জরুরি ভিত্তিতে দুর্গত মানুষের পুনর্বাসন অপরিহার্য
একটি বিপদ কাটতে না কাটতেই আরেকটি বিপদ হাওর অঞ্চলের জেলাসমূহের বাসিন্দাদের জীবনকে দুর্বিষহ করে তুলেছে বলে মনে হয়। বিগত মার্চ মাসের শেষার্ধে পাহাড়ী ঢল ও অতি বৃষ্টির ফলে প্রথমে সুনামগঞ্জের হাওর এলাকা ব্যাপকভাবে প্লাবিত হয় এবং সেখানকার উঠতি ফসল সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস হয়ে যায়। হাওরের ধান পচার কিছুদিনের মধ্যে সেখানে এক অভূতপূর্ব অবস্থার সৃষ্টি হয় এবং প্রথমে মাছ ও পরে হাওরে বিচরণকারী শত শত হাঁস মরতে শুরু করে। এতে কৃষক, জেলে ও ভূমিহীন দরিদ্র পরিবারগুলোর মাথায় হাত পড়ে। উল্লেখ্য যে, হাওর এলাকার জমি এক ফসলী এবং বোরো ছাড়া দানাশস্য জাতীয় আর কোনো ফসল সেখানে ফলে না। এই একটি ফসলই তাদের সারা বছরের খোরাকী সরবরাহ করে। বছরের বেশিরভাগ পানি থাকায় সেখানে উন্মুক্ত জলাশয়ে প্রচুর মাছের চাষ হয় এবং এই মাছ সারা দেশের বিভিন্ন জেলায় সরবরাহ হয়। হাওরের ফসলের প্রাচুর্য এবং মাছের আধিক্য হাওরবাসীর গর্ব হিসেবে পরিচিত। এর পাশাপাশি খাকি ক্যাম্বেল হাঁসের চাষ ওই এলাকায় ভূমিহীন দরিদ্র পরিবারগুলোর জীবনযাত্রার মান উন্নয়নে বিপুল অবদান রেখে চলেছে। এই জাতের হাঁস বছরে ৩০০ থেকে ৩৫০টি ডিম দেয় এবং সারা দেশের মানুষকে পুষ্টি যোগায়। এই জাতের হাঁস সত্তরের দশকের মাঝামাঝি সময়ে হাওর অঞ্চলের ভূমিহীনদের মধ্যে বিতরণ করা হয় এবং কালক্রমে হাঁস পালন একটি লাভজনক পেশায় পরিণত হয়। মাছের সাথে হাঁস মরার পরিপ্রেক্ষিতে অভিযোগ উঠে যে উজানে ভারতের উন্মুক্ত খনি থেকে পাহাড়ী ঢলের পানির সাথে ইউরেনিয়াম ও অন্যান্য তেজস্ক্রিয় পদার্থ হাওরের পানিতে পড়ায় মাছ, হাঁস ও অন্যান্য জলজ প্রাণীর অপমৃত্যু হচ্ছে এবং সাধারণ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত ও আতঙ্কিত হয়ে পড়েছেন। এ নিয়ে দেশের পত্রপত্রিকা এবং পরিবেশ আন্দোলনের সাথে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন ব্যক্তি ও সংস্থার মধ্যে একটা বিতর্কের সৃষ্টি হয়। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান বিশেষ করে মৎস্য ও পশুসম্পদ মন্ত্রণলয় এবং আণবিক শক্তি কমিশন ও খাদ্য মন্ত্রণালয়ের বিশেষজ্ঞরা সেখানে হুমড়ি খেয়ে পড়েন এবং তাদের সমীক্ষা অনুযায়ী ইউরেনিয়াম নয় ধান পচার সাথে সৃষ্ট অ্যামোনিয়া গ্যাসের কারণেই মাছ ও হঁসের মৃত্যু হচ্ছে। ভাগ্য ভালো যে, এর মধ্যে আবার পাহাড়ী ঢল ও বৃষ্টির প্রাদুর্ভাব ঘটায় ইউরেনিয়াম বিতর্ক আর এগুতে পারেনি এবং এতে প্রতিবেশীরা রক্ষা পেল।
আসলে ইউরেনিয়াম বিতর্কটি প্রথম বাংলাদেশ থেকে উঠেনি। মিজোল্যান্ড ও নাগাল্যান্ডের পত্রপত্রিকাতেই প্রথমে এই অভিযোগটি উঠে এবং ভাটির দেশ বাংলাদেশের উপর ভারতীয় ইউরেনিয়ামযুক্ত পানি সৃষ্ট বিপর্যয়ে তার ফলাফল দেখা যাওয়ায় এ দেশের পরিবেশবাদীরা বিষয়টি লুফে নেন। এখন প্রাকৃতিক কারণÑ পাহাড়ী ঢল, বন্যা, বাঁধের ভাঙন প্রভৃতি এই বিপর্যয়কে আরো সম্প্রসারিত করার ফলে গ্যাস হোক অথবা ইউরেনিয়াম তা বিস্তৃত অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে তার কার্যকারিতা হারিয়েছে এবং ভারত বেনিফিট অব ডাউট পেয়েছে।
আমি হাওর অঞ্চলের বিপর্যয় দিয়ে আলোচনা শুরু করেছিলাম। সুনামগঞ্জের হাওর এলাকায় গত পরশু ফসল রক্ষা বাঁধ ভেঙ্গে যাওয়ায় অপেক্ষাকৃত উঁচু এলাকার বাড়িঘরও পানির নিচে চলে গেছে। বন্যায় এখন ৭টি জেলার ৫৩টি উপজেলা ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এর মধ্যে আছে সুনামগঞ্জের ১০টি উপজেলা, মৌলভীবাজারের ৬টি, নেত্রকোনার ১০টি, কিশোরগঞ্জের ৭টি, শেরপুরের ৫টি, হবিগঞ্জের নয়টি এবং জামালপুরের ৬টি উপজেলা। সিলেট জেলার ৭টি উপজেলাও বন্যার হুমকিতে আছে। হাওর ও হাওরবহির্ভূত এলাকার ফসলী জমির অধিকাংশই পানির নিচে চলে গেছে। আবহাওয়ার বর্তমান অবস্থা যদি আরও দু’চার দিন অব্যাহত থাকে তাহলে বাংলাদেশের অর্ধেকের বেশি এলাকা বন্যায় তলিয়ে যাবে এবং দেশে ভয়াবহ অবস্থার সৃষ্টি হবে।
ধনী-নির্ধন-নির্বিশেষে বৃহত্তর সিলেটের প্রায় সবগুলো জেলা-উপজেলা, নেত্রকোনা, শেরপুর এবং জামালপুর জেলার মানুষ এখন বন্যা ও পাহাড়ী ঢলের শিকার। তাদের আশু সহযোগিতা প্রয়োজন। এই সহযোগিতার অংশ হিসেবে তাদের তাৎক্ষণিকভাবে শুকনা খাবার, চাল, ডাল, দিয়াশলাই, লবণ ও রান্নার সামগ্রী সরবরাহ করা অপরিহার্য। বন্যা উপদ্রুত এলাকায় তাদের আশ্রয়ের ব্যবস্থা করা এবং সাথে সাথে মানুষের জান-মাল, ইজ্জত-আব্রুর নিরাপত্তার ব্যবস্থা করাও অত্যন্ত জরুরি। এমন অনেক এলাকা আছে যেখানে রান্না-বান্না করার পরিবেশ নেই। আগুন জ্বালাবার জায়গা যেমনি নেই, তেমনি রান্নার সামগ্রীও বন্যার পানিতে ভাসিয়ে নিয়ে গেছে। তাদের জন্য রান্নার সামগ্রী এবং তৈজসপত্রও দরকার। তাদের গরু-ছাগল, হাঁস-মুরগির আশ্রয়ের জন্য এক সময় হাওর এলাকায় মাটির ঢিবি তৈরি করা হয়েছিল।
রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে এগুলোর অধিকাংশই এখন নেই। পানি সরে যাওয়ার সাথে সাথে তাদের সামাজিক ও অর্থনৈতিক পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করতে হবে। এজন্য আগাম পরিকল্পনা প্রণয়ন সরকারের দায়িত্ব। পানিবাহিত রোগপ্রতিরোধ ও চিকিৎসার আগাম ব্যবস্থা সরকারকেই নিতে হবে। হাওর এলাকায় সুপেয় পানির অভাব প্রকট। প্রচুর পরিমাণে পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট সরবরাহের ব্যবস্থা থাকলে এই সঙ্কট বড় হয়ে দেখা দিতে পারবে না।
বন্যাউত্তর কৃষি পুনর্বাসনের পূর্ব প্রস্তুতি গ্রহণের লক্ষ্যে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর বিএডিসি এবং বিআরডিবির প্রাথমিক কৃষি ও কেন্দ্রীয় সমবায় এসোসিয়েশনসমূহকে সক্রিয় ভূমিকা পালনের সরকারি নির্দেশ এখনই দেয়া প্রয়োজন। বন্যা পুনর্বাসনে সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগ ও মন্ত্রণালয়গুলোকে সজাগ থাকা বাঞ্ছনীয় বলে আমি মনে করি। তবে কিছু কিছু কর্মকর্তার অবাঞ্ছিত মন্তব্যে হতাশ না হয়ে পারি না।
সুনামগঞ্জের হাওর এলাকায় ফসলের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির ব্যাপারে মন্তব্য করতে গিয়ে সরকারের একটি মন্ত্রণালয়ের একজন শীর্ষ কর্মকর্তা বলেছেন যে, এতে আমাদের খাদ্যোৎপাদনের উপর খুব একটা প্রভাব পড়বে না। কেন না উত্তরাঞ্চলের খাদ্য ভাণ্ডার বলে কথিত ১৬টি জেলার ফসলের যে বাম্পার ফলনের সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে তাতে সুনামগঞ্জ বা সিলেটের ক্ষতি পুষিয়ে নেয়া অত্যন্ত সহজতর হবে। মন্তব্যটিকে দায়িত্বশীল মন্তব্য বলে মেনে নেয়া যায় না। উত্তরাঞ্চলের জেলাসমূহের ফসলের নিরাপত্তা সম্পর্কে তার ধারণা স্থূল। পাঠকরা নিশ্চয়ই গত বছর কুড়িগ্রাম ও লালমনিরহাট জেলায় তিস্তা ভাঙ্গনে হাজার হাজার পরিবারের নিঃস্ব ও গৃহহীন হয়ে পড়ার ঘটনা ভুলে যাননি। ভারত গজল ডোবায় নির্মিত বাঁধের পানি ছেড়ে দেয়ায় পানির প্রচ- প্রবাহে তিস্তা পাড়ের গ্রামগুলোতে এই তাণ্ডবের সৃষ্টি হয়েছিল। এতে হাজার হাজার একর জমির ফসলও তলিয়ে গিয়েছিল। এ বছর যে তা হবে না তার নিশ্চয়তা নেই। তিস্তা, ব্রহ্মপুত্র, গঙ্গাসহ আন্তর্জাতিক নদীসমূহের উজানে ভারত শত শত বাঁধ নির্মাণ করেছে। শুষ্ক মওসুমে তারা বাঁধের গেইটগুলো বন্ধ করে পানি আটকায় এবং তার গতিপথ পরিবর্তন করে সেচের কাজে ব্যবহারের জন্য অপেক্ষাকৃত উঁচু এলাকার দিকে প্রবাহিত করে। বর্ষা মওসুমে বাঁধের গেইটগুলো খুলে দেয় এবং এতে বাঁধের ফলে জমা হওয়া পানি প্রচ-বেগে বাংলাদেশে প্রবেশ করে বাড়িঘর ও ফসলাদি তলিয়ে নেয়। বাংলাদেশের ৮টি জেলা সরাসরি তিস্তা অববাহিকার সাথে সম্পৃক্ত এবং এই জেলাগুলো বৃহত্তর রংপুর, দিনাজপুর ও বগুড়া জেলার সাথে সম্পৃক্ত এবং ১৮ লাখ ৫২ হাজার ৫০০ একর জমি তিস্তার পানিনির্ভর। যদি এই জমি সেচ কাজে তিস্তার পানি থেকে বঞ্চিত হয় তাহলে ফসল উৎপাদন ব্যাহত হয়। আবার বর্ষাকালে ভারত কর্তৃক পানি ছেড়ে দেয়ার ফলে বৃষ্টির পানিনির্ভর ফসলও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ক্ষতিগ্রস্ত হবার সম্ভাবনা এখনো রয়েছে। এটা আমাদের বিগত দিনের অভিজ্ঞতা। এই অবস্থায় সম্ভাব্য দুর্যোগ থেকে কৃষকদের রক্ষা করার জন্য সরকারকে সজাগ থাকার জন্য আমি আহ্বান জানাচ্ছি।