শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪
Online Edition

আকরাম ফারূক স্মৃতি তার ভোলা ভার

গোলাম সোবহান সিদ্দিকী:
খ্যাতনামা অনুবাদক, সাংবাদিক, সাহিত্যিক ও লেখক আকরাম ফারূক আমাদেরকে ছেয়ে পরম করুনাময়ের সান্নিধ্যে গমন করেছেন দেখতে না দেখতে এক বছর অতিক্রান্ত হয়ে গেল। গত পহেলা মে ছিল আকরাম ফারূকের প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী। এদিনটি নীরবে নিভৃতে চলে গেল। আমি আশা করেছিলাম তার স্বজনরা তার সম্পর্কে কিছু লিখবে তার সহকর্মীরা তাকে স্মরণ করবে। ঢাকা শহরে প্রায় ৫০ বছর অবস্থানকালে অনেকের সঙ্গে তার হৃদ্যতা জন্মেছে অনেক সহকর্মীর সঙ্গে আকরাম ফারূক কাজ করছে, তাদের কেউ না কেউ তাকে স্মরণ করবে। কিন্তু বাস্তব কিছুই হল না কোন আলোচনা সভার আয়োজন করা হলো না। এমনকি তার পরিবারের পক্ষ থেকেও কোন ঘরোয়া অনুষ্ঠান বা দোয়া মাহফিলের আয়োজনে দোয়া করা হয়নি। পরিবারের পক্ষ থেকে সংবাদপত্রে একটা বিবৃতি সরবরাহ করা হলেও একটা খবর ছাপা হতো। কিন্তু বাস্তবে কিছুই করা হয়নি এ অবস্থা দেখে আমি যার পর নাই ব্যথিত ও মর্মাহত হয়েছি। তখন থেকে আমি চিন্তা করছিলাম যে তার সম্পর্কে আমি কিছু লিখব। কিন্তু সেই চিন্তা কাজে লাগানো আমার জন্য কঠিন হয়ে পড়ে। এর একটা কারণ আছে, বেশ কয়েক বছর থেকে আমার নিজ হাতে কিছু লেখা সম্ভব হচ্ছে না। কিছু লিখা হলে অপরের সাহায্য নিতে হয়। অর্থাৎ ডিকটেশন দিয়ে কপি তৈয়ার করতে হয় এটাও সহজ কাজ নয়।

ডিকটেশন নেয়ার মতো লোক পাওয়া কঠিন। ছেলে-মেয়েরা সকলে নিজ নিজ কাজে ব্যস্ত। কারো পরীক্ষার প্রস্তুতি, কারো ক্লাসের লেখাপড়া। যেন কারো সময় নেই। এদিকে, দৈনিক সংগ্রামের সাহিত্য সম্পাদক দীর্ঘ দিনের সুহৃদ সাজজাদ হোসাইন খান লেখা দেয়ার জন্য বার বার তাগিদ দিচ্ছে। অপরদিকে বন্ধুবর আকরাম ফারূকের বেয়াই শাহাদাত হোসেন লেখার মাল-মসলা সরবরাহ করে বার বার তাগিদ দিচ্ছেন। কিন্তু তারপরও লেখা তৈয়ার করা হচ্ছে না পরিবেশ-পরিস্থিতি মোটেই লেখার অনুকূল নয়। আমি চিন্তা করে কূল পাচ্ছি না কেন এমনটি হচ্ছে। কিন্তু যে করেই হোক আকরাম ফারূক সম্পর্কে আমাকে কিছু লিখতেই হবে। কেন লিখতে হবে, পাঠকের মনে এমন জিজ্ঞাসা জাগতে পারে। যারা পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে পরপারে গমন করেছেন তাদের সম্পর্কে আলোচনা, লেখালেখি তাদের স্মরণে সেমিনার, সিম্পোজিয়ামের আয়োজন এবং তাদের জীবনী গ্রন্থ প্রকাশ ইত্যাদি দ্বারা তাদের কোন উপকার হবে না। উপকার হবে আমরা যারা বেঁচে আছি তাদের। সমাজের মানুষকে জাগাবার জন্যে, এ ঘুণে ধরা সমাজ ভেঙ্গে নতুন সমাজ গড়ার জন্যে যারা কাজ করেছেন, তাদেরকে স্মরণ করা আমাদের নিজেদের প্রয়োজনের কর্তব্য বিবেচনা করি।

আমার মনে পড়ে ষাটের দশকে মাঝামাঝি ঢাকা শহরে আগমন করার পর লেখালেখির সুবাদে বিভিন্ন পত্রিকা অফিসে আমি যাতায়াত করা শুরু করি। আমি থাকতাম বকশি বাজার আলিয়া মাদরাসার হোস্টেলে। বর্তমানের এ হোস্টেলটি আল্লামা কাশগরী ছাত্রাবাস নাম ধারণ করেছে। বকশি বাজার থেকে সবচেয়ে কাছে ছিল ‘দৈনিক আজাদ' অফিস। সলীমুল্লাহ মুসলিম এতিম খানার বিপরীত দিকে ২৭-ক ঢাকেশ্বরী রোডে ছিল দৈনিক আজাদের অফিস। এখান থেকে দৈনিক আজাদ ছাড়াও মাসিক মোহাম্মদী একটি সাহিত্য পত্রিকা বের হতো। বর্তমানে এ দু'টি পত্রিকার নাম মুছে গেছে। দৈনিক আজাদ পত্রিকার সম্পাদক মওলানা মুহাম্মদ আকরম খান অধস্তন পুরুষ এমনই অযোগ্য ও অপদার্থ নিজেদেরকে প্রমাণ করেছে যে এ ঐতিহ্যবাহী পত্রিকাগুলোর নাম ধরে রাখা যে নিজেদের কর্তব্য তাও তারা ভুলে গেছে। সে কারণে আমাদের নতুন প্রজন্ম দৈনিক আজাদ বা মাসিক মোহাম্মদী বা মাসিক সওঁগাতের আজ আর নামও জানে না। এগুলো এখন ইতিহাসের বিষয় বস্তু। ইতিহাস অনুসন্ধান করা ছাড়া এইসব পত্র-পত্রিকার নাম জানা এখন আর সম্ভব নয়। ষাটের দশকের মাঝামাঝি দৈনিক আজাদ পত্রিকার নাম করা সাংবাদিক মুজিবুর রহমান খানের সম্পাদনায় র‌্যাংকিন স্ট্রিটের শেষ প্রান্ত থেকে বের হতো দৈনিক পয়গাম নামে একটি পত্রিকা। মুজিবুর রহমান খান ছাড়াও সেখানে কাজ করতেন খ্যতিনামা কলামিস্ট আখতারুল আলম, যিনি পরবর্তীকালে দৈনিক ইত্তেফাকে স্থান, কাল, পাত্র শিরোনামে ‘লুব্ধক' ছন্দ নামে কলাম লিখে দেশ জোড়া খ্যাতি অর্জন করেছেন। পঁয়ষট্টি সালের মাঝামাঝি সময়ে একদিন দৈনিক পয়গাম অফিসে সম্পাদক মুজিবুর রহমান খানের কক্ষে আখতারুল আলমকে উত্তেজিত কণ্ঠে কথা বলতে দেখে আমি অবাক হয়েছিলাম। সেদিন আখতারুল আলম চরম ক্ষোভের সঙ্গে উত্তেজিত কণ্ঠে বলছিলেন বিশ্ব নবীর মতো খ্যাতনামা গ্রন্থের লেখক কবি গোলাম মোস্তফার মৃত্যুবার্ষিকী যদি নীরবে নিভৃতে চলে যায় তাহলে আমরা যে একটা জীবন্ত জাতি তা কেমন করে দাবি করতে পারি।

উল্লেখ্য যে, খ্যাতনামা লেখক কবি গোলাম মোস্তফার প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী (১৩ অক্টোবর ১৯৬৪) উপলক্ষে কোন অনুষ্ঠানের আয়োজন না করায়, এমনকি পত্র-পত্রিকায় কোন খবরও ছাপা না হওয়ায় সেদিন আখতারুল আলম তার মনের ক্ষোভ প্রকাশ করেছিলেন। আজ প্রায় অর্ধ শতাব্দীর পরও পরিস্থিতির কোন পরিবর্তন হয়নি। আজও এইসব স্মরণীয়-বরণীয় ব্যক্তিদের জন্ম-মৃত্যু/উপলক্ষে কোন অনুষ্ঠানের আয়োজন তেমন একটা করা হয় না দু'চারজন নাম করা ব্যক্তি ছাড়া অন্যদের জন্ম-মৃত্যুর দিনটির কথা বলতে গেলে কেউ স্মরণ করে না। পত্র-পত্রিকায় এইসব মনীষিদের জীবনী সম্পর্কে কোন প্রবন্ধ-নিবন্ধ প্রকাশিত হয় না। এমনকি তাদের পরিবারের পক্ষ থেকেও কোন অনুষ্ঠান বা কোন দোয়ার মাহফিলের আয়োজন করা হয় না। সেদিন খ্যাতনামা কলামিস্ট ‘লুব্ধক' (আখতারুল আলম) যে ক্ষোভের সঙ্গে কথাগুলো উল্লেখ করেছিলেন, যে পরিবেশ-পরিস্থিতির কথাগুলো বলেছিলেন, আজকের পরিবেশ তা থেকেই মোটেই ভিন্ন নয়। অদৃষ্টের নির্মম পরিহাস, সেই আখতারুল আলমের মৃত্যুর খবরটা পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হয়নি। কারণ এমন এক সময় তার মৃত্যুর ঘটনা ঘটে যখন পত্রিকায় তার মৃত্যুর খবর পৌঁছানো এবং ছাপা সহজ ছিল না। আজও এ মহান সাংবাদিকের জন্ম-মৃত্যু এবং জীবনী নিয়ে কোথাও তেমন আলোচনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করতে দেখা যায় না। বাংলা একাডেমির মতো জাতীয় প্রতিষ্ঠান আখতারুল আলমের মতো নামকরা সাংবাদিক এর জীবনী গ্রন্থ প্রকাশে কোন উদ্যোগ গ্রহণ করেনি। আখতারুল আলম এবং আকরাম ফারুক দু'জনের মধ্যে আমি একটা অদ্ভুত মিল খুঁজে পাই।

আখতারুল আলম দীর্ঘ পঞ্চাশ বছরের বেশি সময় সাংবাদিকতায় অতিবাহিত করেছিলেন তা সত্ত্বেও তিনি ছিলেন প্রচার বিমুখ। নিজেকে তেমন একটা প্রচার করতে চাইতেন না হয়তো সে কারণে তার জীবদ্দশায় যেমন প্রচার বিমুখ ছিলেন তেমনি মৃত্যুর পরও প্রচার বিমুখই রয়ে গেলেন। দীর্ঘদিন সংবাদপত্রে যে সব কলাম লিখেছেন, স্বনামে-বেনামে তার যেসব লেখা প্রকাশিত হয়েছিল সেগুলো সংকলিত হয়ে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হলে সমাজ উপকৃত হতো, নতুন প্রজন্ম তাদের পূর্বসূরীদের সম্পর্কে জানতে পারতো কিন্তু আমাদের সমাজে অতীত পন্ডিত মনিষীদেরকে জানার কোন ব্যবস্থা নেই। একই কথা বন্ধুবর আকরাম ফারূক সম্পর্কেও প্রযোজ্য। আকরাম নিজেও ছিল প্রচার বিমুখ এবং নিভৃতচারী। নিজেকে জাহির করার মানসিকতা তার মধ্যে ছিল না বললেই চলে। হয়তো সে কারণে এমন এক সময় তার মৃত্যু হয়েছে যখন স্বাভাবিকভাবেই পত্র-পত্রিকায় প্রকাশ হয়নি। উল্লেখ্য যে, ২০১০ সালের পয়লা মে দিনের শেষ ভাগে আকরাম ফারূক ইন্তিকাল করেন। পরদিন কোন পত্র-পত্রিকায় প্রকাশও হয়নি। মে দিবস উপলক্ষে ছুটির কারণে। যে জন্য তার মৃত্যুর খবরটা ভালোভাবে প্রচার হয়নি। উত্তরাস্থ ফয়যাবাদের বাসভবনের নিকটস্থ গোরস্তানে ঐদিন রাত্রেই তার লাশ দাফন করা হয়। ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও আমার মতো অনেকের পক্ষেই তার দাফন অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করা সম্ভব হয়নি।

আকরাম ফারূককে আমি প্রথম দেখতে পাই সাপ্তাহিক জাহানে নও অফিসে। এই পত্রিকার অফিস ছিল কোর্ট-কাচারির বিপরীত দিকে তের কারকুন বাড়ি লেনে। তখন সারাদেশে এই একটি মাত্র পত্রিকা ছিল ইসলামী ভাবধারার অনুসারী। পত্রিকাটির ললাটে লেখা ছিল ইসলামী আন্দোলনের নকীব। এই পত্রিকাটির মালিক ছিলেন মাওলানা মুহাম্মদ আবদুর রহীম এবং সম্পাদক হিসেবে নাম ছাপা হতো হাফেয হাবিবুর রহমানের। হাফেয হাবিবুর রহমান গ্রাম থেকে এ পত্রিকায় সংবাদ পাঠাতেন সেই সুবাদে পত্রিকার মালিক মাওলানা আব্দুর রহীমের সঙ্গে তার যোগাযোগ এবং পরবর্তীকালে মাওলানা আব্দুর রহীমের অনুরোধে হাফেয হাবিবুর রহমান ঢাকায় চলে আসেন এবং পত্রিকাটির সম্পাদকীয় দায়িত্ব গ্রহণ করেন। সম্পাদক হিসেবে হাবিবুর রহমানের নাম ছাপা হলেও মূল পত্রিকাটির দেখাশোনা করতেন মাওলানা মুহাম্মদ আব্দুর রহীম নিজে। সফর উপলক্ষে ঢাকার বাইরে না থাকলে তিনি প্রায় প্রতিদিন নাখাল পাড়া থেকে বেবিটেক্সি যোগে কারকুন বাড়ি লেনে পত্রিকা অফিসে আসতেন এবং বেশ সময় সেখানে অবস্থান করতেন। এছাড়া সেখানে আরো কাজ করতেন শহীদুল আলম নামের এক যুবক, যিনি পরবর্তীকালে শহীদ আল বুখারি নাম ধারণ করেন এবং কোয়ান্টাম মেথড নামে একটা পদ্ধতি উদ্ভাবন করে নতুন কর্মকান্ডে আত্মনিয়োগ করেছেন।

সাপ্তাহিক জাহানে নও কিশোরদের পাতার নাম ছিল শাহিন মাহফিল। এই পাতা পরিচালনা করতেন কাজী শামসুল হক নামে এক যুবক, যিনি বর্তমানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থান করছেন। এখানে উল্লেখ্য যে, মরহুম মাওলানা আব্দুর রহীম কলকাতা আলিয়া মাদরাসা থেকে ১৯৪২ সালে কামিল পাস করার পর গবেষণা কার্যে নিয়োজিত ছিলেন এবং পরবর্তীকালে দেশে ফিরে এসে তিনি কিছুকাল একটা মাদরাসায় শিক্ষকতা করেন ১৯৪৫ সালের দিকে তিনি জামায়াতে ইসলামীতে যোগদান করেন এবং সেই সুবাদে তিনি ঢাকায় আগমন করেন। তখন দু'শ পাঁচ নবাবপুর রোডে জামায়াতের অফিস ছিল, তিনি ছিলেন জামায়াতের প্রতিষ্ঠাতা মাওলানা মওদূদী রহ. এর উর্দু গ্রন্থের বাংলা অনুবাদক। আর হাফেয হাবিবুর রহমান, শহীদুল আলম এবং কাজী সামসুল হক (শাহীন ভাই) এরা সকলেই ছিলেন শিক্ষার্থী। হাফেয হাবিবুর রহমান সম্পর্কে শুনেছি যে, তিনি পরবর্তীকালে এইচ এস সি পাস করেছেন আর শহীদুল আলম জগন্নাথ কলেজ থেকে আইএ পাস করেছেন এবং কাজী শামসুল হকের প্রাতিষ্ঠানিক কোন ডিগ্রি ছিল না। বর্তমানকালে ডিগ্রি অর্জন করাকে যেমন অপরিহার্য মনে করা হয় এবং ডিগ্রি ছাড়া চাকরি লাভ করা বর্তমানে যেমন অসম্ভব আগের দিনে তা ছিল না তখন ডিগ্রির চেয়ে যোগ্যতাকে বেশি মূল্য দেয়া হতো।

আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম নোবেল বিজয়ী বিশ্বকবি বলে খ্যাত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বর্তমানে বাংলাদেশের নাম করা কবি এবং লেখক আল মাহমুদ নদীয়া শান্তিপুরের খ্যাতনামা লেখক মোজাম্মেল হক, খ্যাতনামা সাহিত্যিক সৈয়দ ইসমাইল হোসেন সিরাজী, এদের কেউ আনুষ্ঠানিক ডিগ্রির অধিকারী ছিলেন না অর্থাৎ এরা কেউ প্রবেশিকা পরীক্ষায়ও উত্তীর্ণ হননি। তাই বলে কর্মজীবনে এরা কেউ বাধাগ্রস্ত হননি। সাপ্তাহিক জাহানে নও পত্রিকার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরাও তেমন প্রাতিষ্ঠানিক ডিগ্রির অধিকারী ছিলেন না। হাফেয হাবিবুর রহমান সম্পর্কে বলতে হয় তিনি কোন প্রাতিষ্ঠানিক ডিগ্রির অধিকারী না হলেও তার মধ্যে যোগ্যতা এবং অভিজ্ঞতার অভাব ছিল না। উর্দু থেকে বাংলা অনুবাদের কাজে তিনি ছিলেন মওলানা মুহাম্মদ আব্দুর রহীমের চেয়েও সার্থক অনুবাদক। কিন্তু দুঃখের বিষয় প্রথম জীবনে তিন চারটি বই অনুবাদ করার পর তিনি আর তেমন কাজ করেননি।

হাফেয আকরাম ফারূক ঢাকায় আগমনের পর সাপ্তাহিক জাহানে নও পত্রিকার সঙ্গে যোগাযোগ করে এবং এ পত্রিকায় তার কর্মসংস্থান হয়। এ পত্রিকায় কাজ করার সময় হাফেয হাবিবুর রহমান এবং মওলানা মুহাম্মদ আব্দুর রহীমের নিকট থেকে বন্ধু আকরাম ফারূক অনেক কিছু শেখার সুযোগ লাভ করে। এমনকি হস্তাক্ষর দেখেও মনে হয় যে, হাফেয আকরাম ফারূক হাফেয হাবিবুর রহমানকে অনুকরণ করার চেষ্টায় ত্রুটি করেনি। তবে হাফেয হাবিবুর রহমানের হস্তাক্ষর পুরোপুরি নকল করতে পারেনি বন্ধুবর আকরাম ফারূক। কারণ হাফেয হাবিবুর রহমানের হস্তাক্ষর ছিল একেবারেই স্বচ্ছ এবং স্পষ্ট। তিনি লিখতেন খুব ঘন, কিন্তু তার হাতের লেখা পড়তে কারো কষ্ট হতো না। কিন্তু মওলানা মোহাম্মদ আব্দুর রহীম এবং দৈনিক সংগ্রামের প্রথম সম্পাদক অধ্যাপক আখতার ফারূকের হাতের লেখা পড়া সহজ কাজ ছিল না। হাফেয আকরাম ফারূকের হাতের লেখার পাঠ উদ্ধার করাও তেমন সহজ কাজ নয়।

মরহুম হফেয আকরাম ফারূক লিখিত দশ-বারো পৃষ্ঠার আত্মজীবনী আমার হাতে এসেছে সাংবাদিক শাহাদাত হোসেনের মাধ্যমে ২৭-০৬-২০০৪ সালের লেখা; এই আত্মজীবনী তেমন সহজ পাঠ্য নয় তবুও তার সেই সংক্ষিপ্ত আত্মজীবনীকে কেন্দ্র করেই আজকের এ লেখা প্রস্তুত করা সম্ভব হচ্ছে। আকরাম ফারূক লিখেছে, শুরুতে তার নাম রাখা হয়েছিল আখতারুজ্জামান। কিন্তু অব্যবহিত ছোট ভাইয়ের নাম ছিল আকরামুজ্জামান। কিন্তু, তার এই ছোট ভাইটি হুপিং কাশিতে আক্রান্ত হয়ে শিশুকালেই মারা যায়। পরে এই মৃত ভাইয়ের নামে তার নাম রাখা হয় আকরামুজ্জামান। পরে ১৯৬৪ সালে আরেকবার নাম পরিবর্তন করে আকরাম ফারূক নাম রাখে এবং এই নামেই তার এস এস সি, এইচ এস সি, বি এ ও এম এ'র সার্টিফিকেট। তবে আকরামুজ্জামান নামে দাখিল এবং আলেম পরীক্ষা দেন এবং দাখিলে ৬ষ্ঠ এবং আলিম পরীক্ষায় ১৭তম স্থান অধিকার করেন। দাখিল পরীক্ষা দেন পিরোজপুর জেলার কলখালি মাদরাসা থেকে এবং আলিম পরীক্ষা দেন মুরেলগঞ্জ ওলামাগঞ্জ সিনিয়ার মাদরাসা থেকে। আকরাম ফারূক নিজের পরিবার ও বংশ পরিচয় সম্পর্কে লিখেছেন, তার পিতার নাম মৌলভী মোহাম্মদ নূহ মিয়া আর দাদার নাম মুন্সী আব্দুর রহীম মোল্লা আর দাদার পিতা হাজী আনিসুদ্দীন গোটা অঞ্চলের সুনামের অধিকারী ছিলেন। আর হাজী আনিসুদ্দীনের পিতার নাম যুজল ফকির।

সম্ভবত দরবেশ জীবনযাপনের জন্য তিনি খ্যাত ছিলেন। যুজল ফকিরের পিতা আফতাব শাহ্ এবং দাদা বারতাব শাহ্ তুরস্ক থেকে এ দেশে হিজরত করে আসেন এবং ইসলাম প্রচারে আত্মনিয়োগ করেন বলে শোনা যায়। যতদূর জানা যায়, হাজী আনিসুদ্দীনই সর্বপ্রথম গোপালগঞ্জের বয়রা গ্রামে বসতি স্থাপন করেন এবং এখনো বয়রা ও পার্শ্ববর্তী নিলফা গ্রামে তার বংশধররা বসবাস করছেন কেবলমাত্র আব্দুর রহীম মোল্লার বংশধর নদীভাঙনের শিকার হয়ে বয়রা থেকে মধুমতী নদীর দক্ষিণ পাড়ে গাড়ফা গ্রামে বসতি স্থাপন করে এবং এখনো তাদের বংশধররা সেখানেই বসবাস করছে। আব্দুর রহীম মোল্লার আরো দুই ভাই-এর কিছু বংশধর যথা ইসরাইল মোল্লা, ইসাক মোল্লা, খলিলুর রহমান, আতিকু রহমান প্রমুখও মধুমতীর দক্ষিণ পাড়ে বসতি স্থাপন করেন। হাজী আব্দুর রহীম মোল্লা ও হাজী আনিসুদ্দীনের কবর মধুমতির উত্তর পাড়ে বয়রা ও কুশলী গ্রামে আছে। আব্দুর রহীম মোল্লার বংশধরদের মধ্যে একমাত্র মৌলভী নূহ মিয়ার পাঁচ ছেলে ও সিদ্দিক মোল্লার তিন ছেলে ইসলামী ও আধুনিক উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত। আকরাম লিখেছে আমরা পাঁচ ভাইয়ের মধ্যে চার ভাই হাফেয ও এক ভাই দাওরা পাস।

তন্মধ্যে আমি গওহার ডাঙ্গা মাদরাসা থেকে হাফেজি ও কিতাবাদি শেষ করে আলিয়া থেকে দাখিল ও আলিম পরীক্ষায় যথাক্রমে ৬ষ্ঠ ও ১৭তম স্থান অধিকার করে উত্তীর্ণ হই এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এম এ ডিগ্রি লাভ করি। আমার সর্বকনিষ্ঠ ভাই হাফেয অহিরুজ্জাম্মান ১৯৯৫-'৯৬ সালের দিকে বোম্বাইতে চাকরি করা অবস্থায় মারা যায়। দু'টি বোন জাহানারা, রওশন আরা ও এক ভাই আকরামুজ্জামান (ডাক নাম কুনু মিয়া) শিশুকালে মারা যায়। বর্তমানে আমরা চার ভাই মাওলানা মনীরুজ্জামান (দাওরা), হাফেয আসাদুজ্জামান, মাওলানা হাফেয আকরাম ফারূক (হাফেয এম এ আরবী) ও হাফেয ফরহাদুজ্জামান (বি এ) কৃষি বিভাগে চাকরিরত) বেঁচে আছেন।

আকরাম ফারূক তার সংক্ষিপ্ত আত্মচরিতে নিজের সম্পর্কে লেখেন-
আমার শৈশব ও লেখাপড়া: শিশুকালে আমি মায়ের কাছেই পবিত্র কুরআন নাজেরা খতম ও আমপারা মুখস্থ করি। গ্রাম্য পাঠশালা প্রথমে চৌধুরী বাড়ি, পরে সফিউল্লাদের বাড়ি, পরে শফি শিকদারে বাড়ি এবং পরে নিজেদের বাড়িতে কুরআন শরীফ নাজেরা পড়ি। আমার মা এক সময়ে পাড়ার মেয়েদের কুরআন পড়াতেন। আমাদের বাড়িতে মকতব ছিল। পরে উদাপুর মাদরাসায় ভর্তি হয়ে আড়াই বছরে ১৪ পারা হেফজ করি। এই সময়ে উদয়পুরে দুই বাড়িতে ও গাওফায় এক বাড়িতে লজিং থাকি। বাড়ি থেকে মাদরাসা দূরে হওয়ায় মাদরাসার হুজুররা আমার অল্পবয়স দেখে যাতায়াতের কষ্ট লাঘব করার উদ্দেশে লজিং করে দেন। পরে গওহর ডাঙ্গা পারা হেফজ শেষ করি এবং অত্যন্ত সুনাম ও কৃতিত্বের সাথে হাফেজি শেষ করি। পরে ঐ মাদরাসাতেই উচ্চতর জামায়াতসমূহের (হেদায়া পর্যন্ত) পড়ি। চোখের সমস্যা দেখা দেয়ায় শেষ জামায়াত পর্যন্ত পড়তে পারিনি। হেফজ মেশ করার পর কয়েক বছর সাতক্ষীরা জেলার কালিকাপুর, রঘুনাধপুর, রামনগর, জয়নগর প্রভৃতি গ্রামে আমার সেজ মামার পরিচিতির সুবাদে রমযান মাসে খতম তারাবী পড়াতাম। খতম তারাবীর জামাতে ওয়াজ করতে করতে বক্তৃতায় পারদর্শিতা লাভ করি। বিশেষত উল্লেখিত নামসমূহ থেকে কাদিয়ানিদের ক্রমবর্ধমান প্রভাব প্রতিপত্তি দূর করতে প্রচুর অবদান রাখি।

গওহর ডাঙ্গা মাদরাসায় অবস্থাকালে মাদরাসার প্রতিষ্ঠাতা মাওলানা শামসুল হক ফরিদপুরীর অত্যন্ত প্রিয় পাত্র ছিলাম। কিছুদিন তার বাড়িতে লজিংও ছিলাম। ‘বেহেশতী জেওর', ‘বোখারী শরীফ' ও বহুসংখ্যক বাংলা ইসলামী পুস্তকের লেখক ও অনুবাদক এবং লালবাগ মাদরাসার প্রতিষ্ঠাতা মাওলানা শামসুল হক ফরিদপুরী আমাকে খুবই স্নেহ করতেন। দুঃখের বিষয়, চোখের অসুখের কারণে আমার মাদরাসার পড়াশুনা অসম্পূর্ণ রাখতে বাধ্য হই এবং তিনি যেমন আশা করতেন, তেমনি বড় আকারের মাদরাসার ডিগ্রি লাভ করতে পারিনি।

গওহর ডাঙ্গা মাদরাসা ত্যাগ করার পর আমি পর্যায়ক্রমে নতুন ঘোষগাড়ি মাদরাসা, যশোর রেলস্টেশন মাদরাসা, খুলনা বানিয়া খামার পশ্চিম পাড়া হাফেজিয়া ইসলামিয়া স্কুলে শিক্ষকতা করি। একই সাথে এস এস সি পরীক্ষা দিয়ে পাস করার পর খুলনা সিটি কলেজ (নাইটে) থেকে এইচ এস সি পাস করি।

ঢাকা আগমন : অতঃপর ১৯৬৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে অনার্সে ভর্তি হই এবং দু'বার পড়াশুনা করি। (বর্তমান প্রজাতন্ত্রীর সংসদ বিষয়ক উপদেষ্টা সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী আমার অন্যতম সহপাঠী।) এই সময় শহীদ আব্দুল মালেকের ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্য লাভ করি। তৎকালে আমি জামায়াতে ইসলামীর একমাত্র মুখপাত্র ‘জাহানে নও'-এ খন্ডকালীন কর্মরত সাংবাদিক ছিলাম এবং শহীদ আব্দুল মালেক ও মাওলানা সাইয়্যেদ আবুল আলা মওদূদীর একাধিক সাক্ষাৎকার গ্রহণ করি।

আমার শিক্ষা জীবনের কয়েকটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা :
১. গওহর ডাঙ্গা মাদরাসা (গোপালগঞ্জ জেলার টুঙ্গীপাড়া থানায় অবস্থিত) থেকে মাত্র ১১ বছর বয়সে যখন হাফেজি শেষ করি, তখন ঐ মাদরাসার ইতিহাসে সবচেয়ে কম বয়সী ও সুদক্ষ হাফেয হিসেবে খ্যাতি অর্জন করি। হাফেজি শেষ করার পর প্রত্যেক জামায়াতে সবসময় প্রথম হতাম এবং বাৎসরিক পুরস্কার পেতাম। হাফেজি শেষে যে বছর দেস্তারবন্দী (আগত পরানোর অনুষ্ঠান) হয়, সে বছর বাৎসরিক মাহফিলে মাওলানা মুফতি দ্বীন মুহাম্মদ আমাকে পাগড়ী পরান। খুবই ছোট ছিলাম বলে মাহফিলের শ্রোতারা দূর থেকে আমাকে দেখতে না পাওয়ায় শোরগোল করলে মুফতী সাহেব আমাকে দুই হাত দিয়ে উঁচু করে দেখান।

২. গওহর ডাঙ্গা মাদারাসার বোখারীর অধ্যাপক মুহাদ্দিস আবুল হাসান যশোরী আমার চাচাতো ভগ্নিপতি ছিলেন। তার বোখারীর ক্লাসে আমাকে উপস্থিত রাখতেন এবং কিতাবুত তাফসীরে আয়াতের যেসব অংশ থাকতো, তা আমাকে শুনিয়ে পুরো আয়াত মুখস্ত পড়তে বলতেন। আমি এ কাজটি অত্যন্ত সুষ্ঠুভাবে করে দিতাম বলে তিনি চমৎকৃত হতেন। তিনি অবাক হয়ে বলতেন, (আলহামদু লিল্লাহ) আয়াতাংশের পরের টুকুতো অনেকেই বলে দিতে পারে। তুই তার আগেরটুকু কি করে বলে দিস?

৩. প্রায় বারেই রমযানে মাওলানা শামসুল হক ফরিদপুরী ঢাকার লালবাগ মাদরাসা থেকে ছুটি কাটাতে বাড়ি যেতেন এবং গওহর ডাঙ্গা মাদরাসায় আমরা যে দু'জন খতম তারাবী পড়াতাম, বাদ যোহর তাদের প্রতিদিনের তারাবীর পাঠতব্য পারা শুনতেন। এ সময় মাদরাসার বহু ছাত্র ও শিক্ষক উপস্থিত থাকতো। মাওলানা শামসুল হক পারা শুনতেন এবং জায়গায় জায়গায় তাফসীর করতেন। একদিন এক আয়াতের তাফসীর প্রসঙ্গে সূরা লুকমানের অন্য একটি আয়াত পড়তে চেষ্টা করছিলেন কিন্তু কিছুতেই মনে করতে পারছিলেন না। পরে আয়াতটির বাংলা অনুবাদ বলার সাথে সাথে আমি আয়াতটি বলে দিলাম। এতে তিনি অবাক হয়ে বললেন, তুমি কিভাবে অনুবাদ শুনে আয়াতটি বলে দিলে? আমি তখনো তরজমা বা তাফসীর পড়িনি তবে অল্প অল্প আরবী শিখা শুরু করেছি। আমি বললাম- আপনি যখন বাংলা অনুবাদ বলছিলেন তখন আমি মনে মনে ঐ বাংলা শব্দের আরবী করতেই আয়াতটি আমার মনে এসে গেল। আজও আমি আয়াতের অনুবাদ থেকে তারাবী অনুবাদের পদ্ধতিতে মূল আয়াত উদ্ধারের চেষ্টা করে থাকি এবং প্রায়ই আয়াত পেয়ে যাই। সূরা লুকমানের আয়াতটি ছিল- ইয়া বুনাইয়া ইন্নাহা ইনতাকু মিছক্বালা হাববাতিন মিন খারদালিন... আয়াত নং-১৬।

আকরাম ফারূকের সংক্ষিপ্ত ও অসমাপ্ত আত্মজীবনী এখানেই শেষ। আকরাম ফারূকের সংক্ষিপ্ত আত্মজীবনী পর্যালোচনা করলে দেখা যায় শৈশবকাল থেকেই তিনি ছিলেন অসাধারণ মেধা, প্রজ্ঞা ও ধীশক্তির অধিকারী। মাত্র ১১ বছর বয়সে কুরআন মাজীদ আদ্যেপান্ত মুখস্থ করা সহজ কাজ নয়, কিন্তু আকরাম ফারূক এই কঠিন কাজটি কেবল সম্পন্নই করেনি, বরং এ ক্ষেত্রে অসাধারণ মেধা ও কৃতিত্বের পরিচয় দিয়েছেন। সাধারণত একজন হাফেজ একটা আয়াতের পরবর্তী আয়াতটি কি তা বলে দিতে পারে কিন্তু আকরাম ফারূক ছিল এ ক্ষেত্রে রীতিমতো ব্যতিক্রম। যে মাদরাসার কুরআন মাজীদ হাবস করেছিলেন সেখানে চূড়ান্ত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার জন্য একজন ছাত্রকে একটা আয়াত বলে দিয়ে তার আগের আয়াত কি তা শুনাতে হতো। এ কাজটি মোটেই সহজ নয় রীতিমতো অসাধারণ। কারণ একটা আয়াতের পরবর্তী আয়াত কি তা যে কোন হাফেজ এক নিমেষে বলে দিতে পারে। কিন্তু এ আয়াতের আগের আয়াত বলে দেয়ার মতো হাফেজের সংখ্যা নগণ্য। এখান থেকেই আকরাম ফারূকের অসাধারণ মেধা ও ধীশক্তির পরিচয় পাওয়া যায়।

আকরাম ফারুকের আত্মজীবনী পর্যালোচনা করলে দেখা যায় তার মাদরাসা শিক্ষা দাখিল এবং আলিম পাসের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। অবশ্য এ দু'টি শ্রেণীর চূড়ান্ত পরীক্ষায় আকরাম মেধার স্বাক্ষর রেখেছে। দাখিল পরীক্ষায় ৬ষ্ঠ ও আলিম পরীক্ষায় ১৭তম স্থান অধিকার করতে সমর্থ হন। তার প্রাতিষ্ঠানিক এবং আনুষ্ঠানিক মাদরাসা শিক্ষা এখানেই শেষ। কিন্তু তার পরবর্তীকালে কর্মকান্ড, লেখালেখি এবং বিশেষ করে দুরূহ আরবী ভাষা থেকে বাংলায় অনুবাদ করে আকরাম ফারূক রীতিমতো তাক লাগিয়ে দিয়েছেন। অর্থাৎ দেখা যায় আলিম পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার পর ফাজিল এবং কামিল শ্রেণীতে ভর্তি না হলেও তার ব্যক্তিগত অধ্যয়ন বন্ধ ছিল না। ব্যক্তিগত পর্যায়ে তিনি উর্দু, ফারসী এবং আরবী ভাষা আয়ত্ব করার জন্য সীমাহীন চেষ্টা সাধনা চালান। ১৯৬৮ সালে ঢাকা শহরে আগমন করে আকরাম ফারূক বসে ছিলেন না। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে সম্মান শ্রেণীতে ভর্তি হন এবং সাপ্তাহিক জাহানে নও পত্রিকায় খন্ডকালীন চাকরিও করেন। খুব সম্ভব সাপ্তাহিক জাহানে নও পত্রিকায় কর্মরত অবস্থায় মরহুম মাওলানা মুহাম্মদ আব্দুর রহীম এবং উক্ত পত্রিকার সম্পাদক মরহুম হাফেজ হাবিবুর রহমানের সংস্পর্শে থেকে  তিনি বাংলাভাষা চর্চা ছাড়াও আরবী এবং উর্দুভাষা রপ্ত করার সুযোগ পান।

উপরোক্ত দু'জন মনীষীই ছিলেন উর্দু এবং আরবী ভাষায় সুদক্ষ লেখক ও অনুবাদক। তাদের নিকট থেকেই বন্ধু আকরাম বাংলা ভাষায় সাহিত্য চর্চা এবং উর্দু ও আরবী ভাষা থেকে বাংলায় অনুবাদের দীক্ষা ও প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেছিলেন। সাপ্তাহিক জাহানে নওতে কাজ করার সময় হাফেজ হাবিবুর রহমান এবং হাফেজ আকরাম ফরূক যে মাদরাসায় পড়ুয়া বা উর্দু, আরবী ভাষায় জানেন তা বুঝার সুযোগ ছিল না। ১৯৬৪ সালে ঢাকা আগমন করার পর সাপ্তাহিক জাহানে নও পত্রিকায় আমার যাতায়াত ছিল নিয়মিত। বলা চলে আমি ছিলাম সাপ্তাহিক জাহানে নও এর নিয়মিত লেখক। এছাড়া দৈনিক আজাদ, দৈনিক পয়গাম, দৈনিক পাকিস্তান, মাসিক মাহে নও এবং মাসিক মোহাম্মদী ও মাসিক মদীনায় আমার যাতায়াত ছিল এবং এ সকল পত্রিকায় নিয়মিত, অনিয়মিত আমার লেখা ছাপা হতো। বিশেষ করে সাপ্তাহিক জাহানে নও এর প্রায় প্রত্যেক সংখ্যায় আমার কোন না কোন লেখা থাকত। দৈনিক পাকিস্তান ইতিহাসের পাতা থেকে শিরোনামে একটা ফিচার পাতা প্রকাশিত হতো। এই ফিচার পাতা সম্পাদনা করতেন কবি ও সাহিত্য সমালোচক মুহাম্মদ মাহফুযউল্লাহ। তার সঙ্গে পরিচয় এবং সম্পর্কের পর ইতিহাসের পাতা থেকে ফিচারে প্রায় প্রতি সংখ্যার আমার লেখা থাকত এমনকি কোন কোন দিন একই সংখ্যা একাধিক লেখাও ছাপা হতো।

বিশেষ  করে ১৯৬৯-৭০ সালের দিনগুলোতে দৈনিক পাকিস্তানে প্রকাশিত লেখার সম্মানাই ছিল আমার জীবিকা নির্বাহের প্রধান উপকরণ। উক্ত পত্রিকার সুবাদেই ব্যাংকের সঙ্গে আমার পরিচয় হয়। ১৫৫ টাকার ১টা চেক আমার হাতে তুলে দিলে আমি অবাক হয়ে বললাম, এটা দিয়ে আমার কি হবে? আমার তো টাকা দরকার। হিসাব বিভাগের কর্মকর্তা জনৈক হিন্দু বাবু হেসে বললেন, আমরা নগদ টাকা দেই না। আপনাকে নিজের নামে ব্যাংকে একটা একাউন্ট খুলতে হবে। এ চেক আপনার একাউন্টে জমা দেয়ার পর ব্যাংক অপনাকে একটা চেক বই দিবে আপনি চেকের মাধ্যমে ব্যাংক থেকে টাকা তুলতে পারবেন। এই চেকটি ছিল তৎকালীন জিন্নাহ এভিনিউস্থ রুবি এলএ।

১৯৭০ সালের শেষের দিকে বা ১৯৭১ সালের প্রথম দিকে আকরাম ফারূকের নামে একটা চটি বই প্রকাশিত হয়। বইটির নাম ছিল ইসলামের শক্তির উৎস উর্দু নাম ইসলাম কা সর চাশমায়ে তাকাত লেখক সাইয়্যেদ আবুল আলা মওদূদী অনুবাদক হাফেজ আকরাম ফারূক। এর কিছুদিন পর আরও একটা চটি বই প্রকাশ পায়। বইটির নাম ‘জামায়াতে ইসলামীর ২৯ বৎসর' এটি মাওলানা মওদূদীর একটা বক্তৃতা। এ দু'টি চটি বই প্রকাশিত হওয়ার পর দীর্ঘদিন আকরাম ফারূক আর লেখালেখির জগতে গায়েব তার কোন খবর নেই। এখানে উল্লেখ্য যে, সাপ্তাহিক জাহানে নও পত্রিকায় কাজ করার সময় একদিন কথার ছলে তিনি বলেছিলেন, আমি সাইয়্যেদ কুতুব শহীদ রচিত ‘ফী হিলালীর কুরআন' তাফসীর গ্রন্থ বাংলা ভাষায় অনুবাদ করব। আকরাম ফারূকের মুখে এ কথা শুনে পরবর্তীকালে ‘ফী হিলারীর কুরআন' বাংলা অনুবাদের প্রকাশক হাফেজ মুনীরুদ্দীন আহমদ সেদিন মন্তব্য করেছিলেন আকরাম ফারূকের জন্য এমন কথা মুখে উচ্চারণ করাই নাজায়েয। কিন্তু পরবর্তীকালে সেই হাফেয মুনিরউদ্দিন আহমদ ফী যিলালিল কোরআন বাংলা অনুবাদের উদ্যোগ গ্রহণ করলে তার মুখেই শোনা গেছে যে, এ তাফসীরের অনুবাদকদের মধ্যে আকরাম ফারূকের অনুবাদই সর্বোত্তম। এ থেকে বুঝা যায় যে, আকরাম ফারূক বসে ছিলেন না। নিজের চেষ্টায় উর্দু এবং আরবী ভাষা আয়ত্ত করার কাজে তিনি লেগেছিলেন। ১৯৭৭-৭৮ সালের দিকে ঢাকায় সৌদি দূতাবাস চালু হলে বন্ধুবর আকরাম ফারূক অনুবাদক হিসেবে যোগদান করেন।

১৯৭৯ সালে সৌদি দূতাবাসে অনুবাদক হিসেবে  কাজ করতে গিয়ে সৌদি রাষ্ট্রদূত ফুয়াদ আব্দুল হামিদ আল খতিবের মুখে বন্ধুবর আকরাম ফারূকের কথা শুনতে পাই। সেদিন তিনি দুঃখ করে বলেছিলেন, আমি একজনকে কাজ শিখিয়েছিলাম কিন্তু সে থাকলো না আমাকে ছেড়ে চলে গেলো আমি উৎসুক হয়ে লোকটির নাম খুঁজে বের করলাম। বন্ধুরা, বললো, সে ছিলো হাফেয আকরাম ফারূক তখন এ কথাও জানতে পারলাম যে, আকরাম ফারূক সৌদি দূতাবাসে থাকাকালেই মরক্কো দূতাবাসের সঙ্গে তার যোগাযোগ হয় এবং পরবর্তীকালে আকরাম ফারূক মরক্কো দূতাবাসে যোগদান করে এবং দীর্ঘদিন উক্ত দূতাবাসে কর্মরত ছিলেন। অবশ্য তার বেয়াই সাংবাদিক শাহদাত হোসেনের মাধ্যমে জানতে পারি যে, জীবনের শেষ দিনগুলোতে আকরাম লিবীয় দূতাবাসে কর্মরত ছিলেন।

মরহুম হাফেয আকরাম ফারূক জীবনের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সর্বদা কর্মতৎপর ছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালে সাপ্তাহিক জাহানে নওতে খন্ডকালীন চাকরি জোগাড় করতে সক্ষম হন। ১৯৭২ সালের মাঝামাঝি সময়ে পুরান ঢাকার ১০৯ ঋষিকেশ দাস রোডে সাপ্তাহিক সোনার বাংলা অফিসে গিয়ে দেখি আকরাম ফারূক বসে কাজ করছেন, তাকে সেখানে কর্মরত দেখে আমি রীতিমতো অবাক হলাম। কারণ আমি ঢাকা শহরে বসবাস করেও সাপ্তাহিক সোনার বাংলার খবর রাখি না আর আকরাম ফারূক ঢাকা থেকে অনেক দূরে সুদূর গ্রামাঞ্চলে অবস্থান করেও যোগাযোগ ঠিকই রেখেছে এবং কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করে নিয়েছে। সাপ্তাহিক জাহানে নও এবং সাপ্তাহিক সোনার বাংলায় কাজ করার সুবাদে বন্ধুবর মাহবুবুল হকের প্রচেষ্টায় আব্দুল গাফফার চৌধুরী সম্পাদিত দৈনিক জনপদের সম্পাদকীয় বিভাগে যোগদান করেন। আকরাম ফারূক যে সদা তৎপর ছিলো এটাও  তার অন্যতম প্রমাণ। আকরাম ফারূকের কর্মজীবনের সবচেয়ে বড় সার্থকতা তার অনুবাদ কর্ম। দাখিল বা আলিম পাস করা তেমন উল্লেখযোগ্য কোনো কৃতিত্ব নয় এবং এ ধরনের ফাযিল, কামিল আর দাওরা পাস আলিমের অভাব নেই আমাদের দেশে। এমন পাস করা আলিম শত শত নয় বরং হাজার হাজার পাওয়া যায়। কিন্তু উর্দু বা আরবী থেকে বাংলা অনুবাদ করার মতো যোগ্য লোকের অভাব পূর্বেও ছিলো বর্তমানেও আছে এবং ভবিষ্যতেও থাকবে।

বর্তমানের শিক্ষার যে মান তাতে ভালো মানের আলিমের পক্ষেও সঠিক মান এবং উচ্চারণে উর্দু, আরবী গ্রন্থ অনুবাদ করা তো দূরের কথা, রিডিং পড়ার লোক খুঁজে পাওয়াও কঠিন। আকরাম ফারূকের জীবনী পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, ষাটের দশকের শেষ দিকে ঢাকা আগমনের পর থেকে কখনো সে বেকার ছিলেন না। বরং জীবনের শেষ সময় পর্যন্ত কর্মরত ছিলেন। বেশির ভাগ সময়ে কর্মরত ছিলেন বিদেশী দূতাবাসে। বিদেশী দূতাবাসে কাজ করা অন্যান্য দফতরে কাজ করার চেয়ে বেশ কঠিন। এখানে কাজে ফাঁকি দেয়ার সুযোগ নেই বললেই চলে। তাছাড়া মুসলিম দূতাবাসগুলোতে নির্ধারিত সময়ের চেয়ে বেশি কাজ করতে হয়। ছুটি ছাড়া এবং সুযোগ-সুবিধাও অন্যান্য দূতাবাসের তুলনায় অনেক কম। তারপরও দীর্ঘদিন দূতাবাসে কর্মরত থাকা বিরাট ধৈর্যের পরিচায়ক। তার চেয়েও বড় কথা অন্তত তিনটি ভাষায় দক্ষতা না থাকলে এই সব দূতাবাসে কাজ করা সম্ভব নয়। প্রথমত মাতৃভাষা ভালো জানতে হয়, আর দ্বিতীয়ত আরবী এবং ইংরেজী ভাষার অনুবাদে দক্ষতা অপরিহার্য। এক্ষেত্রে নিজের দক্ষতা প্রমাণ করতে পারছেন বলেই দূতাবাসে দীর্ঘদিন কাজ করা সম্ভব হয়েছে। মরহুম আকরাম ফারূকের বেয়াই সাংবাদিক শাহদাত হোসেনের কাছ থেকে জানা যায় যে, মরহুম আকরাম ফারুকের লিখিত ও অনূদিত গ্রন্থের সংখ্যা ৮৬টি। এ ছাড়াও বাসায় আরো পান্ডুলিপি থাকতে পারে। বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় বিভিন্ন সময় তার অনেক লেখা ছাপা হয়েছে। বিশেষ করে দৈনিক জনপদে কাজ করাকালে তাঁর অনেক সম্পাদকীয় এবং উপসম্পাদকীয় ছাপা হয়েছে। এসব লেখা সংকলন করলে আরো অনেক বই হবে। সেগুলো সংকলন করে প্রকাশের ব্যবস্থা করা তার সন্তানদের দায়িত্ব।

আকরাম ফারূকের বিশাল কীর্তি আলোচনা করার জন্য একটা প্রবন্ধ যথেষ্ট নয়। এ জন্য দরকার একটা পূর্ণাঙ্গ জীবনী গ্রন্থ প্রস্তুত করা। এ কাজ করার উপযুক্ত পাত্র তাঁর পুত্র এবং কন্যারা। আমি এ ব্যাপারে সহযোগিতা করতে প্রস্তুত। তাঁর সমগ্র কর্মের মূল্যায়নের জন্য প্রয়োজন পূর্ণাঙ্গ গ্রন্থের। আল্লাহর ইচ্ছা হলে এ কাজ সম্পন্ন হতে পারে। আমি মরহুমের রূহের মাগফিরাত কামনা করছি।

-আইনুন জারিয়া ও শারাবান তাহুরা, মরহুম হাফেয মাওলানা আকরাম ফারূক লিখিত ও অনুবাদকৃত বইসমূহ:
মৌলিক বইসমূহ:-
(১) ঈমাম হুসাইনের শাহাদত, (২) রমজানুল মুবারক, (৩) হাদীসের কিস্সা (১-৪ খন্ড), (৪) ইস্পাহান বিজয়, (৫) উজ্জীবিত ঈমানের ইতিকথা, (৬) বীর মুজাহিদ যুগে যুগে, (৭) ইসলামের দৃষ্টিতে চরমপন্থা।

অনুবাদকৃত বইসমূহ:-
(১) সীরাতে ইবনে হিশাম, (২) কবীরা গুনাহ, (৩) মানবতার বন্ধু মুহাম্মদ (সাঃ), (৪) ইসলাম প্রচারের হৃদয়গ্রাহী পদ্ধতি, (৫) তাফসীর ফী যিলালিল কুরআন (১-২২ খন্ড),

(২৭) নারী অধিকার, (২৮) ইসলামী সভ্যতার অবদান, (২৯) ফিকহ্স্ সুন্নাহ (১-৩ খন্ড), (৩২) রাসায়েল ও মাসায়েল (৩য়-৭ম খন্ড), (৩৭) উপমহাদেশে স্বাধীনতা আন্দোলন ও মুসলমান (১ম ও ২য়), (৩৯) মওদূদী রচনাবলী (২য় খন্ড), (৪০) তারগীব ও তারহীব (১-৩য় খন্ড), (৪৩) আল জিহাদ, (৪৪) ইসলামী রাষ্ট্র ও সংবিধান, (৪৫) মুসনাদে আহমদ (১ম খন্ড), (৪৬) রাহে আমল (১-২ খন্ড), (৪৮) শিক্ষা ব্যবস্থা : ইসলামী দৃষ্টিকোণ, (৪৯) বাংলাদেশ পুলিশ রেগুলেশন্স, (৫০) ইসলামের শক্তির উৎস, (৫১) সীরাতে সরওয়ারে আলম (১ম খন্ড), (৫২) ইসলাম ও পাশ্চাত্য সভ্যতার সংঘাত, (৫৩) ইসলাম ও পাশ্চাত্য সমাজে নারী, (৫৪) ইসলামী দাওয়াত ও তার দাবী, (৫৫) তাকদীরের হাকীকত, (৫৬) মোগল ইতিহাস, (৫৭) একটি সত্যনিষ্ঠ দলের প্রয়োজন, (৫৮) মাওলানা মওদূদীর সাক্ষাৎকার, (৫৯) মহানবীর নৈতিক বিপ্লব, (৬০) ফিকাহ বিশ্বকোষ (১ম খন্ড), (৬১) তাফসীরে ইবনে আববাস (১ম ২য় খন্ড), (৬৩) সীরাতুন নবী-ইবনে হিশাম (১ম ২য় খন্ড), (৬৫) আহকামুল কুরআন (২য় খন্ড), (৬৬) মানবাধিকার, (৬৭) মাওলানা মওদূদীকে যেমন দেখেছি, (৬৮) ইসলামের স্বর্ণযুগ সামাজিক ন্যায়নীতি, (৬৯) কিয়ামত ও আখিরাত, (৭০), ইসলামের ভিত্তি পুনর্গঠন, (৭১) ৪০ জন সেরা ইসলামী ব্যক্তিত্ব (সংকলন মানবতার বন্ধু), (৭২) সীরাতুন নবী ইবনে হিশাম (৩য়, ৪র্থ খন্ড), (৭৪) ইসলামী আন্দোলন : অগ্রযাত্রার প্রাণ শক্তি।

পান্ডুলিপি খোয়া গেছে এমন বই
(১) ইসলামের সামাজিক ন্যায়-নীতি (সাইয়েদ কুতুব), (২) পথের দিশা (সাইয়েদ কুতুব), (৩) জামায়াতে ইসলামীর ২৯ বছর (মাওলানা মওদূদী), (৪) '৭১-এর স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রেক্ষাপট (মৌলিক গ্রন্থ), (৫) মেডিকেল আইন, (৬) কুরআনের ৪টি মৌলিক পরিভাষা (ছাপা হয়নি), (৭) কুদুরী (ছাপা হয়নি), (৮) সীরাতুল মুস্তফা (ছাপা হয়নি।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ