রবিবার ১৯ মে ২০২৪
Online Edition

পবিত্র রমযান নাজাত লাভের মাস

অধ্যাপক মাযহারুল ইসলাম

পবিত্র রমযান মুসলিম বিশ্বের জন্য একটি পরম আনন্দময় মাস। বিশ্বমানবতার জন্য চিরশান্তি ও মুক্তির মহান পয়গামবাহী মহাগ্রন্থ আল কুরআন এ পবিত্র রমযান মাসেই একটি বিশেষ রাতে আল্লাহ তায়ালা হেরা গুহায় ধ্যানমগ্ন হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর ওপর ফেরেশতা জিবরাঈল (আ.)-এর মাধ্যমে নাজিল শুরু করেন। ৬১০ খ্রি. রমযান মাসে লাইলাতুল কদরে ‘ইকরা বিসমি রাব্বিকাল্লাজি খালাক’ সূরা আলাকের ১-৫টি আয়াত সর্বপ্রথম অবতীর্ণ হয়।

আর দশম হিজরীতে বিদায় হজের সময় আরাফাত ময়দানে অবস্থানকালে রাসূলে কারীম হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর ওপর সর্বশেষ অহি অবতীর্ণ হয়। ‘আজ আমি তোমাদের জন্য পূর্ণ করে দিলাম তোমাদের প্রতি আমার নিয়ামত (আল কুরআন) এবং তোমাদের জন্য দীন (জীবনব্যবস্থা) মনোনীত করলাম ইসলামকে।’ (সূরা আল মায়েদা : ৩)। উল্লেখ্য, রমযান মাস একটি ঘটনাবহুল মাস। ইসলামের ইতিহাসে এ মাসে অনেক ঘটনার উল্লেখ আছে।

৬২০ খ্রি. রমযান মাসে উম্মুল মুমিনীন হযরত খাদিজাতুল কুবরা (রা.) ইন্তিকাল করেন। ৬২৪ খ্রি. রমযান মাসেই বদর যুদ্ধ সংঘটিত হয়।

৬৩০ খ্রি. তোমাবেক ৮ম হিজরীর ১০ রমযান রাসূলুল্লাহ (সা.) মক্কা বিজয়ের অভিযান পরিচালনা শুরু করেন এবং ১৭ রমযান বিজয় লাভ করেন। (৪০ হিজরী সালের ১৯ বা ২১ রমযান) আমিরুল মুমিনীন হযরত আলী (রা.) কুফায় মসজিদে ফজর নামাজ পড়া অবস্থায় ছুরিকাহত হন এবং শাহাদাত বরণ করেন। নবী (সা.)-এর পরিবারে ঈমাম হাসানের জন্ম এ মাসেই। এছাড়া হযরত ইব্রাহীম (আ.)-এর নিকট সহিফা, হযরত দাউদ (আ.)-এর ওপর যবুর, হযরত মূসা (আ.)-এর ওপর তাওরাত এবং হযরত ঈসা (আ.)-এর ওপর ইঞ্জিল শরীফ নাজিল হয় এ মাসেই। এসব নানাবিধ কারণে মুসলিম বিশ্বে তথা বিশ্বের ঐতিহাসিকদের নিকট এ মাসের গুরুত্ব এবং মর্যাদা অনেক।

সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ এজন্য যে, মহাগ্রন্থ আল কুরআন এ মাসেই নাজিল শুরু হয়েছে। আর আল্লাহ তায়ালা তার বান্দাদের গোনাহ মাফের জন্য এ মাসে বিশেষ সুযোগ দিয়েছেন। এককথায় বলা যায়, রহমত, বরকত এবং নাজাত লাভের উপায় এই রমযান মাস। আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালা জাহান্নাম থেকে বান্দাদের বাঁচার জন্য উন্মুক্ত করে দিয়েছেন এই রমযান মাসকে।

মহানবী (সা.) রজব এবং শাবান মাস থেকেই রমযান মাসের প্রস্তুতি গ্রহণ করেছেন। রাসূল (সা.) দোয়া করতেন, ‘আল্লাহুম্মা বারিকলানা ফি রজাবা ওয়া শাবান ওয়া বাল্লিগনা রামাদান’। ‘হে আল্লাহ! আমাদেরকে রজব ও শাবান মাসে বরকত দান করুন এবং রমযান মাসে পৌঁছে দিন।

আব্দুল্লাহ ইবনে আবু কায়স (রহ.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘রাসূলুল্লাহ (সা.) কখনো কখনো এমনভাবে রোজা রাখা শুরু করতেন যে, আমরা বলতাম, মনে হয় তিনি আর রোজা ছাড়বেন না। আবার কখনো কখনো বাদ দিতেন, এমনকি আমরা মনে করতাম তিনি আর রোজা রাখবেন না। (আয়েশা রা.) বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (সা.)-কে রমযান ব্যতীত পূর্ণ মাস রোজা রাখতে দেখিনি। আর আমি তাকে শাবান মাস ব্যতীত এত বেশি রোজা রাখতেও দেখিনি। (বুখারী)।

অন্য বর্ণনায় আছে, ‘তিনি শাবান মাস (প্রায়) পুরোটা রোজা রাখতেন। তিনি অল্প কিছু ছাড়া প্রায় পুরো শাবান মাস রোজা রাখতেন।’ মুসলিম।

আব্দুল্লাহ ইবনে কায়াস থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি আয়েশা (রা.)-কে বলতে শুনেছি রাসূলুল্লাহ (সা.) শাবান মাসকে যেভাবে সংরক্ষণ করতেন, অন্য মাসকে তেমনটি করতেন না। অতঃপর রমযানের চাঁদ দেখা গেলে রোজা রাখতেন। আর আকাশ যদি মেঘে ঢাকা থাকত তাহলে শাবান মাসকে ত্রিশ দিন পুরো করতেন, অতঃপর রোজা রাখতেন। (আবু দাউদ)।

আরেকটি হাদীসে আছে, আবু হুরাইরা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, তোমরা রমযান মাসের জন্য শাবান মাসের চাঁদকে সঠিকভাবে হিসাব কর। (তিরমিযী)।

রমযান মাসের রোজা সঠিক দিন থেকে এবং সঠিকভাবে পালনের জন্য শাবান মাসের হিসাবকে যথাযথভাবে সংরক্ষণ করতে হবে। শাবান মাসের চাঁদ কবে উঠল, তা হিসাব করে রাখতে হবে। এজন্য যেকোনো প্রাকৃতিক কারণে চাঁদ না দেখা গেলে চন্দ্রমাস ৩০ পূর্ণ হলে পরবর্তী দিন থেকে অবশ্য অবশ্যই রোজা পালন করতে হবে। আর যদি ২৯ শাবান চাঁদ দেখা যায়, তাহলে ত্রিশ দিন পূর্ণ করার কোনোই প্রয়োজন তো নেই-ই বরং ২৯ শাবান চাঁদ দেখা গেলে অবশ্য অবশ্যই পরদিন থেকেই রোজা পালন করতে হবে।

আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা বলেন, ‘রমযান মাস যাতে কুরআন নাজিল করা হয়েছে, মানবজাতির পথ প্রদর্শক রূপে হিদায়েতের দলিল এবং হক ও বাতিলের পার্থক্যকারী হিসেবে।’ (সূরা আল বাকারা : ১৮৫)। অর্থাৎ রমযান মাস হলো সেই মাস, যাতে মানবজাতির জন্য জীবনযাপনের ব্যবস্থা হিসেবে আল কুরআন নাজিল করা হয়েছে এবং জীবনযাপন ব্যবস্থা হিসেবে ইহা সুস্পষ্ট করে দেয়া হয়েছে। আর এই কুরআন ভালো-মন্দ, ন্যায়-অন্যায়, সঠিক-বেঠিক এবং সত্যাসত্যের একটি অকাট্য মানদ  হিসেবে মহান আল্লাহ নির্ধারণ করে দিয়েছেন।

আবু হুরাইরা (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, “রমযান মাসের প্রথম রজনীতেই শয়তানকে শৃঙ্খলাবদ্ধ করা হয়। জাহান্নামের দরজাসমূহ বন্ধ করে দেয়া হয়, এর কোনো একটি দরজাও খোলা রাখা হয় না। জান্নাতের দরজা খুলে দেয়া হয় এবং কোনো একটি দরজাও বন্ধ রাখা হয় না। আর একজন আহ্বানকারী আহ্বান করতে থাকেনÑ হে কল্যাণকামী অগ্রসর হও, অকল্যাণকামী প্রত্যাশী বিরত হও। (রমযানের) প্রতি রাতে আল্লাহর ওয়াস্তে অসংখ্য লোককে জাহান্নাম থেকে মুক্তি (নাজাত) দেয়া হয়।” (তিরমিযী)।

আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা বলেন, ‘হে ঈমানদারগণ! তোমাদের ওপর রোজা ফরজ করা হলো, যেমন ফরজ করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের ওপর; যাতে তোমরা তাকওয়া অর্জন করতে পার।’ (সূরা আল বাকারা : ১৮৩)। এই আয়াতের মাধ্যমে এটা সুস্পষ্ট যে, রোজার মূল উদ্দেশ্য হলো তাকওয়া অর্জন করা। অর্থাৎ মুত্তাকী হিসেবে নিজেকে গড়ে তোলা।

এখন প্রশ্ন হলো তাকওয়া অর্জনকারী অথবা মুত্তাকী কাকে বলা হবে? উল্লেখ্য, হযরত ওমর (রা.) হযরত উবাই ইবনে কাব (রা.)কে জিজ্ঞাসা করেছিলেন তাকওয়া কী? হযরত ওবায় ইবনে কাব (রা.) এভাবে একটি উদাহরণ পেশ করলেন- একটি কণ্টকাকীর্ণ, কাঁটাগুল্ম পরিবেষ্টিত সরু পথ দিয়ে চলার সময় একজন নিজের পোশাক এবং দেহকে কাঁটার আঘাত থেকে যেভাবে বাঁচিয়ে চলার চেষ্ট করে, তেমনি দুনিয়ার যাবতীয় অশ্লীল, অন্যায়, মন্দ থেকে বাঁচিয়ে চলার যে চেষ্টা অর্থাৎ আল্লাহর নির্দেশগুলো পরিপালন এবং নিষেধগুলো বর্জন করে চলার নামই তাকওয়া।

ইমাম ইবনে তাইমিয়া (রহ.) বলেন, “আত্-তাকওয়া : ‘আল ইমতেসালু বেআওয়া মিরিল্লাহ ওয়াল ইজতেনাবু আননাওয়াহিহী।’ অর্থাৎ তাকওয়া হলো আল্লাহর নির্দেশনাবলী পরিপালন করা এবং নিষেধগুলো থেকে নিজেকে রক্ষা করে চলা। অর্থাৎ নিষেধগুলো বর্জন করে চলা।”

মওলানা আকরম খাঁ তার বাংলা তাফসিরে তাকওয়ার ব্যাখ্যায় বলেছেন, ‘অভিধানের হিসেবে তাকওয়া শব্দের অর্থ হইতেছে নিরাপত্তা বা নিরাপদ হইয়া থাকার জন্য চেষ্টা পাওয়া। প্রত্যেক অন্যায় অনিষ্টকর ও জঘন্য কাজ, কথা এবং ভাবচিন্তা, অবিশ্বাস ও অন্ধ বিশ্বাস হইতে আত্মরক্ষা করার মনোভাবকে তাকওয়া বলা হয়। এককথায় এর সুসংগত অনুবাদ হইতেছে পরহেজগার বা পরহেজ করিয়া চলার অভ্যাস। এই অভ্যাসে অভ্যস্ত যাহারা, আরবীতে তাহাদিগকে মুত্তাকী বলা হয়।’

এ সম্পর্কে তিনি আরো বলেন, ‘রোগী যদি চিকিৎসকের উপদেশকে অগ্রাহ্য করিয়া কুপথ্য গ্রহণ করিতে থাকে এবং তাহার স্বাস্থ্যের পক্ষে অতি অনিষ্টকর কাজ করিয়া চলে, তাহা হইলে বিশেষ উপকারী ওষুধও তাহার পক্ষে ফলদায়ক হয় না। বরং বহুক্ষেত্রে রোগের প্রকোপ আরও বাড়িয়া যায়। এই কুপথ্য বর্জনের নামই পরহেজ বা তাকওয়া।’

উপরোল্লিখিত ‘তাকওয়ার’ ব্যাখ্যাসমূহে সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, দৈহিক বা শারীরিক বেশ-ভূষা, পোশাক-পরিচ্ছদ বা দৃশ্যমান কিছু আমলের মধ্যে তাকওয়া সীমাবদ্ধ নয়। ঈমান, নামাজ, রোজা, হজ, জাকাত ইত্যাদি অনুশীলন ও পরিপালন এবং আল কুরআন ও হাদীস নির্দেশিত পথে জীবনকে পরিপূর্ণভাবে পরিচালিত করার মধ্যেই ব্যক্তির তাকওয়া ফুটে ওঠে। সাধারণভাবে আল্লাহভীতিকে তাকওয়া বলা হয়। আভিধানিক অর্থ হলো সতর্কতা, সচেতনতা। আর পারিভাষিক অর্থ হলো মন্দ ও অনিষ্ট থেকে আত্মরক্ষা করে চলা। নিজেকে আল্লাহর আজাব থেকে রক্ষার জন্য সতর্ক করে চলা, আল্লাহর নিষিদ্ধ কাজ পরিত্যাগ করা। উল্লেখ্য, একমাত্র আল্লাহর ভয়ের কারণেই মানুষ মন্দ কাজ পরিত্যাগ করতে সক্ষম হয়।

মানুষের মধ্যে সাধারণত দ্ইু ধরনের প্রবৃত্তি বিদ্যমান। একটি সুপ্রবৃত্তি নফসে মুতমাইন্না আরেকটি হলো কুপ্রবৃত্তি নফসে আম্মারা। মাঝখানে আরেকটি প্রবৃত্তি কাজ করে আর তা হলো দুই দিকেই কিছু টানাটানি করে। এটাকে আরবীতে বলা হয়, নফসে লাওয়ামা। আমরা এখানে সুপ্রবৃত্তি এবং কুপ্রবৃত্তি নিয়েই আলোচনা করব।

একজন রোজাদার রোজা রেখে ইচ্ছে করলে লুকিয়ে পানাহার করতে পারে বা মিথ্যা কথা বলতে পারে, অশ্লীল কোনো কাজ করতে পারে। কিন্তু তিনি তা কখনো করেন না। কারণ তার মনে আল্লাহর ভয় জাগ্রত আছে। তিনি তো ভাবেন, কোনো মানুষ না দেখলেও আল্লাহ তো দেখছেন। তাই রোজা রেখে খারাপ কিছু করা যাবে না। ঠিক এভাবেই আল্লাহর ভয় একজন ব্যক্তিকে মুত্তাকী হতে উদ্বুদ্ধ করে। কুপ্রবৃত্তি তাকে খারাপ কোনো পথে আকর্ষণ করলেও রোজা রাখার কারণে সুপ্রবৃত্তি এখানে জয়যুক্ত হয়। অর্থাৎ কুপ্রবৃত্তি সুপ্রবৃত্তির কাছে হার মানতে বাধ্য হয়। সুপ্রবৃত্তিই হলো তাকওয়া। আর এ ধরনের সুপ্রবৃত্তির ধারক এবং বাহকই হলেন মুত্তাকী।

রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি (রোজা অবস্থায়) মিথ্যা কথা ও অন্যায় কাজ থেকে বিরত থাকল না, তার পানাহার বর্জন আল্লাহর কোনোই প্রয়োজন নেই। অর্থাৎ তার রোজা আল্লাহর নিকট গ্রহণযোগ্য হবে না। (বুখারী)।

আল কুরআন ও হাদীস থেকে ‘রোজার’ মর্মার্থ, নিয়মকানুন ও রীতিনীতি আলোচনার প্রেক্ষিতে এটা সুস্পষ্টরূপে প্রতিভাত হয়ে ওঠে, নিজেকে মুত্তাকী হিসেবে গড়ে তোলার জন্য রমযান হলো একটি প্রশিক্ষণের মাস। রোজার আসল উদ্দেশ্য হলো কুপ্রবৃত্তিকে দমন করা; হিংসা, ক্রোধ, পাপাচার, সুদ, ঘুষ, চুরি, ডাকাতি, লুণ্ঠন, অনাচার-ব্যভিচার, অসততা এবং লোভ-লালসা থেকে নিজেকে রক্ষা করে চলা এবং সৎভাবে জীবনযাপনে অভ্যস্ত করে গড়ে তোলা।

অন্যদিকে মানুষের দুঃখ-বেদনার অসহায় কষ্টে, অনাহারে সহমর্মী করে তোলা এবং নিজেকে একজন হৃদয়বান আদর্শ মানুষ হিসেবে গড়ে তোলা। সর্বোপরি পাপমুক্ত হয়ে পরকালে নাজাত লাভ করার জন্য নিজেকে উপযুক্ত ও যোগ্য করে তৈরি করা। আল্লাহর ভয়ে যেসব কাজ আমরা রমযান মাসে রোজা রেখে করার সাহস পাই না, রমযান মাস চলে গেলেও বাকি ১১ মাস আমরা সেসব অন্যায়, অসৎ ও অশ্লীল কাজ করতে পারি না। কারণ আল্লাহ তো তখনও বর্তমান থাকেন, আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা তখনও তো সবকিছু দেখেন। আল্লাহ তো সর্বব্যাপী, সর্বজ্ঞাত, সর্বত্র বিরাজমান।

ইসলামী স্কলার ও বিশেষজ্ঞদের বিভিন্ন আলোচনা থেকে প্রতীয়মাণ হয় যে, তাকওয়া শব্দটি অত্যন্ত ভারী এবং ব্যাপক অর্থবোধক। এই শব্দের আভিধানিক এবং পারিপার্শ্বিক অর্থের বিশ্লেষণ থেকে উপলব্ধি করা যায় যে, এই গুরুত্বপূর্ণ অর্থবহ আরবি শব্দটির অবস্থান হৃদয়ের গভীরতম মণিকোঠায়। এই শব্দের মূল লক্ষ্য ও ভাবধারা অন্তরের অন্তস্থলে ধারণ করে, জাগতিক জীবনের সমুদয় কার্যাবলীতে, প্রতিটি কার্য সম্পাদনে, ব্যবহার ও আচরণে যথাযথভাবে প্রয়োগ করতে পারলেই কেবল পারলৌকিক জীবনে নাজাত মিলতে পারে। মাহে রমযান এই জীবনধারা গড়ে তোলারই বার্তা ও প্রশিক্ষণ দেয়। পবিত্র রমযান মাসে সিয়াম-সাধনা ও পালনের মাধ্যমে হৃদয়ের পরতে পরতে তাকওয়ার তাৎপর্য ও শিক্ষা দোলা দেয় এবং কার্যক্রমে তা ফুটে ওঠে। আর এভাবে মনে-প্রাণে তাকওয়া ধারণকৃত ব্যক্তিই মুত্তাকী হিসেবে নিজেকে গড়ে তুলতে পারে। শুধুমাত্র বাহ্যিক বেশভুষা এবং আচার-আচরণে তাকওয়ার যথার্থতা নিরূপিত হয় না। ‘সিয়াম’ এবং ‘তাকওয়া’ শব্দ দুটির দার্শনিক দিক ও ভিত্তি রয়েছে। আর তার বাস্তব প্রায়োগিক দিকগুলোই পারলৌকিক জীবনে নাজাত লাভের যোগ্যতা তৈরি করে দেয়। বিশ্বজাহানের ¯্রষ্টা মহান রাব্বুল আলামীন আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা বান্দার আচরণে সন্তুষ্ট হন এবং নাজাত দান করেন।

একনজরে রোজার শিক্ষাগুলো:

* রোজা সর্বদা আল্লাহকে ভয় করে চলার শিক্ষা দেয়।

* রোজা নিয়মতান্ত্রিক ও নিয়ন্ত্রিত জীবনযাপনের অভ্যাস গড়ে তোলে।

* রোজা মানুষকে ধৈর্যধারণ ও কষ্টসহিষ্ণু হতে শেখায়।

* রোজা অন্য মানুষের প্রতি সহানুভূতিশীল, সহমর্মী এবং সমব্যথী হতে শিক্ষা প্রদান করে।

* সমাজকে সুশৃঙ্খল, দুর্নীতি ও কলুষমুক্ত রাখতেও ভূমিকা পালন করে।

* চিকিৎসকদের মতে রোজা স্বাস্থ্যের জন্যও উপকারী। কারণ রোজা পেটকে কিছু সময় বিশ্রাম দেয় এবং নিয়মিত ও পরিমিত খাবার জন্য উদ্বুদ্ধ করে। ভোগবিলাস এবং আরামপ্রিয়তা ও অলসতা থেকেও রক্ষা করে।

* সর্বোপরি রোজা মানুষকে আল্লাহ তায়ালার হিদায়াত লাভের জন্য যোগ্য করে গড়ে তোলে এবং মুত্তাকী বানায়। আর যারা মুত্তাকী আল্লাহর মেহেরবানীতে তারাই দুনিয়ায় শান্তি এবং আখিরাতে মুক্তি লাভ করতে সক্ষম হয়।

আখিরাতে অফুরন্ত জীবনে কল্যাণ ও শান্তি এবং জান্নাত লাভের আশায় নাজাতের উদ্দেশ্যে নিষ্ঠাপূর্ণ ঈমান রক্ষা, যথাযথভাবে রোজা পালন ও নামায আদায় করা, নিয়মিত কুরআন তিলাওয়াত করা, দীনি কাজে মগ্ন থাকা, আল্লাহর ভয়ে কান্নারত থাকা, দুস্থ দরিদ্রকে দান করা, সবার সাথে সুন্দর ও সদাচরণ করা, নেফাকী পরিত্যাগ করা, মুনাফার লোভে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি না করা এবং খাদ্যদ্রব্যসহ অত্যাবশ্যকীয় দ্রব্যসামগ্রী মওজুদ করে না রাখা, আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার কাছে সর্বদা তওবা-এস্তেগফার ও দোয়া করা আমাদের অবশ্য করণীয়। সর্বোপরি পরকালে নাজাতের জন্য এই পবিত্র রমযান মাসে একটি বরকতময় মহিমান্বিত রাত (লাইলাতুল কদর) সম্পর্কে আল্লাহর ঘোষণা উদ্ধৃত করছি এবং একটি হাদিস উল্লেখ করছি। ‘নিশ্চয়ই আমি কুরআন অবতীর্ণ করেছি মহিমান্বিত (কদর) রজনীতে। আর মহিমান্বিত (কদর) রজনী (রাত) সম্পর্কে তুমি কি জান? মহিমান্বিত রাত হাজার মাস থেকে শ্রেষ্ঠ, সেই রাতে ফেরেশতাগণ ও রুহ অবতীর্ণ প্রত্যেক কাজে তাদের প্রতিপালকের অনুমতিক্রমে শান্তিময় পুরো সে রাত ফজর তুলু (উদয়) হওয়া পর্যন্ত।’ (সূরা কদর)।সালমান ফারসী (রা.) বলেন, ‘শাবান মাসের শেষ দিনে রাসূলুল্লাহ (সা.) আমাদেরকে সম্বোধন করে বক্তৃতা দিলেন। বক্তৃতায় তিনি বললেন, হে লোক সকল! তোমাদের নিকট এমন এক মহান ও বরকতময় মাস আগত, যে মাসের একটি রাত (লাইলাতুল কদর) হাজার মাসের চেয়েও উত্তম। এ মাসের রোজাকে আল্লাহ ফরজ করে দিয়েছেন এবং রাত জেগে নামায পড়াকে নফল করে দিয়েছেন। যে ব্যক্তি আল্লাহর নৈকট্য লাভের জন্য এ মাসে কোনো নফল ইবাদত করবে, সে ব্যক্তি অন্য সময় ফরজ ইবাদতের সাওয়াব পাবে। আর যে ব্যক্তি এ মাসে একটি ফরজ আদায় করবে, সে ব্যক্তি অন্য মাসের সত্তরটি ফরজ আদায়ের সমতুল্য সাওয়াব পাবে। এটি ধৈর্যের মাস। আর ধৈর্যের প্রতিদান হলো জান্নাত। আর এটি সহানুভূতির মাস। আর এ মাসে মুমিনের রিজিক বৃদ্ধি করে দেয়া হয়। যে ব্যক্তি এ মাসে কোনো রোজাদারকে ইফতার করায়, তার জন্য সেটা গুনাহ মাফ ও জাহান্নাম থেকে নাজাতের কারণ হয়ে যায় এবং তাকে ঐ রোজাদারের সমান সাওয়াব দেয়া হয়, অথচ সে ব্যক্তির সাওয়াবের কোনো অংশ কমানো হয় না। তারা বলল, হে আল্লাহর রাসূল (সা.)! আমাদের প্রত্যেকেই তো রোজাদারকে ইফতার করানোর সামর্থ্য রাখি না। রাসূলুল্লাহ (সা.) বললেন, তোমাদের যে ব্যক্তি সামান্য দুধ, খেজুর বা পানির দ্বারা কাউকে ইফতার করায়, সেও অনুরূপ সাওয়াব লাভ করে। এটা এমন মাস যার প্রথমাংশ রহমতস্বরূপ, মধ্যমাংশ ক্ষমা ও শেষাংশ জাহান্নাম থেকে নাজাতের। এ মাসে যে ব্যক্তি অধীনস্থ ব্যক্তিদের দায়িত্ব কমিয়ে দেবে, আল্লাহ তাকে ক্ষমা করবেন এবং জাহান্নাম থেকে নাজাত দেবেন। আর তোমরা এ মাসে চারটি কাজ বেশি করবে। দুটি কাজ এমন, যা তোমাদের রবকে সন্তুষ্ট করবে। আর অন্য দুটি এমন, যা থেকে মুখাপেক্ষীহীন হওয়ার কোনো উপায় নেই। যে দুটি কাজ তোমাদের রবকে সন্তুষ্ট করবে তা হলোÑ ‘আল্লাহ ছাড়া কোনো ইলাহ নেই, সে সাক্ষ্য দেয়া এবং তার নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করা এবং যে দুটি থেকে তোমাদের মুখাপেক্ষীহীন হওয়ার কোনো উপায় নেই তা হলোÑ আল্লাহর নিকট জান্নাত প্রার্থনা করবে এবং জাহান্নাম থেকে মুক্তি চাইবে। আর যে ব্যক্তি এ মাসে রোজাদারকে তৃপ্তি সহকারে খাওয়াবে, আল্লাহ তাকে হাউজে কাওসার থেকে এমন পানীয় পান করাবেন যে, জান্নাতে প্রবেশ করা পর্যন্ত সে আর পিপাসার্ত হবে না। (সহী ইবনে খুযাইমা)।

আসুন, আমরা রহমত, বরকত এবং নাজাত লাভের উদ্দেশ্যে রমযান মাসে সিয়াম পালন করি এবং রমযানের শেষ দশ দিনে ইতিকাফে অথবা ঘরে বসে ইবাদতের মাধ্যমে কদরের রাত সন্ধান করি; আল্লাহর কাছে নাজাত প্রার্থনা করি। আল্লাহর রাসূল (সা.) সবসময় যে দোয়া করতেন, সেই দোয়া করি। ‘আল্লাহুম্মা ইন্নাকা আফ্যুয়্যুন তুহিব্বুল আফওয়া ফা’ফু আন্নী।’ আল্লাহ নিশ্চয়ই তুমি ক্ষমাশীল, তুমি ক্ষমা করতে ভালোবাসো। সুতরাং আমাকে ক্ষমা করো। আমীন।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ