মাতৃভাষা বাংলা ভাষা খোদার সেরা দান
সাদেকুর রহমান : ভাষা-আন্দোলনের অমলিন, অক্ষয় স্মৃতিতে ভাস্কর ফেব্রুয়ারি মাসের ৮ দিন আজ বুধবার। ভাষা সংগ্রামের ব্যাপারে এমনকি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হাতেগোণা ক'জন ছাত্র-শিক্ষক ছাড়া সংখ্যাগরিষ্ঠরা অজ্ঞাত কারণে ছিল নীরব, নিশ্চুপ। দেশের প্রাচীন সাংস্কৃতিক সংগঠন ‘তমদ্দুন মজলিস' ও রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের নিরন্তর সংগ্রামের দল ইতিবাচক হতে থাকলে এতে অনেকেই চেতনা ফিরে পায। সময়টা ছিল ১৯৪৮ সাল। ওই বছরের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রতিবাদ সভা, ধর্মঘট, শ্লোগানে রাজপথ ছিল উত্তপ্ত। ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসে একটি মাইলফলক।
রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের প্রথম আহবায়ক অধ্যাপক ড. এএসএম নূরুল হক ভূঁইয়া ‘ভাষা আন্দোলনের তিন যুগ পরের কথা' শীর্ষক এক প্রবন্ধে লিখেন, ভাষা আন্দোলনের যৌক্তিকতা উপলব্ধি করে ১৯৪৮ সালের জানুয়ারি মাসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তার অধিভুক্ত কলেজসমূহে উচ্চ মাধ্যমিক শ্রেণী পর্যন্ত মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষা প্রদানের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। তমদ্দুন মজলিসের উদ্যোগেই গঠিত হয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ। ১৬ ডিসেম্বর সংগ্রাম পরিষদের একটি বিবৃতি বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় প্রকাশ করা হয। এতে আমাদের মাতৃভাষাকে কোণঠাসা করার চক্রান্ত ও ষড়যন্ত্রের কথা উল্লেখ করে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদকে সফল করতে সকলের প্রতি আহবান জানানো হয়। ২৫ ফেব্রুয়ারি ইংরেজি ও উর্দুর সাথে বাংলাকে গণপরিষদের ভাষা হিসেবে গ্রহণ করার জন্য ধীরেন্দ্র লাল দত্তের সংশোধনী প্রস্তাব অগ্রাহ্য হয়। গণপরিষদের এ সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে ২৬ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে অধ্যাপক (পরে প্রিন্সিপাল) আবুল কাসেমের সভাপতিত্বে ছাত্রসভা অনুষ্ঠিত হয়। তমদ্দুন মজলিস ও সংগ্রাম পরিষদের উদ্যোগে আয়োজিত ওই সভায় ২৯ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় ধর্মঘটীদের সাথে পুলিশের খন্ডযুদ্ধ হয়। পুলিশের নির্বিচার লাঠিচার্জে বহু ছাত্র আহত হয় এবং অনেককে গ্রেফতার করা হয়। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর পুলিশের প্রত্যক্ষ লড়াই ও ছাত্র-জনতার তীব্র বিক্ষোভ প্রকাশ এটিই প্রথম। বিক্ষোভ ও গ্রেফতারের খবর পেয়ে রাজনৈতিক নেতা ও কর্মীগণ তমদ্দুন মজলিসের সঙ্গে আন্দোলনে অংশগ্রহণ করতে আসেন। এরপর রাজনৈতিক নেতাদের পীড়াপীড়িতে সংগ্রাম পরিষদকে সম্প্রসারিত হয় এবং বাংলাকে পাকিস্তানের গণপরিষদের ভাষার অন্তর্ভুক্ত না করার প্রতিবাদে ১১ মার্চ পূর্ব পাকিস্তান জুড়ে এক সাধারণ ধর্মঘট আহবান করা হয়।
এদিকে ২ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক মুসলিম হলে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হলে ১১ মার্চের হরতাল অভূতপূর্ব সাফল্য অর্জন করে। সেদিন ইডেন বিল্ডিংয়ের ১ ও ২ নম্বর গেট, রমনার পেস্ট অফিস, নীলক্ষেত ও পলাসী ব্যারাকে এবং রেলওয়ে ওয়ার্কশপে পিকেসিং করা হয়। ফলে পুলিশের সাথে ছাত্র-জনতার প্রত্যক্ষ সংঘর্ষ ঘটে ও খন্ডযুদ্ধ শুরু হয়। সেদিন প্রায় ১ হাজার জনকে গ্রেফতার করা হয়। পুলিশের বেধড়ক লাঠিচার্জে শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হকসহ কমপক্ষে ২শ জন আহত হন এবং ৬৯ জনকে জেলে বন্দি করে রাখা হয়। ১১ মার্চের পুলিশী জুলুমের প্রতিবাদে ঢাকায় ১২ মার্চ থেকে ১৫ মার্চ পর্যন্ত ধর্মঘট আহবান করা হয়। ১৪ মার্চ পূর্ব পাকিস্তানের সকল শহরেই ধর্মঘট পালিত হয়।
ভাষা আন্দোলনের এ সাফল্যে কেন্দ্রীয় সরকার চিন্তিত হয়ে পড়ে। তাছাড়া ১৯ মার্চ পাকিস্তানের গবর্নর জেনারেল মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর ঢাকায় আসার কথা। কাজেই মুখ্যমন্ত্রী খাজা নজিমুদ্দীন রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের সাথে সংলাপে বসতে চাইলেন। ১৫ মার্চ বর্ধমান হাইজে (বর্তমান বাংলা একাডেমী) বহু বাদানুবাদের পর সংগ্রাম পরিষদের সাথে তার ৮ দফার এক ঐতিহাসিক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। ওই ছাত্র-জনতার এক বিরাট মিছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলে অনুষ্ঠিত প্রাদেশিক পরিষদের সভার দিকে পুলিশের ব্যারিকেড ভেদ করে অগ্রসর হয় এবং পরে চুক্তির কথা জানতে পেরে ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। এমন এক পরিস্থিতিতে ২১ মার্চ ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) বিশাল জনসভায় মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ যখন উর্দুর পক্ষে বক্তব্য দেন, তখন অযুতকণ্ঠে ‘নো' ‘নো' ধ্বনি উচ্চারিত হয়। ২৪ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কার্জন হলে সমাবর্তন উৎসবেও ছাত্ররা জিন্নাহর উপস্থিতিতে বাংলা ভাষার সমর্থনে শ্লোগান উচ্চারণ করলে তিনি হতবাক হয়ে যান। পরে ছাত্রদের পক্ষ থেকে বাংলা ভাষার দাবি সম্বলিত একটি স্মারকলিপি গবর্নর মোহাম্মদ আলী জিন্নাহকে দেয়া হয়।
গোটা পূর্ব পাকিস্তান তখন বাংলা ভাষা প্রতিষ্ঠার দাবিতে সোচ্চার। নানামুখী কর্মসূচিতে শহর থেকে প্রত্যন্ত জনপদ পর্যন্ত উত্তাল। ধারাক্রমে ২ এপ্রিল পূর্ব পাকিস্তান সংগ্রাম পরিষদ বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার জন্য পাকিস্তান গণপরিষদে দাবি পেশ করার প্রস্তাব গ্রহণ করে। অব্যাহত আন্দোলনের ধারায় ২৭ নবেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র-ছাত্রী সংসদ (ডাকসু)-এর পক্ষ থেকে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খানকে বাংলা রাষ্ট্রভাষা করার দাবি সংবলিত স্মারকলিপি প্রদান করেন ডাকসু'র তৎকালীন জিএস গোলাম আযম। তিনি পরবর্তীতে রাষ্ট্র বিজ্ঞানের অধ্যাপক ও বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর আমীরের দায়িত্ব পালন করেন।