শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪
Online Edition

বাঙ্গালী জাতির উৎপত্তি ও ক্রম বিকাশ

আহমদ মনসুর : আমরা নিজদেরকে বাঙ্গালী বলে গৌরব বোধ করি। কিন্তু অনেকেই বাঙ্গালী জাতির ইতিহাস জানতে  চেষ্টা করে না , যা সত্যই খারাপ। প্রাচীন কালে  বাংলাদেশ বলতে কোন নাম ছিল না। বাংলাদেশ বলতে এখন যে অঞ্চলটি বুঝায় , তখন সে অঞ্চলে কোন অখ- রাজ্য ও ছিল না । এদেশ তখন অনেক গুলো ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাজ্যে বিভক্ত ছিল এবং রাজ্যগুলো বিভিন্ন জনপদ বা রাষ্ট্র নামে অভিহিত হতো। 
আনুমানিক খ্রীষ্টীয় ষষ্ঠ শতক পর্যন্ত বঙ্গ বিভিন্ন জনপদের সমষ্টি ছিল । অষ্টম শতক হতে সব জনপদ ও বিভাগ  বঙ্গ জনপদের সঙ্গে একীভূত হয়ে যায়। মুসলিম শাসন পূর্বযুগে বঙ্গের যেমন সুনির্দিষ্ট রাষ্ট্রীয় সীমারেখা ছিল না , তেমনি একটি পরিপূর্ণ জাতি হিসেবেও বাঙ্গালীদের আত্মপ্রকাশ ঘটেনি। ইলিয়াস শাহের  শাসনামলের পুর্ব পর্যন্ত এ অবস্থা প্রচলিত ছিল । 
ঐতিহাসিক মিনহাজ মুসলিম শাসনামলে ( ১২৪২- ১২৪৪) লাখনৌতিতে আগমন করেন। তার বিবরণে জানা যায় যে, বং বা বাঙ্গালা এবং লখনৌতি (গৌড়) দু’টি পৃথক দেশ ছিল । চতুর্দশ শতকের মাঝামাঝি সময়ও বাঙ্গালা বলতে পূর্ব ও দক্ষিণ বঙ্গের ভূখ-কেই বুঝাতো। লখনৌতি তখনও পর্যন্ত বাঙ্গালার সীমা রেখার বাইরে ছিল। 
ইবনে বতুতার  বর্ণনানুযায়ী মুসলিম শাসনের আগ পর্যন্ত যে বাঙ্গালীরা নিজদেরকে গৌড়িয় বলে পরিচয় দিতে গর্ব বোধ করত, তারা মুসলিম শাসনামলে বাঙ্গালী জাতি হিসেবে আত্মপ্রকাশ  করতে থাকে।  
১৩৩৮ সালে ফকরুদ্দীন মুবারক শাহ সোনার গাঁওয়ের শাসন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকে দিল্লীর মুসলিম সালতানাতের প্রতি নামে মাত্র আনুগত্যের বন্ধন ছিন্ন করেন । বাঙ্গালার জনগণ তখন বাঙ্গালী নামে পরিচিত ছিল ।
প্রথমদিকে ইলিয়াস শাহ লখনৌতি বা লক্ষণাবতীর শাসক হিসেবে আবির্ভুত হন। এরপর সুলতান শামসুদ্দীন ইলিয়াস শাহ ‘লাখনৌতি’ ও ‘বঙ্গদেশকে’ একত্রিত করে এই যুক্ত অঞ্চলকে নাম দেন ‘বাঙ্গালাহ’ এবং এর অধিবাসীদের নাম দেন ‘বাঙালি’। আর তিনি নিজে  শাহ- ই বাঙালাহ উপাধি ধারণ করে স্বাধীন ভাবে বাঙ্গালীদের জাতীয় শাসক হিসেবে শাসন কার্য পরিচালনা করেন। এতে দুই ভূখ-ের স্বাতন্ত্র্য যেমন বিলুপ্ত হল , তেমনি বাঙ্গালা বা বঙ্গ নামটি একক ভাবে আত্মপ্রকাশ করল।
 বাংলার এই স্বাধীনতা একাধারে দুইশত বছর চলেছিল । ইলিয়াস শাহী বংশের সুলতানেরা ‘ খলিফাতুল্লাহে বিল হুজ্জতে ওয়াল বুরহান ’উপাধি গ্রহণ করেন। ইসলামী শাস্ত্র ও ইসলামী আইনের মাধ্যমেই শাসন কার্য পরিচালিত হত বিভিন্ন শিলালিপি এবং মুদ্রায় প্রাপ্ত সুলতানদের উপাধি দৃষ্টে মনে হয় যে সুলতানেরা ইসলামের বিধি বহির্ভুত কোন আইন প্রণয়ন করতেন না।
ইলিয়াস শাহই প্রথম বাঙ্গালী অধ্যুষিত সকল অঞ্চলের সমন্বয়ে বাঙ্গালা বা বঙ্গ গঠন করেন -যার সীমানা ছিল তেলিয়াগড়ি থেকে চট্টগ্রাম এবং হিমালয়ের পাদদেশে থেকে বঙ্গোপসাগর পর্যন্ত । এ সময় থেকেই বঙ্গদেশ এবং বাঙ্গালী  জাতির নবতর ইতিহাস যাত্রা শুরু।
অতএব দেখা যায় যে, মুসলিম শাসনামলেই বাঙ্গালা এবং বাঙ্গালীর সুনির্দিষ্ট অস্তিত্ব আত্মপ্রকাশ করে। কালের পটপরিবর্তন ও রাজনৈতিক উত্থান পতনের কারণে বঙ্গের সীমারেখা পরিবর্তন ঘটেছে সত্যি , কিন্তু বাঙ্গালা ও বাঙ্গালীর ঐতিহ্য কখনো নি®প্রভ হয়নি। ষোড়শ -সপ্তদশ-– অষ্টদশ শতকের পাশ্চাত্যের বণিকদের দলিল পত্রে বঙ্গকে ‘বেঙ্গালা’নামে উল্লেখ করা হয়েছে ইংরেজ বণিকরাই সর্ব প্রথম বাংলা বা বঙ্গকে ‘ বেঙ্গল নামে অভিহিত করে। ইংরেজ শাসনামলে ‘ বেঙ্গল প্রেসিডেন্সী ’ বলতে বর্তমান বাংলাদেশ , পশ্চিম বাংলা বিহার ও উড়িষ্যাকে বুঝাতো । পরে শুধু বাংলাভাষীদের সমন্বয়ে বাংলা প্রদেশ গঠিত হয়েছিল। ১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দে দ্বি-জাতি তত্বের ভিত্তিতে ভারতীয় উপমহাদেশ বিভক্ত হয়ে বাঙ্গালী মুসলমান অধ্যুষিত এলাকা পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হয়। তখন পূর্ব বাংলার নাম হয় পূর্ব পাকিস্তান । ১৯৭১  খ্রিষ্টাব্দে পূর্ব পাকিস্তান পাকিস্তানের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে স্বাধীন রাষ্ট্র রূপে আত্মপ্রকাশ করে।  নব্য স্বাধীন এ ভূখ- ‘ বাংলাদেশ ’ নাম গ্রহণ করে। (১) মধ্য যুগের বাঙ্গালা আর বর্তমান বাংলাদেশ -এ দু’এর মধ্যে সময় রেখা বেশ দীর্ঘ । মধ্যযুগের বাংলাদেশ গড়ে উঠেছিল মুসলমান শাসনামলে , বর্তমান বাংলাদেশ ও মুসলিম বাঙ্গালীদেরই সংগ্রামের ফসল। 
একদা যে দেশ গৌড়ভূমি বলে পরিচিত ছিল তা মুসলমান শাসনামলেই বাঙ্গালা নামে চিহ্নিত হল। রাঢ় -বরেন্দ্র -বঙ্গ - সবই বঙ্গ- বাংলা নামের মধ্যে আশ্রয় নিল।
তথ্য সূত্র-১) ড.এম এ রহীম -বাংলাদেশের ইতিহাস।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ