বৃহস্পতিবার ০২ মে ২০২৪
Online Edition

পঞ্জিকার ধারাবাহিকতা রক্ষার আশ্বিন এলো

সাদেকুর রহমান : বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের পর্যবেক্ষণাধীন সকল নদীর পানি সমতল বিপদসীমার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। ব্রহ্মপুত্র-যমুনা ও গঙ্গা নদীর পানি সমতল বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং পদ্মা ও মেঘনা নদীর পানি সমতল হ্রাস পাচ্ছে। গতকাল সোমবার কেন্দ্রের পূর্বাভাসে বলা হয়, আগামী ৪৮ ঘণ্টায় ব্রহ্মপুত্র-যমুনা, গঙ্গা-পদ্মা নদীর পানি সমতল সামান্য বৃদ্ধি অব্যাহত থাকতে পারে এবং মেঘনা নদীর পানি সমতল হ্রাস অব্যাহত থাকতে পারে। আগামী ৭২ ঘণ্টায় ঢাকা শহর সংলগ্ন নদীসমূহের (বুড়িগঙ্গা, বালু, তুরাগ,টঙ্গী খাল) পানি সমতল হ্রাস অব্যাহত থাকতে পারে। বন্যার দাপট কমতে থাকলেও কবলিত জনপদে দুর্ভোগ কমছে না। বৃষ্টিপাত হ্রাস পাওয়ায় ভ্যাপসা গরমও বেশ ভোগাচ্ছে।
জলবায়ু পরিবর্তনজনিত নানা বৈপরীত্যের মধ্যেও বঙ্গাব্দ পঞ্জিকার ধারাবাহিকতা রক্ষার স্বার্থে (!) আজ মঙ্গলবার থেকে আশ্বিন শুরু হলো। ‘হাস্যময়ী’, লাস্যময়ী’ শরতের দ্বিতীয় তথা শেষ মাস এটি।  ভাদ্রের শেষ দিনে আকাশজুড়ে সাদা-কালো মেঘের লুকোচুরি খেলার চেয়ে গুমোট ভাবটাই দৃশ্যমান ছিল। “হিমের শিহর লেগেছে আজ মৃদু হাওয়ায়/ আশ্বিনের এই প্রথম দিনে/ ভোর বেলাকার চাঁদের আলো/ মিলিয়ে আসে শ্বেত করবীর রঙে”- এমন  কাব্যকথা যেনো জলবায়ু পরিবর্তনের বৈরিতায় কেবলি আবেগময় পঙক্তিমালায় পরিণত হতে বসেছে। মওসুমী ঠান্ডা বায়ুপ্রবাহ এখনো শুরু হয়নি। তবে অনেক ব্যত্যয়ের পরও আহ্নিক গতি ও বার্ষিক গতির ভারসাম্য বজায় রাখার চিরন্তন নিয়মে দিনের পরিধি ক্রমশ ছোট হচ্ছে, বড় হচ্ছে রাত। এ পরিবর্তনের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ শীতের শাকসবজি ইতোমধ্যে বাজারে উঠতে শুরু করেছে।
আবহাওয়ার ছন্দপতন সত্ত্বেও মধ্য আশ্বিনের পর থেকেই হয়তো স্বচ্ছ শিশির ভিজিয়ে দেবে তৃণরাজি, বৃক্ষরাজির সবুজ পাতা আর বৈচিত্র্যময় মাটি। মওসুমী ধুনকারেরা দল বেঁধে নেমে পড়বে লেপ, তোষক, জাজিম ইত্যাদি শীত নিবারণী সামগ্রী বানাতে। প্রভাতী শিশির মনে আনবে অপার্থিব প্রফুল্লতা ও সজীবতা। কোমল রূপালী জোছনায় শিহরিত হবে মানবমন। এই মাসের আরেক লক্ষণীয় দিক হলো, বাংলা পঞ্জিকায় ৩০ দিনের মাস এ থেকেই শুরু হয়। প্রথম পাঁচটি মাস ‘একত্রিশা’ হয়ে থাকে।
পূর্ববর্তী মাসগুলোর মতো বঙ্গাব্দের ষষ্ঠ তনয়া এই আশ্বিনেও স্নিগ্ধতার আমেজের যথেষ্ট ঘাটতি রয়েছে। বিস্তৃত কাশবনেও কেন জানি প্রাণহীনতা বিরাজ করছে। তারপরও বাংলার আকাশ আর জমিনকে ঘিরে রূপ বদলের  অনাড়ম্বরও আয়োজন শুরু হয়ে গেছে। শিশু-কিশোরদের দুরন্তপনায়ও নতুন মাত্রা যোগ হয়েছে। কাশবনে ‘টুক পলান্তি’ খেলা কিংবা ঘুড়ি উড়িয়ে সাদা মেঘ, নীলাকাশ ছোঁয়ার বাসনাকেই যেন জানান দেয় ওরা। দিনময় বাধাহীন দুষ্টুমী করে যখন ওরা বাড়ি ফেরে, সেই সাঁঝ বেলায় অবগুণ্ঠন মোচন করে ফুটে ওঠে আর নিকষ রাতের অবসানে কপালে লাল টিপ পরে বৃন্তচ্যুত হয়ে মাটির বুকে ঝরে পরে ছোট ফুল ‘শিউলী’। মনোহারিণী জর্দা রঙা এই ফুলের আরেক নাম ‘শেফালী’। বর্ষার বিস্তীর্ণ পানির আধারে জন্মানো শাপলা ফুল এখনো সৌন্দর্য বিলাবার চেষ্টা করছে। জাতীয় ফুলটির ডাটি সুস্বাদু সবজি হিসেবেও নাগরিকদের রসনা তৃপ্ত করছে। মধ্য আগস্ট থেকে শুরু হওয়া বন্যার পানি দুর্গত এলাকার জন্য অভিশাপ হয়ে দাঁড়ালেও পাট জাগ দেয়ায় বেশ কাজ দিচ্ছে বৈকি। কৃষককূল অর্থনৈতিক ফসল পাট পচিয়ে আঁশ ছাড়াতে পেরে স্বস্তি বোধ করছে। এর আগে কৃষকরা পানির অভাবে পাট জাগ দিতে না পেরে বিড়ম্বনার মুখোমুখি হয়েছিল।
ওদিকে, এ মাসে পানির উৎস ধারা স্বচ্ছ থেকে স্বচ্ছতর হতে থাকে। কৃষিপ্রধান বাংলাদেশে কৃষক সমাজকে কালে কালে আশ্বিন মাস প্রভাবিত করেছে। খনার বচনে আছে, “ভাদ্রের চারি আশ্বিনের চারি/কলাই বুনি যত পারি”। অর্থাৎ ভাদ্র মাসের শেষ চার দিন এবং আশ্বিনের প্রথম চার দিন মাসকলাই চাষের জন্য উপযুক্ত সময়। অন্যদিকে, এ সময় ধান লাগালে একেবারেই ফলন হয় না। লোকগীতিতে এসেছে, “আশ্বিন মাসেতে ভাইরে পাটের দর ভাও/পাট বেইচ্যা গিরস্থের কিনলো দৌড়ের নাও”। আশ্বিন মাসে শসার আসল স্বাদ পাওয়া যায় বলে এর চাহিদাও বেড়ে যায়। 
আশ্বিন মাস ধর্মীয় ও লোকাচারের এক উত্তম সময় বলে বিবেচ্য। হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকেরা তাদের বৃহত্তর আচার দুর্গাপূজা পালন করে থাকে। হিন্দু বিধবারাও এ মাসে বিশেষ পূজা করে। আরও উল্লেখ আছে লোককাব্যে, “আশ্বিন মাসে হে কন্যা অষ্টমী/ধান দুর্বারে করে পূজা ব্রাহ্মণী”। বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্প কর্পোরেশন (বিসিক) কর্তৃক ১৩৯০ বঙ্গাব্দের বৈশাখে প্রকাশিত ‘বাংলাদেশের মেলা’ শীর্ষক গ্রন্থে উল্লেখ করা হয়েছে, শারদীয় আশ্বিন মাসে সারা দেশে ৮২টি গ্রামীণ মেলা বসে। এর মধ্যে ৭১টিই দুর্গাপূজা উপলক্ষে। বাকিগুলো বসে আশ্বিনী পূর্ণিমা, বার্ষিক ওরশ ও নৌকা বাইচকে কেনদ্র করে। কালের পালা বদলে এসব মেলার ঐতিহ্য-জৌলুস অনেকটাই আজ হারিয়ে গেছে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে আশ্বিনের প্রকৃতি-বৈভব অনেকটাই ম্লান হয়ে গেছে।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ