সোমবার ০৬ মে ২০২৪
Online Edition

বৈশ্বিক মন্দার প্রতিধ্বনি

ইবনে নূরুল হুদা : চলতি দশকে বিশ্ব অর্থনীতিতে নি¤œমুখীভাব লক্ষ্য করা গেছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে শোনা যাচ্ছে মন্দার প্রতিধ্বনি। মূলত, করোনা মহামারির নেতিবাচক প্রভাব ও ইউক্রেনে রাশিয়ান আগ্রাসন বিশ্ব অর্থনীতিতে গোদের ওপর বিষফোঁড়া হয়ে দেখা দিয়েছে। ফলে বিশ্ব অর্থনীতির বৃত্ত এখন ক্রমেই সংকোচিত হতে শুরু করেছে। আর এর গন্তব্য কোথায় তা এখনই নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না। এই অবস্থা কাটিয়ে ওঠার জন্য বিশ্ব নেতারা জোরদার প্রচেষ্টা চালালেও একের পর এক নতুন নতুন সমস্যা সৃষ্টি হওয়ায় তা কোনভাবেই সফল হতে পারছে না বরং পরিস্থিতির উত্তরোত্তর অবনতিই ঘটছে। 

অর্থনীতির পরিভাষায় দীর্ঘ সময় ধরে অর্থনৈতিক কার্যকলাপের ধীরগতি অথবা বাণিজ্যিক আবর্তন-এর সংকোচনকে মন্দা বলা হয়। মন্দার সময় বড় অর্থনৈতিক সূচকগুলোর ধরন একই রকম থাকে। মন্দার সময় জাতীয় গড় আয় (গ্রস ডোমেস্টিক প্রোডাক্ট বা এউচ), চাকরি, বিনিয়োগ সংক্রান্ত ব্যয়, উৎপাদন ক্ষমতার ব্যবহার, পারিবারিক আয়, ব্যবসায়িক লাভ-এ সব কিছুই ব্যাপকভাবে হ্রাস পায়; ঘটে মুদ্রাস্ফীতি। এই সময় দেউলিয়াত্ব  এবং বেকারত্বের হার বেড়ে যায়। ফলে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রা। 

মূলত, করোনা মহামারিই নেতিবাচক প্রভাবই বৈশি^ক মন্দার অন্যতম প্রধান অনুঘটক। তার সাথে যুক্ত হয়েছে ইউক্রেন-রাশিয়ার সামরিক সংঘাত। অবশ্য করোনা মহামারির ধাক্কা কাটিয়ে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে  বৈশ্বিক অর্থনীতি। এতে কিছুটা ইতিবাচক ধারা লক্ষ্য করা গেলেও এর মধ্যেই শুরু হয়েছে ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ। চলমান এই যুদ্ধ সংক্ষিপ্ত হবে বলে ধারণা করা হলেও দীর্ঘ ২ মাস পরেও তা বন্ধের কোন লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না বরং পরিস্থিতি ক্রমেই জটিল হতে জটিলতর হচ্ছে। সর্বপরি মস্কোর ঘাড়ে চেপেছে বিভিন্ন ধরনের নিষেধাজ্ঞা। আর এ নিষেধাজ্ঞারার ধারা আরও বিস্তৃত হচ্ছে। এ ছাড়া চীনের ‘করোনা শূন্য’ নীতি, মুদ্রাস্ফীতি ও যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভের সুদের হার বৃদ্ধি অর্থনীতিকে আরও বিপাকে ফেলেছে। এমন পরিস্থিতিতে প্রশ্ন উঠেছে, বিশ্ব কি আরেকটি অর্থনৈতিক মন্দার মুখে পড়তে যাচ্ছে ? আর বিষয়টি আন্তর্জাতিক বোদ্ধামহলের কপালে রীতিমত ভাঁজ ফেলে দিয়েছে। 

বিষয়টিকে মহল বিশেষে নানাভাবে ব্যাখ্যা করা হলেও এ বিষয়ে এখনো কোন উপসংহারে পৌঁছা সম্ভব হয়নি বরং যতই দিন যাচ্ছে ততই বিষয়টি নিয়ে নতুন নতুন বিতর্ক সৃষ্টি হচ্ছে; আসছে পরস্পর বিরোধী  বক্তব্যও। এমতাবস্থায় বিশ্বে মন্দা দেখা দেবে কি না বা আগামী দিনে  বিশ্ব অর্থনীতির গতি-প্রকৃতি কী হবে তা অনুমান করা খুবই কঠিন বলে মন্তব্য করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের জর্জ ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক টারা সিনক্লেয়ার। তিনি আলজাজিরাকে বলেছেন, ‘বিষয়টি আসলে খুবই জটিল। তাই বিষয়টি নিয়ে ধোঁয়াসা কাটছে না। এমনকি অর্থনীতি নিয়ে যাঁরা পূর্বাভাস দেন, তাঁরাও আগেভাগে মন্দার বিষয়ে তেমন কিছু বলতে পারেন না। শুধু মন্দা দেখা দিলেই তা বোঝা যায়। তবে অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, বিশ্ব অর্থনীতির একটা ক্রান্তিকাল শুরু হয়েছে। আর ইউক্রেন যুদ্ধে সে পালেই হাওয়া দিচ্ছে। অবশ্য নানা কারণেই বিশ্ব অর্থনীতির সূচক এখন রীতিমত নিম্নমুখী। শুধু তাই নয়; মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতিও এ থেকে মুক্ত থাকতে পারেনি। প্রাপ্ত তথ্যমতে, যুক্তরাষ্ট্রে গত চার দশকের মধ্যে এই মুহূর্তে মুদ্রাস্ফীতি সর্বোচ্চ পর্যায়ে রয়েছে। পরিস্থিতি সামাল দিতে কাজ করছে দেশটির ফেডারেল রিজার্ভ। মন্দা এড়াতে সুদের হার ধীরে ধীরে বাড়াচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকটি। কিন্তু এখন পর্যন্ত এ বিষয়ে কোন সুখবর নেই।

বিশ্বের বৃহত্তর অর্থনীতির এই দেশের এমন নাজুক পরিস্থিতি সারা বিশ্বের ওপর প্রভাব ফেলতে পারে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। এতে করে  বৈশ্বিক অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি কমতে পারে। মাত্র দুই বছর আগেই করোনার কারণে বৈশ্বিক অর্থনীতি ৪ দশমিক ৩ শতাংশ সংকুচিত হয়েছিল। অর্থনৈতিক এমন টানাপড়েনের মধ্যে গত মাসেই মন্দা নিয়ে সতর্কবার্তা দিয়েছিলেন নিউইয়র্কের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংকের সাবেক প্রেসিডেন্ট বিল ডুডলে। ফেডারেল রিজার্ভ মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে নীতিমালা কঠোর করতে বেশি সময় নিচ্ছে বলে মনে করছেন তিনি। বিল ডুডলে বলেন, অর্থনৈতিক মন্দা ‘অবশ্যম্ভাবিই’ মনে করা হচ্ছে। মুদ্রাস্ফীতি নিয়ে ফেডারেল রিজার্ভের গড়িমসির বিষয়ে বিল ডুডলের সঙ্গে অনেকটাই একমত যুক্তরাষ্ট্রের ডিউক ইউনিভার্সিটির ফুকুয়া স্কুল অব বিজনেসের অধ্যাপক ক্যাম্পবেল আর হারভি। আর্থিক মন্দার ঝুঁকি রয়েছে বলে আশঙ্কা করছেন তিনিও। হারভির ভাষায়, ‘তারা (ফেডারেল রিজার্ভ) কঠিন সমস্যার মধ্যে পড়েছে। আর তারা কি এ নিয়ে খুব দেরি করে ফেলেছে?’ কিন্তু এ প্রশ্নের এখন পর্যন্ত কোন সদুত্তর পাওয়া যাচ্ছে না। 

এমনকি মন্দার আশঙ্কা করছেন মার্কিনরাও। গত মাসেই মার্কিন সংবাদমাধ্যম সিএনবিসি একটি জনমত জরিপ চালিয়েছে।  এতে দেখা যায়, দেশটির ৮১ শতাংশ প্রাপ্ত বয়স্ক মনে করেন, ২০২২ সালে আর্থিক মন্দার ঝুঁকি রয়েছে। তবে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক বহুজাতিক বিনিয়োগকারী ব্যাংক ও আর্থিক সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান গোল্ডম্যান স্যাকসের অর্থনীতিবিদেরা বলছেন, আগামী বছর যুক্তরাষ্ট্রে মন্দার আশঙ্কা ২০ থেকে ৩৫ শতাংশ। কিন্তু এই বক্তব্যের সাথে অনেকেই একমত হতে পারছেন না।

এদিকে সামনের মাসগুলোতে রাশিয়া-ইউক্রেন সংঘাত ঘিরে উত্তেজনা বাড়লে এবং মস্কোর ওপর আরও নিষেধাজ্ঞা আসলে, বিশ্বে অর্থনৈতিক মন্দার ঝুঁকি বাড়তে পারে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদেরা। রাশিয়া থেকে এর মধ্যেই জ্বালানি তেল ও গ্যাস আমদানি বন্ধ করেছে যুক্তরাষ্ট্র। ইউরোপও রাশিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা দিচ্ছে। ফলে আগামী দিনে পরিস্থিতি আরও জটিল থেকে জটিলতর হবে বলে মনে করা হচ্ছে।

এখন পর্যন্ত রাশিয়া থেকে কয়লা আমদানি বন্ধ করেছে ইউরোপের দেশগুলো। তেল ও গ্যাস আমদানি বন্ধের জন্যও তাদের প্রতি আহ্বান জানানো হচ্ছে। ইউরোপের মোট গ্যাসের ৪০ শতাংশ আমদানি করা হয় রাশিয়া থেকে। আর তেল আমদানি করা হয় ইউরোপের মোট চাহিদার এক-তৃতীয়াংশ। সপ্তাহ খানেক আগে ইউরোপীয় কাউন্সিলের প্রেসিডেন্ট চার্লস মাইকেল ইউরোপিয়ান পার্লামেন্টে বলেছেন, তিনি বিশ্বাস করেন রাশিয়ার তেল ও গ্যাস নিয়ে ‘আগে হোক কিংবা পরে’ পদক্ষেপ নেওয়া হবে। আর এমনটি হলে জ্বালানির দাম বাড়বে। তাল মিলিয়ে বাড়বে পণ্যের দামও। ফলে বৈশি^ক মন্দা অবশ্যম্ভাবী হয়ে উঠতে পারে।

এদিকে করোনা সামাল দিতে চীনের কঠোর লকডাউন ও সীমান্ত নিয়ন্ত্রণ দেশটির অভ্যন্তরীণ ও বৈশ্বিক ব্যবসা-বাণিজ্যে প্রভাব ফেলছে। সাংহাইয়ে বিশ্বের সবচেয়ে ব্যস্ততম বন্দর রয়েছে। গত তিন সপ্তাহের বেশি সময় ধরে এই বন্দর লকডাউনের আওতায় রয়েছে। মালামাল খালাসের অপেক্ষায় কয়েক সপ্তাহ ধরে সেখানে আটকা পড়ে আছে শত শত জাহাজ। 

প্রাপ্ত তথ্যমতে, চলতি বছরে চীনের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ৫ দশমিক ৫ শতাংশ। তবে এই লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের সম্ভাবনা কম বলে মনে করছেন হংকং ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজির চীনা অর্থনীতি বিশেষজ্ঞ কার্সটেন হলজ। আল-জাজিরাকে কার্সটেন হলজ বলেছেন, ‘মনে হচ্ছে চীন করোনাহীন অবস্থায় সহজে ফিরে যেতে পারবে না। ফলে সরবরাহ ব্যবস্থার ওপর প্রভাব পড়বে। বাড়বে জিনিসপত্রের দাম। সব মিলিয়ে সুদের হার বেড়ে যাওয়ায় পশ্চিমা দেশগুলোর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ওপর চাপ পড়বে।’ পশ্চিমে সুদের  বৃদ্ধি পরিস্থিতি মন্দার দিকে নিয়ে যাবে কি না, তা মূলত চাহিদার ওপর নির্ভর করে বলে মনে করছেন কার্সটেন হলজ। তাঁর মতে, সামনের দিনগুলোতে চাহিদা ক্রমেই বাড়তে পারে। এতে বাড়বে পণ্যের দাম। এমনকি পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরেও চলে যেতে পারে।

এরপরও এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের জন্য অর্থনৈতিক পূর্বাভাস সামগ্রিকভাবে আশা জাগানোর মতো অবস্থানে রয়েছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞ অনেকে। সম্প্রতি এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চলতি বছরে এশিয়ার উন্নয়নশীল দেশগুলোর প্রবৃদ্ধি ৫ দশমিক ২ শতাংশ হতে পারে। ২০২৩ সালে তা ৫ দশমিক ৩ শতাংশ হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

২০২২ সালের এখন পর্যন্ত বিশ্বে আর্থিক মন্দার আশঙ্কা দেখছেন না হংকংয়ে অবস্থিত নাটিক্সিস ব্যাংকের এশিয়াবিষয়ক জ্যেষ্ঠ অর্থনীতিবিদ ত্রিন নুয়েন। তিনি আল-জাজিরাকে বলেছেন, এশিয়ার প্রকৃত সুদের হার কম। এ ছাড়া চীন বাদে অন্য দেশের পরিস্থিতি স্বাভাবিক। এটা এশিয়ার জন্য সুসংবাদ। এগুলো আগামীতে আর্থিক সংকটের পূর্বাভাস দিতে সহায়তা করবে। এসব কিছুর পরও বিশ্বজুড়ে জিনিসপত্রের মূল্যবৃদ্ধি, সুদের হার ও ডলারের মান বেড়ে যাওয়ায় কঠিন আর্থিক অবস্থা এবং চীনের বর্তমান পরিস্থিতি অর্থনীতির গতি কমিয়ে দিচ্ছে বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদ ত্রিন নুয়েন।

যতকথাই বলা হোক না কেন বিশ^ অর্থনীতিতে যে একটা ক্রান্তিকাল চলছে তা অস্বীকার করার সুযোগ নেই। আর চলমান করোনা মহামারির নেতিবাচক প্রভাব ও ইউক্রেন যুদ্ধ সার্বিক পরিস্থিতি আরও জটিল করে তুলেছে। তাই এই ক্রান্তিকাল যেকোন মহূর্তে বৈশি^ক মন্দার রূপ নিতে পারে বলে মনে করছেন আন্তর্জাতিক বোদ্ধামহল। এমতাবস্থায় আগামী দিনের সংকট মোকাবেলায় বিশ^নেতাদের সম্মিলিত সিদ্ধান্ত গ্রহণের সময় এসেছে। আর এ বিষয়ে উন্নত দেশগুলোর দায়িত্ব অনেক বেশি। বিশে^র বিত্তবান দেশগুলো এ বিষয়ে ইতিবাচক ভূমিকা রাখলে বিশ^ সম্প্রদায় একটি অনিবার্য মন্দা পরিস্থিতি থেকে পরিত্রাণ পেতে পারে।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ