নানা বাধায় রাজধানীতে সেকেন্ডারি ট্রান্সফার স্টেশন করা যাচ্ছে না
তোফাজ্জল হোসেন কামাল : সড়ক থেকে ময়লার ডাস্টবিন সরাতে সেকেন্ডারি ট্রান্সফার স্টেশন (এসটিএস) নির্মাণ করায় সুফল পাচ্ছেন ঢাকাসহ সাত সিটির অধিবাসীরা। এসটিএস সংশ্লিষ্ট এলাকার রাস্তায় এখন আর ময়লার ডাস্টবিন থাকেনা। বাসা-বাড়ি থেকে সরাসরি ময়লা সংগ্রহ করে ভ্যান গাড়িতে এসটিএস এ আনার পর সেখান থেকে ট্রাকে করে ল্যান্ডফিলে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। ফলে এলাকার রাস্তা থাকছে পরিচ্ছন্ন। দুর্গন্ধ থেকেও রক্ষা পাচ্ছেন এলাকাবাসী।
এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের (এডিবি) অর্থায়নে ২০০৯ সালে আরবান পাবলিক অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল হেলথ সেক্টর ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট (ইউপিএইচএসডিপি) নামে উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। এ প্রকল্পের অধীনে ঢাকার দুই সিটিসহ চট্টগ্রাম, খুলনা, রাজশাহী, সিলেট ও বরিশাল সিটি করপোরেশনে প্রায় ৭৩ কোটি টাকা ব্যয়ে ৪৬টি সেকেন্ডারি ট্রান্সফার স্টেশন (এসটিএস) নির্মাণের উদ্যোগ নেয়া হয়। ঢাকার দুই সিটিতে ধার্যকৃত ১২টির মধ্যে ঢাকা দক্ষিণে ৭ ও ঢাকা উত্তরে ৫টি এসটিএস নির্মাণ করার কথা ছিল। এ লক্ষ্যে দরপত্রের মাধ্যমে মেসার্স টেক স্কোয়ার্ড নামে একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে কাজ দেয়া হয়। কিন্তু কাজ করতে গিয়ে ব্যাপক বাধার মুখে পড়ে তারা। মামলা, এলাকাবাসীর বাধা, পরিবেশ অধিদফতর ও পরিবেশবাদীদের আপত্তিসহ নানা কারণে কার্যক্রমের গতি মন্থর হয়ে পড়ে।
রাজধানীর যাত্রাবাড়ী কাঁচাবাজারের উত্তর পাশের খালি জায়গায় এসটিএস নির্মাণ করার জন্য কাজ শুরু করলে স্থানীয় এলাকাবাসী বাধা দেন। তাদের আশংকা ছিল এখানে এসটিএস নির্মাণ হলে বাজারে দুর্গন্ধ ছড়িয়ে পড়বে। ওসমানী উদ্যানে নির্মাণ করতে গেলে পরিবেশ অধিদফতর থেকে আপত্তি জানান হয়। ফার্মগেট পান্থকুঞ্জে প্রায় অর্ধেক কাজ করা অবস্থায় বাংলাদেশ পরিবেশ আইনজীবী সমিতি (বেলা) মামলা করলে আদালতের নির্দেশে কাজ স্থগিত হয়ে যায়। হাজারিবাগের ম্যাটাডোর এলাকায় কাজ করতে গেলে এক ব্যক্তি মামলা করেন। ঢাকা উত্তর সিটিকরপোরেশনের উত্তরার জসিম উদ্দিন রোড ও রাজউক কলেজ এলাকায় নির্মাণ করতে গেলে এলাকাবাসী বাধা দেন। মিরপুর কবরস্থান সংলগ্ন এলাকায় এসটিএস নির্মাণ কাজ শুরু হলে একটি স্বার্থান্বেষী মহল ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের কর্মচারীদের থাকার ঘর আগুনে পুড়িয়ে দেয়।
কিন্তু এর মধ্যেও ২২ নং ওয়ার্ডে হাজারিবাগের বেড়িবাধে একটি এসটিএস নির্মাণ করে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। গত বছরের ৯ মার্চ ঢাকা দক্ষিণের মেয়র সাঈদ খোকন এসটিএসটির উদ্বোধন করেন। এরপর থেকে এসটিএসটির কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে। ১৪ ও ২২ নম্বর ওয়ার্ডের বিভিন্ন রাস্তায় থাকা বেশিরভাগ ডাস্টবিন (কনটেইনার) এ এসটিএসে নিয়ে আসা হয়েছে। এতে এলাকার রাস্তায় এখন আর ময়লার স্তুপ দেখা যায় না। এতে স্বস্তি প্রকাশ করেছেন হাজারিবাগের বাসিন্দারা। তারা জানিয়েছেন এসটিএস হওয়ার কারণে তাদের এলাকা এখন অনেকটা পরিচ্ছন্ন। রাস্তা হাটতে গেলে এখন ময়লার দুর্গন্ধ পাওয়া যায়না। মাহবুব হোসেন নামে এক বাসিন্দা বলেন, আগে রাস্তায় ময়লার ডাস্টবিন থাকায় নাকে রুমাল চেপে চলতে হত। কিন্তু এখন তা করতে হয়না। ডাস্টবিনগুলো সব এসটিএস এ আনা হয়েছে। এতে এলাকার পরিবেশ সুন্দর হয়েছে।
আদম আলী নামে এক এলাকাবাসী বলেন, আগে এক সময় মনে করতাম এসটিএস হলে দুর্গন্ধ বেশি হবে, কিন্তু এখন সে ভুল ভেঙ্গে গেছে। এসটিএস এর দেয়ালের উচ্চতা ৪৫ ফুটের বেশি হওয়ায় গন্ধ অনেক উপরে চলে যায়, এতে এলাকাবাসীর কোন সমস্যা হয় না।
হাজিরাবাগের এসটিএস পরিদর্শন করে দেখা যায়, সেখানে বিভিন্ন এলাকার বাসা-বাড়ি থেকে ১৮টি করে ভ্যান গাড়িতে ময়লা এনে কনটেইনারে রাখা হচ্ছে। সেখান থেকে ট্রাকে এসব কনটেইনার নিয়ে যাওয়া হচ্ছে মাতুয়াইল ল্যান্ডফিলে। সেখানে কর্মরত সিটি করপোরেশনের পরিচ্ছন্ন কর্মীদের সরদার বাচ্চু বলেন, প্রতিদিন ৩৬ জন কর্মী ২টি ওয়ার্ডের ময়লা ভ্যানে করে এখানে নিয়ে আসেন। এলাকার রাস্তায় এখন আর কোন ময়লা রাখা হয়না।
ডিএসসিসি সূত্রে জানা যায়, এলাকাবাসী ভুল ধারণা নিয়ে কয়েকস্থানে বাধা দিলেও পরবর্তীতে কিছু সমস্যার সমাধান করা হয়েছে। হাজারিবাগ ম্যাটাডোর এলাকার মামলা নিষ্পত্তি হওয়ার পর সেখানে এসটিএস নির্মাণ করা হয়েছে। বর্তমানে এটি উদ্বোধনের অপেক্ষায় রয়েছে। একইভাবে জুরাইন পোস্তগোলা এলাকায় আরেকটি নির্মাণ কাজ শেষ পর্যায়ে রয়েছে। এটিও দ্রুতই চালু হবে। শিকদার মেডিক্যালের সামনে আরেকটির পাইলিং কাজ সম্প্রতি শেষ হয়েছে। এটিও বাধা কাটিয়ে নির্মাণ কাজ শুরু করা সম্ভব হয়েছে। যাত্রাবাড়িতেও বাধা কাটিয়ে নির্মাণ কাজ শুরু হয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ মিনার সংলগ্ন, ধলপুর ও কলাবাগান এলাকায় এসটিএস নির্মাণের কাজ ইতোমধ্যে শুরু হয়েছে।
নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠানের প্রধান প্রকৌশলী এম এ হোসাইন মুকুল বলেন, প্রকল্পের অধীনে চট্টগ্রামে নির্মিত ৫টি এসটিএস গত ১৬ জানুয়ারি উদ্বোধন করেছেন চসিক মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দিন। খুলনায় এক বছর আগে দুটি এবং গত ৮ ফেব্রুয়ারি আরো দুটি চালু হয়েছে। বরিশালে ২টি চালু হয়েছে। রাজশাহীতে ১টি এক বছর আগে চালু হয়, আরো তিনটি নির্মাণ শেষে চালুর অপেক্ষায় রয়েছে। সিলেটে ৩টির নির্মাণ কাজ শেষ হয়েছে। ২৫ মার্চ এ তিনটি উদ্বোধন করা হবে। এ এসটিএসগুলো নির্মাণ করায় সুফল পাচ্ছেন ওই সব এলাকার অধিবাসীরা।
এদিকে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের অর্থায়নে পৃথক একটি প্রকল্পে সম্প্রতি ডিএসসিসি ২, ৩, ৪ ও ৫ নম্বর অঞ্চলে ৪টি এসটিএস নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছে। এজন্য ব্যয় ধরা হয়েছে ৮ কোটি ৫৪ লাখ ৪৯ হাজার ৯২৮ টাকা। গত বছরের ৩০ সেপ্টেম্বর থেকে প্রকল্পের মেয়াদ শুরু হয়েছে। এ ব্যাপারে দরপত্রের মাধ্যমে একটি প্রতিষ্ঠানকে কাজ দেয়া হলেও সবগুলো এসটিএসের জন্য কাংক্ষিত জায়গা পাচ্ছেনা সিটি করপোরেশন। ডিএসসিসির প্রকৌশল বিভাগের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, অঞ্চল-২ এর মেরাদিয়া বাজার এলাকায় একটি জায়গা পাওয়া গেছে। সেখানে ইতোমধ্যে এসটিএস নির্মাণে পাইলিংয়ের কাজ শুরু হয়েছে। একই এলাকার গোড়ানে আরেকটি নির্মাণ করতে গেলে এক ব্যক্তি বাধা দেন। আর অন্য অঞ্চলগুলোতে জায়গা পাওয়া না যাওয়ায় কাজ শুরু করতে পারছেনা ডিএসসিসি।
সিটি করপোরেশনের বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগের কর্মকর্তারা জানান, প্রতিদিন রাজধানীতে প্রায় পাঁচ হাজার টন বর্জ্য উৎপাদিত হয়। এসব বর্জ্য বাসা-বাড়ি থেকে সংগ্রহ করার পর রাস্তায় রাখা ডাস্টবিনে রাখতে হয়। এতে ওই রাস্তায় চলাচলরতরা দুর্ভোগে পড়েন। অনেক স্থানে ডাস্টবিনের কারণে যানজটেরও সৃষ্টি হয়। এ কারণে এসটিএস নির্মাণের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। প্রতিটি ওয়ার্ডে অন্তত একটি এসটিএস নির্মাণ করতে পারলেও রাস্তার মাঝে আর ডাস্টবিন রাখতে হবে না। নাকে রুমাল দিয়েও চলতে হবে না পথচারীদের। ডিএসসিসির বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী আবু সালেহ মো: মাঈনুদ্দিন বলেন, এসটিএস নির্মাণ নিয়ে মানুষের মধ্যে কিছু ভুল ধারণা ছিল। এ কারণে অনেক স্থানে বাধা দেয়া হচ্ছে। তবে যেগুলো নির্মাণ হয়েছে তাতে ওইসব এলাকার বাসিন্দারা সুফল পাচ্ছেন। তিনি জানান, বর্তমানে ডিএসসিসিতে ১৩ টি বড় ধরনের এসটিএসের পাশাপাশি ১০টি মিনি এসটিএস নির্মাণ করা হচ্ছে। এর একটি চালু হয়েছে। বাকিগুলো চালু হলে নগরীর রাস্তাঘাটের ময়লা কমে যাবে। এদিকে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি) এলাকায় বড় আকারের এসটিএসের পরিবর্তে নিজস্ব অর্থায়নে মিনি এসটিএস নির্মাণ করা হচ্ছে। এ পর্যন্ত বিভিন্ন ওয়ার্ডে অর্ধশতাধিক মিনি এসটিএস স্থাপন করা হয়েছে। এতে ওইসব এলাকার ডাস্টবিনগুলো সরিয়ে ফেলা সম্ভব হয়েছে। এতে উন্নত হয়েছে এলাকার পরিবেশ।