শনিবার ১৮ মে ২০২৪
Online Edition

বাংলাদেশের বায়ুদূষণ পরিস্থতি

বেশ কয়েক বছর ধরেই বাংলাদেশের বায়ুদূষণ পরিস্থতি সম্পর্কিত খবরাখবর যথেষ্ট গুরুত্বের সঙ্গে আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত হচ্ছে। এর কারণ, এদেশের বায়ুদূষণ পরিস্থতি ইতিমধ্যে অত্যন্ত মারাত্মক পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। এ বিষয়ে সর্বশেষ কিছু তথ্য জানানো হয়েছে গত ২০ ফেব্রুয়ারি ঢাকার বিভিন্ন দৈনিকের খবরে। ‘টানা তিনদিন বায়ুদূষণে শীর্ষে ঢাকা, সতর্কতা জারি’ শিরোনামে প্রকাশিত এক বিশেষ রিপোর্টে বলা হয়েছে, ১৯ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত পরপর তিনদিন দ্বিতীয় দিনের মতো ঢাকার বায়ু ছিল সবচেয়ে বেশি দূষিত। 

উল্লেখ্য, প্রতি মুহূর্তে বিশ্বের বায়ু দূষণের পরিস্থিতি সম্পর্কে তথ্য তুলে ধরে সুইজারল্যান্ডভিত্তিক প্রতিষ্ঠান আইকিউএয়ার। কোন শহরের বাতাস কতটা নির্মল বা দূষিত সে সম্পর্কে আইকিউএয়ার তথ্য দেয় এবং সতর্ক করে।

 আইকিউএয়ার-এর তথ্য অনুযায়ী গত ২০ ফেব্রুয়ারি ঢাকার বাতাসে অতি ক্ষুদ্র বস্তুকণার উপস্থিতি ছিল বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মানদন্ডের চেয়ে ৫৬ গুণেরও বেশি। ভীতি ও উদ্বেগের কারণ হলো, ৩০১ থেকে তার বেশি বা ওপরের স্কোরকে ‘দুর্যোগপূর্ণ’ বলে ধরা ও বিবেচনা করা হয়। অন্যদিকে ২০ ফেব্রুয়ারি সকাল নয়টার দিকে ঢাকার স্কোর ছিল ৩৩৫; কিন্তু তারও আগে সকাল সাড়ে আটটায় ছিল ৩৯৪। আগের দিন সকাল নয়টা পর্যন্ত ১২ ঘণ্টার মধ্যে ১১ ঘণ্টাই স্কোর ছিল ৩০০-এর ওপরে। একবার এমনকি ৪৯২ পর্যন্তও উঠেছিল। জানা গেছে, সেদিন ২১৮ স্কোর নিয়ে বায়ুদূষণে বিশ্বে দ্বিতীয় স্থানে ছিল পাকিস্তানের লাহোর আর ১৮৩ স্কোর নিয়ে তৃতীয় স্থানে ছিল ভারতের রাজধানী নয়াদিল্লী।

উল্লেখ্য, আইকিউএয়ার-এর স্কোর ৫১ থেকে ১০০ হলে তাকে ‘মাঝারি’ বা গ্রহণযোগ্য মানের বায়ু হিসেবে বিবেচনা করা হয়। ১০১ থেকে ১৫০ পর্যন্ত স্কোরকে সংবেদনশীল গোষ্ঠীর জন্য অস্বাস্থ্যকর হিসেবে আর স্কোর যদি ১৫১ থেকে ২০০-এর মধ্যে হয় তাহলে সে বায়ুকে খুবই অস্বাস্থ্যকর বলা হয়। স্কোর যদি ২০১ থেকে ৩০১ পর্যন্ত হয় তাহলে তাকে খুবই অস্বাস্থ্যকর বলা হয়। এর পরের তথা ৩০১ থেকে ওপরের স্কোরকে দুর্যোগপূর্ণ বা ঝূঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। উল্লেখ্য, বায়ুদূষণ বেশি হলে সবচেয়ে বেশি ঝুকিতে থাকে বয়স্ক, শিশু, অন্তঃসত্বা ও জটিল বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত মানুষসহ সংবেদনশীল গোষ্ঠীর লোকেরা। 

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এই রিপোর্টে প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ করা হয়েছিল, সারা বিশ্বে মানুষের মৃত্যুর চতুর্থ প্রধান কারণ হচ্ছে বায়ুদূষণ। বায়ুদূষণজনিত রোগে ২০১৯ সালে বিশ্বে মোট সাড়ে ৬৭ লাখ মানুষের মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে বাংলাদেশের পাশাপাশি ভারতে মারা গেছে ১৬ লাখ ৭০ হাজার। মার্কিন রিপোর্টে আরো উল্লেখ করা হয়েছিল, অতি সুক্ষ্ম কণাজনিত বায়ুদূষণের দিক থেকে বিশ্বের শীর্ষ ১০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশও রয়েছে।

মার্কিন রিপোর্টে জানানো হয়েছিল, অক্টোবর থেকে ঢাকার বায়ুর মান দ্রুত খারাপ হতে থাকে। বায়ুর মান সবচেয়ে খারাপ থাকে ডিসেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত তিন মাস। বাতাসে জলীয় বাষ্প এবং বাতাসের প্রবাহ বেশি থাকলে দূষিত অতি সুক্ষ্ম কণা বেশি অবস্থান করতে পারে না। অন্যদিকে বর্ষা বিদায় নিলে এবং তাপমাত্রা কমতে থাকলে ওই সুক্ষ্ম কণাগুলো বাতাসে ভর করে এবং বায়ুর মানে দ্রুত অবনতি ঘটতে থাকে। এমন অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতেই দেশের বায়ু বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, নভেম্বরে শীতের আমেজ শুরু হলে বিশ্বের শীর্ষ দূষিত শহরগুলোর তালিকায় ঢুকে পড়া ঢাকার বায়ুর মান অনেক খারাপ হতে পারে। আশংকাই এবার সত্যে পরিণত হয়েছে।

বায়ুদূষণের কারণে ২০১৭ সালে যেখানে এক লাখ ২৩ হাজার মানুষের মৃত্যু ঘটেছিল সেখানে ২০১৯ সালে মৃত্যু ঘটেছে এক লাখ ৭৩ হাজার ৫০০ মানুষের। অর্থাৎ মাত্র দু’বছরের ব্যবধানেই মৃত মানুষের সংখ্যা ৫০ হাজার ৫০০ বেড়ে গেছে। মৃত্যুর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে দুরারোগ্য নানা অসুখ-বিসুখ তো বাড়ছেই, মানুষের আয়ুও অনেক কমে যাচ্ছে। এমন অবস্থা যে কোনো দেশের জন্যই অত্যন্ত ভীতিকর এবং অগ্রহণযোগ্য। বায়ুদূষণের কারণে বাংলাদেশে অনেক বেশি সংখ্যক মানুষ ক্রমাগত শুধু অসুস্থই হয়ে পড়ছে না, মানুষের মৃত্যুর সংখ্যাও বাড়ছে। একটি মার্কিন রিপোর্টে জানা গেছে, ২০১৯ সালে বায়ুদূষণজনিত রোগে বাংলাদেশে এক লাখ ৭৩ হাজার ৫০০ জনের মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে বাংলাদেশের পাশাপাশি ভারতে মারা গেছে ১৬ লাখ ৭০ হাজার। পাকিস্তানে মৃত্যুর সংখ্যা ২ লাখ ৩৫ হাজার ৭০০ এবং নেপালে ৪২ হাজার। 

মার্কিন রিপোর্টে আরো কয়েকটি বিশেষ তথ্য-পরিসংখ্যানের উল্লেখ করা হয়েছে। এসবের মধ্যে প্রধান একটি তথ্য হলো, অতি সুক্ষ্ম কণাজনিত বায়ুদূষণের দিক থেকে বিশ্বের শীর্ষ ১০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশও রয়েছে। দ্বিতীয় তথ্যটি হলো, বিশ্বের প্রধান শহরগুলোর বায়ুর মান পর্যবেক্ষণকারী আন্তর্জাতিক সংস্থা এয়ার ভিজুয়ালের পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী ২০২১ সালের ২১ অক্টোবর সন্ধ্যা সাড়ে সাতটায় দূষণের দিক থেকে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল তৃতীয় স্থানে। সে একই বাংলাদেশের অবস্থান এবার সবার ওপরে চলে গেছে! 

এভাবে সব মিলিয়ে দেশের অন্যান্য স্থানের পাশাপাশি রাজধানী ঢাকার পরিবেশ যে মানুষের স্বাস্থ্য ও জীবনের জন্য মারাত্মক হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে সেকথা নিশ্চয়ই বলার অপেক্ষা রাখে না। স্বাস্থ্য ও পরিবেশ বিশেষজ্ঞরা বলেছেন এবং আমরাও মনে করি, বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে পরামর্শের মাধ্যমে সরকারের উচিত বায়ুদূষণ প্রতিরোধের জন্য জরুরিভিত্তিতে পদক্ষেপ নেয়া।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ