মঙ্গলবার ২১ মে ২০২৪
Online Edition

সড়ক-মহাসড়কের বেহাল অবস্থা

মোহাম্মদ জাফর ইকবাল : দেখতে দেখতে পবিত্র মাহে রমযানের অর্ধেক চলে গেছে। ঈদুল ফিতরের আর বেশি বাকী নেই। এ মাসের মাঝামাঝি উদযাপিত হবে পবিত্র ঈদুল ফিতর। প্রিয়জনের সঙ্গে ঈদ করতে বাড়ির উদ্দেশে ছুটবে মানুষ। ঈদ উপলক্ষে ঘরমুখো মানুষের যাত্রা শুরু হবে চলতি সপ্তাহের শেষ দিক থেকে। কিন্তু আশঙ্কা করা হচ্ছে এবারও চরম ভোগান্তিতে পড়তে হতে পারে ঘরমুখো মানুষকে। রাজধানীর বাইরে বিভিন্ন গন্তব্যে যেতে সড়কে এখনই যানজটের যে খবর পাওয়া যাচ্ছে ঈদের আগে পরিস্থিতি কি দাঁড়ায় তা নিয়ে প্রবল শঙ্কা।
সূত্র মতে, সারা দেশের সড়ক-মহাসড়কের অবস্থা ভালো নয়। চলাচলের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে অধিকাংশ সড়ক। ফলে আসন্ন ঈদে ঘরমুখো মানুষকে দীর্ঘ যানজটে আটকে পড়ে বিড়ম্বনার মুখে পড়তে হতে পারে। বিভিন্ন স্থানে সড়ক-মহাসড়কের বেহাল অবস্থা। কোথাও রাস্তা ভাঙা, কোথাও জলাবদ্ধতা। কোথাও চলছে সংস্কার কাজ। এদিকে দেখা যাচ্ছে, ঈদ সামনে রেখে জোড়াতালি দিয়ে চলছে সড়ক-মহাসড়কের সংস্কার কাজ। এতে ঈদযাত্রায় ভোগান্তির আশঙ্কা করছেন পরিবহন মালিক, শ্রমিক ও সাধারণ মানুষ।
সম্প্রতি সংবাদমাধ্যমে সড়ক ও জনপথ অধিদফতরের (সওজ) মহাসড়ক ব্যবস্থাপনা বিভাগের সর্বশেষ জরিপের তথ্য উদ্ধৃত করে এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশে সড়ক ও মহাসড়কের ২ হাজার ৬শ’ কিলোমিটারের বেশি সড়ক ভাঙাচোরা। এর মধ্যে ১ হাজার ৫৪৩ কিলোমিটার সড়কের অবস্থা খুব খারাপ। বাকি ১ হাজার ৭৩ কিলোমিটার সড়কের অবস্থাও নাজুক। ভাঙাচোরা সড়কের কারণে দুর্ঘটনাসহ নানা সমস্যা সৃষ্টি হচ্ছে। সড়কের দুরবস্থার কারণে যানজট প্রকট আকার ধারণ করে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ঈদ উপলক্ষে যান চলাচল স্বাভাবিকভাবেই বেশি হবে। আর তখন সমস্যা হবে আরো বেশি। ঈদে ঘরমুখো মানুষের ভিড় সামাল দিতে বিশেষ সার্ভিস চালু হয়। এ সময় আঞ্চলিক রুটের অনেক যানবাহনও চলে আসে মহাসড়কে। যত্রতত্র বাস থামিয়ে যাত্রী ওঠানামা চলে। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, মাঝরাস্তায় গাড়ি থামিয়ে যাত্রী তোলা কিংবা নামানো হচ্ছে। এতে যানবাহনের লম্বা লাইন পড়ে গিয়ে যানজটের সৃষ্টি হয়। এছাড়া বিভিন্ন স্থানে সড়ক-মহাসড়ক দখল করে গড়ে উঠেছে অবৈধ হাটবাজার। এ কারণে স্বাভাবিকভাবে যানবাহন চলাচল করতে পারে না। চালকদের ধীর গতিতে গাড়ি চালাতে হয়। ফলে দূরপাল্লার যানবাহনগুলোকে গন্তব্যে পৌঁছাতে নির্ধারিত সময়ের চেয়ে তিন থেকে ছয় ঘণ্টা সময় বেশি লেগে যায়। কোনো কোনো স্থানে পৌঁছাতে আরও বেশি সময় লাগে। ঈদের আগে এ সমস্যা আরো প্রকট হওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। এতে ঘরমুখী মানুষকে অবর্ণনীয় দুর্ভোগে পড়তে হতে পারে। এ অবস্থায় যত দ্রুত সম্ভব সড়ক মেরামতের কাজ সম্পন্ন করতে হবে।
কয়েকদিন আগে গাজীপুরের চন্দ্রায় সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, যানজট নিরসন ও ভোগান্তি কমাতে পুলিশ, সড়ক ও জনপথ এবং স্থানীয় প্রশাসন সমন্বিতভাবে কাজ করবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলে দিয়েছেন, রাস্তাকে চলাচল এবং ব্যবহার উপযোগী রাখতে হবে। বর্ষাকালে বৃষ্টি হবে, তবে বৃষ্টিকে অজুহাত করে রাস্তার মেরামত কাজ সঠিকভাবে হবে না, এটা আমি শুনব না। তিনি আগামী ৮ জুনের সারা দেশের রাস্তা মেরামত করে যেকোনো মূল্যে রাস্তাকে সচল রাখার জন্য সংশ্লিষ্টদের নির্দেশ দিয়েছেন। জানা গেছে, মন্ত্রীর এ বক্তব্য শেষ হতে মাত্র দুই দিন বাকি। কিন্তু দেশের কোথাও সেভাবে সড়ক মহাসড়ক গুলোর মেরামত হয়নি।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশের সড়ক-মহাসড়কের ভয়াবহ অবস্থা বন্যা বা বৃষ্টির মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে নয়।  মূল কারণ মেরামতের কাজে সরকারের অনাগ্রহ এবং উদাসিনতা। বাস্তবে দেশের কোনো এলাকার সড়ক-মহাসড়কের মেরামতের কাজই এখনো শুরু হয়নি। ফলে এবারের প্রবল বৃষ্টি ও বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত সকল সড়ক-মহাসড়কই অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ ও বিপদজনক হয়ে উঠেছে। গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবরে জানানো হয়েছে, সবচেয়ে বেশি খারাপ এখন টাঙ্গাইল হয়ে উত্তরাঞ্চল অভিমুখীন প্রতিটি সড়ক-মহাসড়ক। এসব সড়ক সিরাজগঞ্জ, বগুড়া, রংপুর, গাইবান্ধা, দিনাজপুর, সৈয়দপুর, ঠাকুরগাঁও, পঞ্চগড় ও কুড়িগ্রামসহ বিভিন্ন জেলা ও এলাকা পর্যন্ত গেছে। কিন্তু সড়ক-মহাসড়কগুলোর অবস্থা এতটাই শোচনীয় হয়ে পড়েছে যে, দু’-তিন ঘণ্টার দূরত্ব পার হতেও আজকাল সাত-আট ঘণ্টা, এমনকি ১০ ঘণ্টা পর্যন্ত সময় লাগছে। ক্লান্ত যাত্রীরা বিরক্ত তো হচ্ছেনই, বিপন্ন হচ্ছেন বিশেষ করে অসুস্থ রোগীরা। বিশেষ করে শিশু ও নারীদেও অবস্থা খুবই করুণ। একই অবস্থা ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কেরও। ঢাকা-চট্টগ্রাম এবং ঢাকা-সিলেট মহাসড়কও চলাচলের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। ফেনীর ফতেহপুরে একটি ওভার ব্রীজ নির্মাণকে কেন্দ্র করে গত কয়েকমাস ধরে এই অঞ্চলের মানুষ দারুণ ভোগান্তিতে পড়েছে। মাত্র ১০ মিনিটের রাস্তা পার হতে সময় লাগছে ছয় থেকে সাত ঘন্টা। ফলে ঢাকা থেকে ফেনী যেতে লাগে প্রায় ৮/৯ ঘন্টা।
সূত্র মতে, এবারের দেড় মাসের বৃষ্টিতেই প্রায় সকল এলাকার সড়ক-মহাসড়কগুলো বহুস্থানে ভেঙে পড়েছে। সৃষ্টি হয়েছে শত শত ছোট-বড় গর্ত ও খানা-খন্দকের। ইট-বালু-সিমেন্ট সরে যাওয়ায় এবড়ো-থেবড়ো হয়ে পড়েছে প্রতিটি সড়ক-মহাসড়ক। এই অবস্থায় সামনে যদি বন্যা হয় তাহলে এইসব সড়কে যানবাহনই চলাচল করবেনা। গণমাধ্যমের রিপোর্টে জানা গেছে, সব মিলিয়ে দেশের ৪৫ হাজার কিলোমিটার সড়ক-মহাসড়ক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সেগুলোর প্রতিটিই বিপদজনকও হয়ে উঠেছে।
সড়ক ও জনপথ বিভাগের উদ্ধৃতি দিয়ে গণমাধ্যমের খবরে জানানো হয়েছে, প্রায় ৪৫ হাজার কিলোমিটার সড়ক-মহাসড়কের মধ্যে মাত্র ৩৯ শতাংশ ভালো তথা চলাচলের উপযোগী অবস্থায় থাকলেও ৩৭ শতাংশই ভাঙাচোরা ও খানা-খন্দকে ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে। মোটামোটি চলাচল করা যাচ্ছে মাত্র ২৪ শতাংশ সড়ক-মহাসড়ক দিয়ে। তবে এগুলোরও সংস্কার করা দরকার। তাছাড়া অনেক স্থানেই বেশ কিছু ব্রিজ ও কালভার্ট ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এমন কিছুও রয়েছে, যেগুলো নতুন করে নির্মাণ না করা হলে ওই সব সড়ক-মহাসড়ক দিয়ে কোনো যানবাহনই চলাচল করতে পারবে না। অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, মানুষের স্বাভাবিক যাতায়াতের স্বার্থে তো বটেই, জাতীয় অর্থনীতির সুষ্ঠু বিকাশের জন্যও অনতিবিলম্বে প্রতিটি সড়ক-মহাসড়কের সংস্কার এবং প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে নির্মাণ কাজ শুরু করা দরকার। না হলে মানুষের যাতায়াত বাধাগ্রস্ত হওয়ার পাশাপাশি পণ্যের পরিবহনও ভীষণভাবে বাধাগ্রস্ত হবে। যার কুফল শেষ পর্যন্ত জাতীয় অর্থনীতিকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে।
ঢাকা-রংপুর রুটে চলাচলকারী বাস সার্ভিস আগমনী এক্সপ্রেসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোস্তফা আজাদ চৌধুরী জানান, ঢাকা থেকে সড়কপথে রংপুর যেতে এখন সময় লাগে অন্তত ১০ ঘণ্টা। অথচ এক যুগ আগেও ৩৩৫ কিলোমিটার দীর্ঘ এই সড়ক পাড়ি দেওয়া যেত মাত্র ৫ ঘণ্টায়। কিন্তু এবার ঈদযাত্রায় এই সড়ক পাড়ি দিতে আরও বেশি সময় লাগবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
সড়ক ও জনপথ (সওজ) অধিদপ্তরের ব্যবস্থাপনা বিভাগের সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী, দেশের প্রায় পৌনে চার হাজার কিলোমিটার জাতীয় মহাসড়কের ৮শ কিলোমিটারই ভাঙাচোরা। ২৩৯ কিলোমিটারের অবস্থা খুবই খারাপ। আঞ্চলিক মহাসড়কের ৯২০ কিলোমিটারও কমবেশি ভাঙাচোরা এবং ২৯৪ কিলোমিটার চলাচলের অযোগ্য। প্রায় তিন হাজার কিলোমিটার জেলা সড়কও খানাখন্দে ভরা।  সরকারি পর্যবেক্ষণ মোতাবেক, ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের সাতটি, ঢাকা-উত্তরবঙ্গ মহাসড়কের চারটি এবং ঢাকা-ময়মনসিংহের তিনটি স্থান যানজটপ্রবণ। ভাঙা রাস্তা, চলমান নির্মাণ কাজ এবং অব্যবস্থাপনাকে যানজটের কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। ঈদুল ফিতর সামনে রেখে পরিস্থিতি সামাল দিতে গত মাসে বিস্তারিত পরিকল্পনা হাতে নেয় সড়ক পরিবহন বিভাগ। ঈদের আগেই মহাসড়কে চলমান নির্মাণ ও সংস্কার কাজ সম্পন্ন করার সিদ্ধান্তও গৃহীত হয়। কিন্তু পরিকল্পনার অধিকাংশই এখনও বাস্তবায়ন না হওয়ায় যানজট থেকে রেহাই মেলেনি।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. শামছুল হকের মতে, ঈদের আগে মহাসড়ক মেরামতের এই প্রক্রিয়া ত্রুটিপূর্ণ। প্রতি বছর ঈদের আগে কোটি কোটি টাকা ব্যয়ে সড়ক মেরামতের ধুম পড়ে। কিন্তু এসব সাময়িক সংস্কার টেকসই হয় না। এ খাতের পুরো ব্যয়ই মূলত জলে যায়।
ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের টঙ্গী থেকে চৌরাস্তা অংশে নিত্যদিনই দীর্ঘ যানজট হচ্ছে। সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয়ের সভায় জানানো হয়, গাজীপুরের তারগাছ এলাকায় বর্তমানে গাড়ির গতি ঘণ্টায় এক কিলোমিটারও নয়। বাস র‌্যাপিড ট্রানজিট (বিআরটি) প্রকল্পের আওতায় মহাসড়কের দুই পাশে ড্রেন খোঁড়ায় যান চলাচলের জায়গা সরু হয়েছে। এতে যানজট হচ্ছে। সড়ক পরিবহন সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্যাহ বলেন, মাত্র ১২ কিলোমিটার পাড়ি দিতে এখনই তিন থেকে চার ঘণ্টা সময় লাগছে। ঈদ মৌসুমে ভোগান্তি বাড়বে বলে আশঙ্কা করছেন যাত্রীরা।  ঢাকা-সিলেট মহাসড়কে বৃষ্টির কারণে খানাখন্দ সৃষ্টি হওয়ায় যান চলাচলে বিঘ্ন ঘটছে।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ