বৃহস্পতিবার ০২ মে ২০২৪
Online Edition

রমজানের প্রেরণায় কাটুক সারাটি বছর

মোমতাহানা সুরভি : দেখতে দেখতে রমজান মাস আমাদের মাঝ থেকে বিদায় নিয়েছে। কেটে গেল রহমত, মাগফিরাত ও নাজাতের এক বসন্ত  মওসুম। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন প্রদত্ত এই শ্রেষ্ঠতম নেকি অর্জনের মাসে নিজ নিজ নেকির কোষাগারে কতটুকু পুণ্য অর্জিত হল,তা নিয়ে আত্মপর্যালোচনা এখনই হয়ে যেতে পারে। সেই সাথে এটাও ভেবে দেখা দরকার, এই একটি মাসের কোন ট্রেনিংগুলো বছরের পুরোটা সময়জুড়ে আমাদের ধরে রাখতে হবে নিয়মিত সাধনার প্রয়াসে।
কোরআনের রং এ রাঙাবো জীবন : রমজান মাসের সমস্ত মাহাত্ম্য, গুরুত্ব ও মর্যাদার পিছনে রয়েছে মহাগ্রন্থ আল কোরআন নাজিলের প্রেক্ষাপট। রমজানের এই পবিত্রতম মুহূর্তেই নাজিল হয় মানবজীবনের সর্বাধিক গ্রহণযোগ্য সমাধানের উৎস এই আল কোরআন। এটি শুধুমাত্র একটি কিতাব নয়,বরং একটি বিশাল আমানত। এই আমানত কোরআন অনুযায়ী নিজ জীবনকে পরিশুদ্ধ করার, এই দায়িত্বর দাবী কোরআনের আলোয় আলোকিত এক সমাজ গড়ার।কোরআন নাজিলের কারণ হিসেবে
আল্লাহ নিজেই বলেন- “আমি যুগে যুগে নবী -রাসুল পাঠিয়েছি প্রামাণ্য দলিলসহ,আর নাজিল করেছি কিতাব ও ন্যায়ের দন্ড,যাতে করে গোটা মানবজাতি ন্যায় ও ইনসাফের উপর প্রতিষ্ঠিত হতে পারে।” (সুরা হাদিদ:২৫)
“হে মুহাম্মদ,এটি একটি কিতাব,আমরা এটি তোমার প্রতি নাজিল করেছি যাতে করে তুমি মানুষকে অন্ধকার থেকে আলোতে নিয়ে আসো।” (সুরা ইব্রাহীম :০১)
রমজানের এই পবিত্র মাসে কোরআনকে আমরা এক নতুন উপলব্ধি নিয়ে পড়া শুরু করি,যা  হয়তো বছরের অন্য সময়টাতে হয়ে ওঠেনা। কোরআন খতম দেয়ার পাশাপাশি কোরআন অর্থ সহ পড়া ও সেই অনুযায়ী নিজের জীবন সংশোধনের জন্য রমজান থেকেই আমরা ট্রেনিং নিতে পারি।প্রতিটি কাজকে একটু মিলিয়ে দেখতে পারি যে তা কোরআনের নির্দেশনা অনুযায়ী হচ্ছে কিনা।একই প্রেরণায় উদ্বুদ্ধ করতে পারি নিজের পরিবার ও পারিপার্শ্বিক প্রতিটি অংগনকে। তাহলেই কোরআনের আলোয় আলোকিত হবে পুরো সমাজ। শুধু রমজান নয়, পুরোটা বছর ধরেই এই আলো থাকবে মুমিনের বুকে।
তাকওয়ার প্রেরণায় হোক শুদ্ধতার সাধন : তাকওয়া বা আল্লাহ্ ভীতিই মানুষকে সব মন্দ কাজ থেকে দূরে রাখে, প্রেরণা দেয় আল্লাহকে ভয় করে তার বিধান অনুযায়ী চলার জন্য। রমজান মাসের সামগ্রিক পলোতেই রয়েছে তাকওয়া অর্থর প্রেরণা,সূরা বাকারাতেই আল্লাহ্  বলেছেন-
 হে ইমানদারগণ, তোমাদের উপর রোজা ফরজ করা হয়েছে যেমন করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের উপর। আশা করা যায় এর দ্বারা তোমাদের মধ্যে তাকওয়ার গুণাবলী সৃষ্টি হবে।-(বাকারা-১৮৩)
আল্লাহ্ রাব্বুল আলামিনকে ভয় করে আমরা নির্দিষ্ট কোন হালাল কিছু কাজ থেকেও নিজেকে বিরত রাখি।অনেক সুযোগ থাকা সত্ত্বেও আমরা এই কাজগুলো করার চেষ্টা করি না। শুধুমাত্র আল্লাহ্ আমাকে দেখছেন এই চিন্তা থেকেই। এই চিন্তার মাধ্যমে ঘটে যায় মানব জীবনে নৈতিক শুদ্ধতার এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন মাহে রমজানের এই প্রেরণাকে ধরে রাখতে পারলে বছরের বা কিছু সময়েও তাকওয়া আমাদের প্রতিটি কালের জন্যই পাহারাদার হবে ইনশাল্লাহ।
ভাল কিছু অর্জন মন্দ কিছু বর্জন : পুরো রমজান মাস ধরেই আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য সৎকাজ করা আর তার ভয়েই অসৎ কাজ থেকে বিরত থাকার এক উৎসব চলে। বিরত থাকা হয় মিথ্যা কথা বলা,গীবত করা,ঝগড়া করা, অশ্লীল কিছু দেখার মত গুণাহর কাজ থেকে। আর নামাযে তাহাজ্জুদে নিয়মিত হওয়া, কোরআন খতম করা, দান সদকা করার মতো উওম কিছু  সৎকাজের। এছাড়া কানের রোজা মুখের রোজা,অন্তরের রোজার মাধমে শরীরের প্রতিটি অঙ্গ-প্রতঙ্গ ও অন্তঃকরণ হেদায়াত পায় ছোট, বড় সব ধরনের গুণাহর কাজ থেকে। প্রকৃতিকে সংযত রেখে আল্লাহ্রর বিধাণ অনুযায়ী সত গুণাবলীর চর্চা রোজাদারের মধ্যে সৃষ্টি করে এক অনুপম নৈতিক শক্তির, প্রত্যেক রোযাদার যদি রমজানের এই ট্রেনিংকে সারা বছরের জন্য ধারণ করতে পারে তাহলে অনৈতিকতা,অশ্লীলতার মতো সামাজিক ব্যাধি দূর করে শান্তি প্রগতির মতো এক চমৎকার সভ্যতা প্রতিষ্ঠিত করা সম্ভব।
গড়ে তুলি অটুট বন্ধন : রমজানের এক অনিন্দ্য সুন্দর ঐতিহ্য হলো প্রতিটি মুহূর্তের কাজই একত্রে করা হয়। একসাথে সেহরী খাওয়া,একসাথে রোজা রাখা ও ইফতার করা,তারাবীর নামাজ আদায় প্রত্যেকটি কাজই একই সঙ্গে পারিবারিক ও সামাজিক বন্ধনকে আরও অনেক বেশি দৃঢ় করে তোলে। রোজা পালনের মাধ্যমে একত্রে আল্লাহর প্রতিটি হুকুম পালনের এই চমৎকার রূহানী পরিবেশ বিশ্ব ভ্রাতৃত্বের এক অনুপম ভিত গড়ে তোলে।এই ভিত্তিমূলকেই যদি ধরে রাখা যায় তাহলে এর উপরেই বছরের বাকিটা সময় তৈরি হতে পারে সীসাঢালা ভ্রাতৃত্বের অটুট প্রাচীর।
অর্থনৈতিক ভারসাম্যের অনুপম নিদর্শন : বর্তমানের পুঁজিবাদী অর্থব্যবস্থায় গরীব মানুষগুলো এক সীমাহীন অর্থনৈতিক দৈন্যের শিকার। ধনীশ্রেণীর অতিরিক্ত অর্থলিপ্সা,হারাম উপার্জন, সম্পদের অসম বন্টন তৈরি করছে অর্থনৈতিক ভারসাম্যহীনতা।রমজান এই প্রতিটি সমস্যার মূলে কুঠারাঘাত করে।হালালভাবে অর্থব্যয় করা, হালাল রুযি থেকে দান করা,যাকাতের মাধ্যমে অতিরিক্ত সম্পদের সুষম বন্টন সমাজে আর্থিক নিরাপত্তার ভিত্তিমূল রচনা করে।ইসলামি অর্থনীতির মূলনীতিগুলো পুরো বছরই যদি রাখা যায় তবে ইসলামের সেই সোনালী  যুগ আবারও ফিরে পাওয়া সম্ভব, যখন যাকাত গ্রহণের মতো দরিদ্র ব্যক্তি খুঁজে পাওয়া যেত না।
গড়ে তুলি এক সোনালী  সমাজ : রমজানের  সামগ্রিক শিক্ষার বৈশিষ্টগুলো  সামনে রাখলে এটিই স্পষ্ট হয়ে উঠে রমজানের পুরো প্রশিক্ষণের মাধ্যমে তৈরী  হয় সৎ, আল্লাহভীরু, সহনশীল, সংযমী ও কল্যাণকামী ব্যক্তিত্ব। জানমালের নিরাপত্তা, অর্থনৈতিক ভারসাম্য, মত প্রদানের স্বাধীনতা, সমঅধিকার প্রতিষ্ঠা, মৌলিক অধিকার সংরক্ষণ সহ একটি কল্যাণ রাষ্ট্রের সার্বিক বৈশিষ্ট্য অর্জনে যেমন জাতি প্রয়োজন, রমজান সেই ট্রেনিং দিয়েই তৈরী করে এক একজন সোনালী মানুষ, রমজানের স্পিরিটই পারে তুলতে এক সোনালী  সমাজ।
সবশেষে রমজানের সমাপ্তিলগ্নে এসে হযরত উমর (রা:) এর এক ঈদ উদযাপনের ঘটনা  মনে পড়ে যাচ্ছে, ইসলামের এই দ্বিতীয় খলীফা এক ঈদের দিন অনেক কাঁদছিলেন। লোকজন খলীফার এই ক্রন্দনের কারণ জানতে চাইলে  তিনি আশঙ্কা করে বলছিলেন,আমি তো জানিনা,আমার রোজা আল্লাহ্ কবুল করেছেনকিনা!-কি চমৎকার আত্মপর্যালোচনা, আল্লাহভীতির কি অনুপম দৃষ্টান্ত। রমজানের এই অনুপম সময়ে আমাদের বিবেকগুলোকেও জাগিয়ে তুলতে হবে।রমজানের শেষ হবার সাথে সাথে নিজের প্রবৃত্তির পূজায় আমরা যেন আত্মমগ্ন হয়ে না যাই। সারাটা মাসের নৈতিকতার এই ট্রেনিং যেন ঈদের দিনেই শূন্যের কৌটায় চলে না যায় সে ব্যাপারে সচেতন হওয়া জরুরী।রমজানের শিক্ষাকে শুধু ব্যক্তিগত পর্যায়ে সীমাবদ্ধ না রেখে এর ব্যাপকতা তুলে ধরতে হবে পুরো সমাজে। সম্ভাবনাময়, কল্যাণকর, আল্লাহর বিধানের  প্রতিষ্ঠিত এক রূপ সমৃদ্ধ সমাজ ও রাষ্ট্র গঠনের প্রেরণায় সারাটি বছর রমজান আমাদের জ্বালানির যোগান দিয়ে যাবে। এ প্রত্যাশায় কাটুক এবারের রমজান........
         “মাহে রমজানের মতো হোক
         বছরের বাকি দিনগুলো,
         ফুলের মতো হেসে উঠুক
         মানুষের মনগুলো ॥”

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ