দোকানে আড্ডা দিয়েছে। আর একজন থেকে আর একজনে করোনা ছড়িয়েছে। এখন টেস্ট বেড়েছে। সেই হারে পজেটিভও বেড়েছে। যদিও সরকারের ভাষ্য কেউ বিশ্বাস করতে চায় না। কোনো ভাষ্যই না।

এদেশের মানুষ দরিদ্র। পাঁচ কোটি ৩০ লাখেরও বেশী মানুষ দিন আনে দিন খায়। কেউ রিকশা চালায়। কেউ সিএনজি চালায়। কেউ হকার। কেউ মুটে মজুর। বাসাবাড়িতে কাজ করে জীবিকা নিত্যউপার্জন করে হাজার হাজার নারী। নিম্নমধ্যবিত্তও বিপন্ন হয়ে পড়ে। সরকার ছুটি ঘোষণা করায় কলকারখানা অফিস আদালত বন্ধ হয়ে যায়। বন্ধ হয়ে যায় দোকানপাট। ফলে সর্বত্র অভাব, অনাহার। সরকার চাল-ডাল দেয়ার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু চাটার দল অধিকাংশই খেয়ে ফেলেছে। সরকার আড়াই হাজার করে টাকা দেয়ার উদ্যোগ নিয়েছিল। সে টাকা আত্মসাতের ধুম পড়ে গিয়েছিল। এখনও প্রতিদিন দুই জন না দুই একজন আত্মসাৎকারী গ্রেফতার হচ্ছেই। সেই তালিকায় নাম ওঠাতে ব্যর্থ হয়েছে বহু দুস্থ মানুষ।

পেটের দায় বড় দায়! ক্ষুধা মানুষকে হিংস্রও করে তুলতে পারে। ফলে লকডাউন-ফকডাউন উপেক্ষা করে, সামাজিক দূরত্বের বিধার লঙ্ঘন করে জীবিকার ধান্ধায় মানুষ ঘর থেকে বেরিয়ে পড়েছে। বেরিয়েই যখন পড়েছে, তখন সরকারের আর কী দায়! কলকারখানা, গার্মেন্টস খুলে দাও। অফিস, আদালত সীমিত পর্যায়ে চালু করো। দোকানপাট, শপিংমল খোলো। দু’দিন আগে খবর দেখলাম সরকার কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকত ভ্রমণ-পিপাসুদের জন্য উন্মুক্ত করে দিয়েছে। যেখানে ইউরোপ আমেরিকার অনেক রাষ্ট্র রাজ্য এখনও তা কল্পনাও করতে পারছে না। মানুষের দারিদ্র বাড়ছেই। তিন কোটিও বেশী মানুষ নতুন করে দরিদ্র হয়েছে। 

এখন লোকে কোভিডের উপসর্গ আড়াল করতে শুরু করেছে। প্রথমদিকে কারো ফ্ল্যাটে করোনা রোগীর অস্তিত্ব পাওয়া গেলে কেউ না কেউ তা সরকার বা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে জানাতো। এখন তা সবাই চেপে যেতে শুরু করেছে। পাঁচ-সাত তলা ভবনের সকল লোক আক্রান্ত হলেও কেউ কারো কথা কাউকে বলে দেয় না। আগে করোনা পরীক্ষা সরকারি কেন্দ্রগুলোতে বিনামূল্যে করা হতো। সে সময় মানুষ দীর্ঘ লাইন দিয়ে করোনা পরীক্ষা করিয়েছে। সেটা তো একটা পজেটিভ দিক। 

কিন্তু এখন হঠাৎ করেই, কার বুদ্ধিতে জানি না, সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, করোনা রোগীদের পরীক্ষা আর বিনামূল্যে করা হবে না। এখন করোনা পরীক্ষা করাতে ২০০ ও ৫০০ টাকার ফি দিতে হবে। নাম লিখিয়ে লাইনে দাঁড়িয়ে করোনা টেস্ট করালে ২০০ টাকা। বাসায় গিয়ে স্যাম্পল আনলে ৫০০ টাকা। চাকরিহীন, কর্মহীন, উপার্জনহীন, এই দুর্দিনে একজন দরিদ্র সাধারণ মানুষের কাছে ২০০ বা ৫০০ টাকা কত মূল্যবান সেটা ব্যাঙ্ক থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা হাওয়া করা লোকেরা উপলব্ধি করতে পারবেন না। 

যারা কালো টাকার পাহাড় বানিয়েছেন, তারা সাধারণত সেটা টাকা বিদেশে পাচার করেন। বিভিন্ন দেশে গড়ে তুলেছেন ‘বেগম পল্লী’। বেগমরা সেখানে থাকেন। সাহেব থাকেন বাংলাদেশে। লুণ্ঠনের মওকা খোঁজেন। তারাই সরকারের প্রিয়ভাজন। কালো টাকাঅলারা সরকারের আপনজন। শেয়ার বাজারে এক বছর ফেলে রাখলে কালো টাকা সাদা হয়ে যাবে। হারাম টাকা হবে হালাল। সরকারও কোভিড-১৯ নিয়ন্ত্রণের জন্য কয়েক হাজার কোটি টাকা খরচ করছে। কিন্তু সেখানেও ঘটছে ব্যাপক দুর্নীতি। মাস্কে দুর্নীতি। পিপিইতে দুর্নীতি। ওষুধে দুর্নীতি। পরীক্ষা-নিরীক্ষায় দুর্নীতি। তারপরেও কেনো গরীব মানুষের কাছ থেকে এই দুর্দিনে মাত্র ২০০ টাকা নিতে হবে। সরকার ঘনিষ্ঠ বিশেষজ্ঞরাও বলছেন, রোগ প্রতিরোধের পন্থা হলো পরীক্ষা বাড়াতে হবে। এতে চিকিৎসা ব্যয় কমবে। কিন্তু পরীক্ষায় ফি নির্ধারণ করে সরকার রোগ নির্ধারণের ক্ষেত্রে আসলে প্রতিবন্ধকতাই সৃষ্টি করলো। একটি দরিদ্র পরিবারের ৫ জন সদস্যের কোভিড পরীক্ষায় ১০০০ ঊর্ধ্বে ২৫০০ টাকা । এ টাকা তার নাই। রোগ বহুগুণে ছড়িয়ে পড়বে। সর্বনাশ হয়ে যাবে মানুষের, দেশের।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ