সোমবার ২৯ এপ্রিল ২০২৪
Online Edition

রমজান ও বাজার ব্যবস্থাপনা

 জিয়াদ হোসেন রাহাত

সাম্প্রতিক রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, করোনা মহামারি, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, দেশীয় ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংকটের দরুন বৃহদাংশে টালমাটাল দেশীয় সমেত বিশ্ব অর্থনীতি। টালমাটালের টলটলে বিষাদময় খেলায় সবচেয়ে বেশি ভোগান্তির শিকার উন্নয়নশীল ও অনুন্নত দেশের সকল শ্রেণী পেশার মানুষ। চলতি বছর ও গত কয়েক বছরের মতো বৈশ্বিক অর্থনীতির এমন বেহাল দশা সচরাচর খুব একটা দেখেনি বিশ্ববাসী। অস্থিতিশীল অর্থনীতির অবস্থানগত কারণে বিশ্বের প্রায় সব দেশেই বেড়েছে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম। দেশে দেশে পণ্যের দাম বাড়লেও কিছু দেশের বাজার অর্থনীতি হয়ে পড়েছে লাগামহীন। অবশ্য বাংলাদেশেও বিরাজ করছে লাগামহীন অবস্থা। বে-লাগাম এই বাজার ব্যবস্থায় দামের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ে একশ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ীর দৌরাত্ম্য। অসাধু এসব সিন্ডিকেট ব্যবসায়ীর বিষফলে নাকাল দেশের সার্বিক অর্থনীতি। মূলত বিশ্ববাজারে পণ্যের দাম বৃদ্ধির উপর নির্ভর করে দেশের বাজারেও দাম বাড়ার বিষয়টি স্বাভাবিক হলেও অবাক করার বিষয় হচ্ছে- অধিকাংশ সময় দেশের বাজারে নিত্যপণ্যের মূল্য বিশ্ববাজারের সাথে হয় না সামঞ্জস্যপূর্ণ। এতে করে তুলনামূলক বিবেচনায় দেশের বাজারে সিন্ডিকেটের খপ্পরে পড়ে বেড়ে যায় ঐসব পণ্যের দাম। আশ্চর্যজনক হলেও সত্য যে, অনেক সময় বিশ্ব বাজারে কোনো পণ্যের দাম কমলেও তা দেশের বাজারে কমে না অথবা সামান্যতম দামের পরিবর্তনও ঘটে না। দেখা যায়, স্থানীয় বাজারে একবার কোনো পণ্যের দাম বেড়ে গেলে সেই পণ্যের দাম কমার কোনো লক্ষণের দেখাই মেলে না। এসব মূলত বাংলাদেশের সুখে ভাটা পড়ার অশনিপাত।

জাতিসংঘের সুখী দেশের তালিকায় ২০২২ সালে বাংলাদেশের অবস্থান ৯৪তম হলেও গত বছর (২০২৩) তা ১১৮তম স্থানে গিয়ে ঠেকেছে। হিসেব করে বললে বহুগুণে কমেছে বাংলাদেশের সুখ। সর্বমোট ২৩ ধাপ পিছিয়েছি আমরা। দুঃখের বিষয় হলো তালিকার তলানিতে থাকা ২০ দেশের মধ্যে ঠাঁই হয়েছে বাংলাদেশের। আমাদের সুখে কেন এই ভাঁটা? চলুন খুঁজি সেই উত্তর। বিগত কয়েক বছরের তুলনায় এ বছর অসহনীয় মাত্রায় দেশে বেড়েছে নিত্যপ্রয়োজনীয় পন্যের দাম। অস্বাভাবিক এই মূল্য বৃদ্ধির কারণে দিশেহারা দেশের সকল শ্রেণি-পেশার মানুষ। ভোগ ব্যয় বাড়লেও সম্প্রসারিত হয়নি মানুষের আয়ের উৎস। মরার উপর খাঁড়ার ঘা দিয়ে চলছে সিন্ডিকেট ব্যবসায়ীদের দৌরাত্ম্য। ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট ভাঙতে ব্যর্থ সংশ্লিষ্ট সকল পক্ষ। কথায় আছে, পেট শান্তি তো দুনিয়া শান্তি। অথচ এটির উল্টো চিত্র দেখা যাচ্ছে বাংলাদেশে। এখানকার বাজারের সার্বিক অবস্থা দেখে বলা চলে, পেটে অশান্তি তো দুনিয়া অশান্তি। চাল,ডাল, তেলসহ সকল পন্যের দাম আকাশ ছোঁয়ার প্রতিযোগিতায় নামার দরুন পেট পুরে ভাত খেতে পারছে না দেশের নি¤œআয়ের কোটি মানুষ। চাপা আর্তনাদ আর কত? সেই প্রশ্নেরও উত্তর মেলা এখন বড় দায়! ২০২৪ সালের ২০ মার্চেও যথারীতি প্রকাশিত হবে বিশ্বের সুখী দেশের তালিকা। রমজান কেন্দ্রীক ব্যবস্থা না নিলে তা হয়তো গতবারের চেয়েও তলানিতে পৌঁছাবে আমাদের।

প্রকাশ করতে বাঁধা নেই, আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকার যখন ২০০৮ সালে রাষ্ট্র ক্ষমতায় আসে তখন নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম অনেকটাই সাধারণ মানুষের নাগালের মধ্যে নিয়ে আসতে পেরেছিল তারা। ফলে সে সময়টায় সরকারের উপর জনগণের আস্থা বেড়ে গিয়েছিলো কয়েকগুণ। ফলস্বরূপ ২০১৪ সালের নির্বাচনে জনগণের প্রতিনিধি হয়ে আবারও ক্ষমতায় আসে দলটি। এরপর টানা তিন মেয়াদে সরকার গঠন করে দেশের দৃশ্যমান কিছু উন্নয়ন করলেও লাগামে রাখতে পারেনি নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের পাগলা ঘোড়াকে। যার কারণে একবেলা না খেয়ে থাকছে দেশের অনেক দরিদ্র পীড়িত পরিবার আবার দুবেলা দুমুঠো খেলেও তাদের ঐ খাবার পান্তা ভাতের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। এমতাবস্থায় এই চিত্র দেখে, একজন ছাত্র ও দেশের নাগরিক হিসেবে আমি বলতেই পারি, যার পেটে ভাত নেই তার কিসের উন্নয়ন। ২০১৮ সালে আওয়ামী লীগের সরকার গঠনের পর থেকে অসহনীয় মাত্রায় বাড়ছে পন্যসামগ্রির দাম। তার ওপর নেই কার্যকর বাজার মনিটরিং। উন্নয়নের রুপকার হিসেবে দেশে আওয়ামী সরকারের ব্যাপক পরিচিতি থাকলেও নেই উন্নয়নের অলংকার। এক্ষেত্রে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের বাজার নিয়ন্ত্রণ পালন করতে পারে অলংকারের ভূমিকা। ২০২৪ সালে দ্বাদশ সংসদ গঠনের পর সরকার সিন্ডিকেট ব্যবসায়ীদের নিয়ন্ত্রণে যেভাবে কাজ করছে তা প্রসংশাযোগ্য হলেও একেবারে প্রয়োজনের তুলনায় যথেষ্ট নয়।

একটা সময় ছিলো যখন একজন চাকরিজীবী টানাপোড়নের মাধ্যমে সংসার চালাতে পারতেন, তবে দুঃখের বিষয় হলো পন্য-দ্রব্যের লাগামহীন মূল্য বৃদ্ধির কারণে এখন ঋণ নিতে হচ্ছে অনেককে। এতে করে প্রতিনিয়ত সৃষ্টি হচ্ছে সাংসারিক অশান্তি। বাড়ছে পারিবারিক কলহ। এই সংকটের উত্তরণ জরুরি।

বাংলাদেশের উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বিআইডিএস), পিপিআরসি ও সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং (সানেম)-এর গবেষণা ও জরিপে দেখা গেছে, করোনাকালে দেশে দরিদ্রের সংখ্যা বেড়েছে উল্লেখযোগ্য সংখ্যায়। তাদের মতে, দারিদ্র্যের এই হার করোনা-পূর্ব ২১ থেকে বৃদ্ধি পেয়ে ৪১ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। যদিও সরকারের তরফ থেকে বলা হচ্ছে, এ হার অনেক কম। কিন্তু সরকারি সংস্থা বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) কাছে এর সমর্থনে কোনো তথ্য নেই। ২০২০ সালের অক্টোবরের বিবিএসের এক জরিপে দেখা যায়, বাংলাদেশের মানুষের আয় ২০ শতাংশ কমে গেছে। ২০২৩ সালে এই কম আয়ের ঘাড়ে চেপে বসে লাগামহীন বাজার ব্যবস্থা। পন্য সামগ্রীর দাম বেড়ে একাকার হয়ে গেলেও প্রসারিত হয়নি মানুষের আয়ের উৎস। শুধু যে নিত্যপ্রয়োজনীয় পন্যের মূল্য বৃদ্ধির বিষয়টি কেড়ে নিয়েছে আমাদের সুখ তা কিন্তু নয়। গত এক বছরে সীমান্তে চোরাচালান, মাদক সরবরাহসহ বেশ কয়েকটি বিষয় অসুখীর তালিকায় আমাদের স্থান তৈরির জন্য দায়ী। সীমান্তে চোরাচালান, মাদক কারবার বন্ধে আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতা প্রশংসাযোগ্য হলেও তা প্রয়োজনের তুলনায় যথেষ্ট নয়। তাছাড়া দেশের অভ্যন্তরে বেড়েছে অন্যায়-অনিয়ম। ২০২৪ সালে কেমন হবে আমাদের যাত্রা তা হয়তো সময়ই দেবে বলে।

সপ্তাহ ঘুরতেই দরজায় কড়া নাড়বে পবিত্র মাহে রমজান। আরব দেশগুলো সহ সারা বিশ্বে পবিত্র মাহে রমজানকে কেন্দ্র করে রোজাদারদের সম্মানে ব্যবসায়ীরা নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যে ছাড় দেন ৪০-৬০ শতাংশ। বিভিন্ন দেশে সাওয়াবের উদ্দেশ্য রোজাদারদের খাওয়ানো হয় সাহরি-ইফতার। অথচ শান্তিপ্রিয় বাংলাদেশে রয়েছে তার উল্টো চিত্র।ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের কারণে নিত্য প্রয়োজনীয় পন্যের বাজার পারছে না স্থীর হতে। ফলে বেশি মূল্যে পন্য কিনে সাধারণ জনগণ দোষ চাপাচ্ছে সরকারের ঘাড়ে। 

এতে করে নষ্ট হচ্ছে সরকারের ভাবমূর্তি। অসাধু ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের কারণে সরকারের প্রতি জনগণের আস্থা কমতে শুরু করেছে। এই সমস্যার উত্তরণ জরুরি। জনগণের কথা বিবেচনায় সরকার কতৃক টিসিবিসহ বেশ কয়েকটি খাদ্যবান্ধব প্রকল্প-কার্যক্রম গ্রহণ করা হলেও তা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। এমনকি প্রতি বছর মাহে রমজানে সরকারের তরফ থেকে নেয়া খাদ্য বিতরণ-বিক্রয় কার্যক্রমও সীমাবদ্ধ। ফলে দেশের মোট জনসংখ্যার একটি অংশ বরাবরই বঞ্চিত। দেখা যায়, পন্য-দ্রব্যের অসহনীয় মূল্য বৃদ্ধির কারণে মধ্যবিত্ত শ্রেণিও দাড়াচ্ছে টিসিবির লাইনে, নিচ্ছে ভিজিডির চাল। ফলে অনেক সময় বঞ্চিত হচ্ছে নি¤œবিত্ত ও খেটেখাওয়া মানুষ। এই সংকটেরও উত্তরণ জরুরি। 

পন্য-দ্রব্যের ক্রমাগত এই ঊর্ধ্বগতি নিয়ন্ত্রণে সরকারের তরফ থেকে চেষ্টা করা হলেও তা নিয়ন্ত্রণে খেতে হচ্ছে হিমশিম। এর জন্য দায়ী ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট। জনগণকে আস্থায় নিতে এবং অন্যতম মৌলিক অধিকার খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতে আসন্ন মাহে রমজানের আগেই ব্যবসায় সিন্ডিকেট ভাঙাসহ সরকারকে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ