শনিবার ১১ মে ২০২৪
Online Edition

কার্বন নিঃসরণ হ্রাসে প্রতিশ্রুতির বিষয়ে সংশ্লিষ্ট দফতরগুলো ওয়াকিবহাল নয়

** প্রকল্প বাস্তবায়নে মূল সমস্যা স্বচ্ছতা ও সুশাসনের ঘাটতি -ড. ইফতেখার

স্টাফ রিপোর্টার : বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার ছয়টি দেশেই কার্বন নিঃসরণ কমিয়ে আনা সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক প্রতিশ্রুতি সম্পর্কে পরিস্কার ধারণা নেই। আন্তর্জাতিক ফোরামে সংশ্লিষ্ট সরকারের প্রদত্ত প্রতিশ্রুতির বিষয়ে সরকারেরই সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন বিভাগ ও দফতর পুরোপুরি ওয়াকিবহাল নয়। কার্বন নিঃসরণ হ্রাসকরণ সম্পর্কিত দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর প্রদত্ত প্রতিশ্রুতি বিষয়ে সরকারি অংশীজনের তুলনায় বেসরকারি অংশীজন অনেক বেশি ধারণা রাখে। 

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) পরিচালিত “জলবায়ুু পরিবর্তন উপশম বিষয়ে স্বপ্রণোদিত অঙ্গীকার ও প্রতিপালন : দক্ষিণ এশীয় অভিজ্ঞতাভিত্তিক পদ্ধতিগত পর্যবেক্ষণ” শীর্ষক এক গবেষণায় এসব তথ্য উঠে এসেছে। গতকাল সোমবার সকালে নগরীর ধানমন্ডিতে টিআইবি কার্যালয়ে এক সাংবাদিক সম্মেলনে গবেষণাটির প্রতিবেদন উপস্থাপনের সময় উপস্থিত ছিলেন টিআইবি’র নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান, উপ-নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক ড. সুমাইয়া খায়ের ও জলবায়ুু অর্থায়নে সুশাসন ইউনিটের সিনিয়র প্রোগ্রাম ম্যানেজার এম. জাকির হোসেন খান। গবেষণা প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন এশিয়ান সেন্টার ফর ডেভেলপমেন্ট (এসিডি) এর পরিচালক ও গবেষক অধ্যাপক ড. এ.কে. এনামুল হক।

দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো কার্বন হ্রাস সংক্রান্ত প্রতিশ্রুতি পালনে কতটা সচেষ্ট, প্রতিশ্রুতিগুলো সর্বোৎকৃষ্ট কি-না এবং সরকারগুলোর এ বিষয়ক কার্যক্রমকে নাগরিক বা জনগণ কিভাবে মূল্যায়ন করছে তা জানার উদ্দেশ্যেই গবেষণাটি পরিচালিত হয়। গবেষণাটি পরিচালনা করেন বাংলাদেশের এসিডি’র পরিচালক ড. এ.কে. এনামুল হক ও ফেলো শেমান বিদ্যানাগ, ভারতের গোয়া বিশ^বিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. প্রণব মুখোপাধ্যায়, নেপালের সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক ফর এনভায়রনমেন্ট ইকোনমিক্্স এর গবেষণা প্রোগ্রাম ম্যানেজার ড. মানি নেপাল, মালদ্বীপের ফ্রিল্যান্স অর্থনীতিবিদ ফাতিমাত শফিকা এবং পাকিস্তানের করাচি বিশ^বিদ্যালয়ের ব্যবসায় প্রশাসন ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. হেমান লোহানো দাস। 

দক্ষিণ এশীয় সরকারগুলোর সব প্রতিশ্রুতি বিবেচনায় নিয়ে এ গবেষণায় দুই ধরনের অংশীজন- সরকারের সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধি ও গবেষক এবং বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, এনজিও ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিবৃন্দের প্রশ্নমালা সরবরাহ করে তাদের মতামত গ্রহণ করা হয়। গত বছরের ১৭ নবেম্বর থেকে চলতি বছরের ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত সময়ে গবেষণার তথ্য সংগৃহীত হয়। বাংলাদেশে ৬৪ জন, নেপালে ৮০ জন, মালদ্বীপে ৬১ জন, ভারতে ৫৮ জন, শ্রীলংকার ৬৩ জন ও পাকিস্তানের ৫০ জনকে প্রশ্নমালা ই-মেইলের মাধ্যমে পাঠানো হয়। গবেষণা প্রতিবেদনটি মোট ১৪০ জনের কাছ থেকে প্রাপ্ত মতামতের ভিত্তিতে প্রণীত। 

গবেষণায় দেখা যায়, দক্ষিণ এশিয়ার সরকারি ও গবেষক গোষ্ঠী জ্বালানি সাশ্রয়ী প্রযুক্তি বা পদক্ষেপ বিষয়ে এনজিও ও ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর তুলনায় অনেক বেশি ধারণা রাখেন। বাংলাদেশে নৌপথ কিংবা রেলপথ ব্যবহার করে যে গ্রিন হাউস গ্যাস নিঃসরণ কমানো যায় সে বিষয়ে বেসরকারি অংশীজন অনেক কম ধারণা রাখেন। একই ভাবে অফিস কিংবা ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে বৈদ্যুতিক পাখা পরিবর্তন করেও যে গ্রিন হাউস গ্যাস নিঃসরণ কমানো যায় সে বিষয়ে তাদের ধারণা স্পষ্ট নয়। 

গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ কমানোর জন্য বাংলাদেশ সরকারের গৃহীত পদক্ষেপ বিষয়ে দেখা যায়, অন্যতম প্রধান ৬টি প্রতিশ্রুতির মধ্যে ইটের ভাটায় জ্বালানি পরিবর্তন ও বিদ্যুৎ উৎপাদনে কম্বাইন্ড সাইকেল বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করে যে কার্বন নিঃসরণ কমানো যায় সে বিষয়ে ধারণা সকলেরই অত্যন্ত কম। তবে সরকারের অন্যান্য পদক্ষেপ- যেমন বাসার ছাদে ও বাড়িতে সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদন, সৌরচালিত পানির পাম্প ও বর্জ্য হতে বিদ্যুৎ উৎপাদন বিষয়ে সকল অংশীজনই কমবেশি অবহিত।

গবেষণার সকল উত্তরদাতার মতে, কার্বন নিঃসরণ কমানোর সহজ ১০টি প্রধান কৌশল হলো: নগরে যানজট কমানো, নগর পরিবহন ব্যবস্থার উন্নয়ন, নগরে যান নিয়ন্ত্রণ কৌশল উন্নয়ন, বিদ্যুতের ক্ষেত্রে জ্বালানি দক্ষতা বৃদ্ধি, ইটের ভাটায় জ্বালানি পরিবর্তন, বিদ্যুৎকেন্দ্রের আধুনিকায়ন, শহরে বর্জ্য হতে জৈব সার উৎপাদন, বাজারে বিদ্যুৎ সাশ্রয়ী যন্ত্রের প্রমিতকরণ, গ্রামাঞ্চলে উন্নত চুলার ব্যবহার বাড়ানো এবং কারখানায় জ্বালানি অডিট ব্যবস্থা প্রবর্তন।

বাংলাদেশের প্রদত্ত প্রতিশ্রুতিতে ২০৩০ সাল নাগাদ স্বাভাবিকের তুলনায় ৫ শতাংশ কম কার্বন নিঃসরণ এবং বিদেশি সহায়তা পেলে আরো ১৫ শতাংশ কার্বন নিঃসরণ হ্রাস করার কথা বলা হয়। এছাড়াও বিদ্যুৎ, যানবাহন ও শিল্পখাতের কার্বন নিঃসরণ হ্রাসের জন্য পদক্ষেপ গ্রহণেরও প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছে। গবেষণায় দেখা যায়, কার্বন নিঃসরণ কমাতে বাংলাদেশ সরকারের গৃহীত ১১টি পদক্ষেপের মধ্যে ৯টির পক্ষে ৭০ শতাংশ বা তার অধিক উত্তরদাতা মত দিয়েছে। তবে অপর দু’টি পদক্ষেপ- যন্ত্রের প্রতিমকরণ এবং পরিবেশ অডিটের মাধ্যমে কার্বন নিঃসরণ কমানো যাবে ধারণার সাথে অধিকাংশ উত্তরদাতা একমত নন।

ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, বাংলাদেশে জলবায়ু সংক্রান্ত প্রকল্পসহ যেকোনো প্রকল্প বাস্তবায়নে মূল সমস্যা স্বচ্ছতা, জবাবদিহি ও সুশাসনের ঘাটতি। জলবায়ুূ মোকাবিলাসংক্রান্ত প্রকল্পে বিদেশি অর্থায়ন হবে। তাই আগে থেকেই বলা যায়, প্রাক-উদ্বেগ জানিয়ে সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করা হচ্ছে। এর সঙ্গে তিনি যোগ করেন, ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের দুর্নীতি ধারণা সূচকে ২০১৬-এর তালিকায় বাংলাদেশ, ভারত, মালদ্বীপ, নেপাল, পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কার সূচক মান বা স্কোর যথাক্রমে ২৬, ৪০, ৩৬, ২৯, ৩২ ও ৩৬। সূচকটির গড় মান ৪৩-এর নিচের যেকোনে

টিআইবি নির্বাহী পরিচালক বলেন, জলবায়ুু পরিবর্তন বিষয়ে বৈশ্বিক পরিমণ্ডলে আলোচনা শুরুর প্রথম থেকেই বাংলাদেশ বিভিন্ন পর্যায়ে অত্যন্ত সক্রিয় ভূমিকা পালন করে আসছে। অভিযোজন কার্যক্রমের জন্য বিদেশি সহায়তা প্রাপ্তির পূর্বেই বাংলাদেশ নিজস্ব অর্থায়নে জলবায়ুু তহবিল গঠন করেছে যা অত্যন্ত উৎসাহব্যঞ্জক। বিদ্যুৎ উৎপাদনসহ কার্বন নিঃসরণের বেশিরভাগ উৎসগুলোই দক্ষিণ এশিয়ায় সরকারগুলোর নিয়ন্ত্রণে থাকায় এ অঞ্চলে কার্বন নিঃসরণ কমিয়ে আনার মূল দায়িত্ব বাংলাদেশ সরকারসহ দক্ষিণ এশিয়ার অন্য দেশগুলোর সরকারের ওপর বর্তায়। তবে সরকারের পাশাপাশি সাধারণ মানুষসহ বেসরকারি পর্যায়ের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও অংশীজনরাও যে কার্বন নিঃসরণ হ্রাসে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে এ গবেষণায় তা উঠে এসেছে।

সাংবাদিক সম্মেলনে টিআইবি’র পক্ষ থেকে গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ হ্রাসে উত্থাপিত সুপারিশগুলো হলো: গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ কমানোর জন্য দক্ষিণ এশীয় সরকারগুলোর গৃহীত পদক্ষেপগুলোকে অংশীজনের মতামতের ভিত্তিতে আরও নিরীক্ষণ করা এবং তার ভিত্তিতে অগ্রাধিকারমূলক পদক্ষেপসমূহের তালিকা পুনঃনির্ধারণ করা; জ্বালানি দক্ষ উৎপাদন ও ভোগ ব্যবস্থায় পরিবর্তনের মাধ্যমে গ্রিন হাউস গ্যাস নিঃসরণ কমানোর জন্য প্রণোদনা নীতিমালা গ্রহণ করা এবং সরকারের কর, ভর্তুকি ও অন্যান্য নিয়ন্ত্রণমূলক নীতিমালা পরীক্ষা করে জ্বালানি দক্ষতা বৃদ্ধির মাধ্যমে গ্রিন হাউস গ্যাস নিঃসরণ কমানোর জন্য উন্নয়ন সহযোগীদের পক্ষ থেকে প্রয়োজনীয় সহায়তা প্রদান করা। 

উল্লেখ্য, দক্ষিণ এশিয়ার কার্বন নিঃসরণ মাত্রা যদিও বিশ্বের মাত্র ছয় শতাংশ তবুও ১৯৯৭ সাল থেকে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর কার্বন নিঃসরণের গড় বৃদ্ধির হার প্রায় তিন শতাংশ যা বিশ্বের গড় বৃদ্ধির হারের তুলনায় বেশি (বিশ্ব গড় বৃদ্ধির হার এক শতাংশ)।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ