সুগন্ধ ছড়ানোর জন্য বিখ্যাত যে গাছ

॥ আসগর মতিন ॥
চিরসবুজ এক বৃক্ষ আগর। আর এই গাছের নির্যাস থেকেই তৈরি করা হয় বিশ^ বিখ্যাত আতর বা সুগন্ধি। কৃত্রিম এবং প্রাকৃতিক দুই উপায়েই আগর থেকে সুগন্ধিজাতীয় দ্রব্য আতর বা পারফিউম উৎপাদন করা হয়। আর সব শেষে ছাল বাকল থেকে তৈরি হয় আগর বাতি। আগর গাছের নাম থেকেই এসেছে আমাদের চির চেনা আগর বাতি নামটি। আগর গাছ এক বিশেষ ধরনের উদ্ভিদ যা সুগন্ধের জন্য বিখ্যাত। তবে সবাই এ গাছ চেনে না। সবখানে এ গাছ দেখাও যায় না।
মোগল আমলে বৃহত্তর সিলেটের আগর শিল্পের সুনাম ছিল বিশ্বজুড়ে। সুনামগঞ্জের ছাতকে প্রক্রিয়াজাতকরণের মাধ্যমে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে আতর উৎপাদিত হচ্ছে। এমনকি ব্যক্তিগতভাবেও অনেকেই আগর চাষ করছে। বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলের পাহাড়ে এবং চট্টগ্রামে কিছু এলাকায় এগাছ জন্মে। সিলেট সুনামগঞ্জের কাছাকাছি অন্যান্য জেলাতেও কম বেশি রয়েছে আগর গাছ। মৌলভীবাজারের বড়লেখা উপজেলার সুজানগর ইউনিয়ন আগর-আতরের জন্য বিখ্যাত। সেখানে আগর শিল্প গড়ে উঠেছে। সরকারের সহায়তায় তা আরো সমৃদ্ধ হতে পারে। এই গাছ সিলেট এলাকার বন বিভাগ মাঝে মাঝে চাষ করে থাকে। বাড়ির আঙিনায়, রাস্তার পাশে, পতিত জমি, টিলা-টেঙ্গর এমনকি পরিত্যক্ত জমিতে আগর গাছ লাগানোর পর ফলন পাওয়া যায়। আগর একটি মাঝারি ধরনের চিরসবুজ বৃক্ষ। এ গাছের উচ্চতা সাধারণত ৬০ থেকে ৮০ ফুট হয়ে থাকে।
বেড় ০.৬-২.৫ মিটার ব্যাসের হয়ে থাকে। পাতা পাতলা ও চর্ম উজ্জ্বল সবুজ। এই গাছের ফুল সাদা রংয়ের। তিন বছরের কাছাকাছি সময়ে গাছে ফুল আসে। ফুল খুব ছোট, কাক্ষিক ছত্রাকার মঞ্জরিতে ঘনবদ্ধ। ফল ৪-৫ সেমি লম্বা, ডিম্বাকার।
এটি দক্ষিণ পূর্ব-এশীয় প্রজাতি। পৃথিবীতে আগর আতর পণ্যের প্রায় ১৬০ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের রপ্তানি বাজার রয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো আগর উড চিপস ও আতরের চাহিদা প্রচুর। ভুটান, ভারত, ইন্দোনেশিয়া, ইরান, লাওস, মালয়েশিয়া, মায়ানমার, ফিলিপাইন, সিঙ্গাপুর ও থাইল্যান্ডে পাওয়া যায় এই গাছ। আগর এর বৈজ্ঞানিক নাম একুইলারিয়া ম্যালাসেনসিস (Aquilaria Malaccensis)। এটি থাইমেলাইসি (Thymelaeaceae) পরিবার বা ফ্যামিলীর অন্তর্গত। বর্গ বা অর্ডার ম্যালভেলস (Malvales), গণ বা জেনাস হচ্ছে একুইলারিয়া (Aquilaria), প্রজাতি বা স্পেসিজ ম্যালাসেনসিস (A. Malaccensis), দ্বিপদী নাম বা বিনোমিয়াল নেম হচ্ছে (Aquilaria Malaccensis). অন্যান্য স্থানীয় নামের মধ্যে রয়েছে: Aloe Wood, Eagle Wood, Aguruh, Krsnaguruh ।
একটি পূর্ণাঙ্গ আগর গাছ হতে হলে ২০ থেকে ২২ বছর পর্যন্ত সময় লাগতে পারে। আগর গাছের কাঠ থেকে মহা-মূল্যবান আগর ও আতর তৈরি হয়। এই গাছের বয়স সর্বনি¤œ পাঁচ থেকে দশ বছর হলে এর মোটা ডাল আগর উৎপাদনের জন্য উপযোগী হয়। দুইভাবে আগর গাছের কা- বা মোটা ডাল থেকে আগর উৎপাদন করা হয়- প্রাকৃতিক পদ্ধতি ও কৃত্রিম বা পেরেক পদ্ধতি। আগর গাছের বয়স পাঁচ থেকে দশ বছর হলেই তার কা- কালো বর্ণ ধারণ করে। গাছের এ কালো অংশকেই বলা হয় আগর। কারখানায় আগরের তেল তৈরি করা হয় আগুনের তাপে। প্রথমে হয় বাষ্প, সেই বাষ্পগুলোই ঘনীভূত হয়ে অপর প্রান্তের পাত্রের মধ্যে ফোঁটায় ফোঁটায় পড়তে থাকে। সেই জমতে থাকা পানির উপরেই তেলের আস্তরণ পড়ে। এই আস্তরণই আগর আতর তেল। এক তোলা আতর প্রায় ১২ গ্রাম পরিমাণ। জানা যায়, আতর বের করার পর উচ্ছিষ্টগুলো আগর বাতির ফ্যাক্টরিতে বিক্রি করা হয়। এথেকে তৈরি হয় আগর বাতি। তাছাড়া উচ্ছিষ্ট অংশগুলোও মধ্যপ্রাচ্যে রফতানি করা হয়।
এই গাছের বংশ বিস্তার হয় বীজ থেকে। গাছে জুন মাসে ফুল এবং আগস্ট মাসে ফল হয়। আগরের সুগন্ধি প্রশান্তিদায়ক এবং শরীরের শক্তি বৃদ্ধিকারী বলে কেউ কেউ মনে করে থাকেন। মালয় ও চাইনিজদের আদি চিকিৎসা পদ্ধতিতে রোগ নিরাময়ের ওষুধ প্রস্তুতির গুরূত্বপূর্ণ উপাদান হিসাবে আগর কাঠ ব্যবহার হয়ে আসছে। অ্যারোমাথেরাপিতেও এর ব্যবহার আছে। এছাড়া মূত্রবর্ধক, কামোদ্দীপক, কোষ্ঠ্য পরিষ্কারক হিসাবে এর ব্যবহার পরিলক্ষিত হয়। বিভিন্ন ত্বকের রোগ, ব্রংকাইটিস, হাঁপানী ও বাত রোগে এর ব্যবহার হয়ে থাকে। আগর উড থেকে তৈরি কাঠের টুকরা বা আগর তেল বা আগর আতর উভয়ই সুগন্ধি হিসাবে ব্যবহৃত হয়। আগর তেল ছাড়া কাঠ বা পাউডারজাত সামগ্রী থেকে ধূপের ন্যায় প্রজ্জ্বলনের মাধ্যমে আগরের সুবাস নেয়া হয়। আগর উডের নির্যাশ সুগন্ধি সাবান, স্যাম্পুসহ অন্যান্য প্রসাধণ সামগ্রী তৈরিতে ব্যবহার করা হয়। আগর উড থেকে আহরিত তেল বিশ্বের সবচেয়ে মূল্যবান সুগন্ধি। এই সুগন্ধির বিশেষ বৈশিষ্ট হলো এটি একটি এ্যলকোহলমুক্ত সুগন্ধি। ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান ও সামাজিক-সাংস্কৃতিক আয়োজনে এ সুগন্ধির আকাশ ছোঁয়া চাহিদা বিশ্বজুড়ে।