শনিবার ১১ মে ২০২৪
Online Edition

বিশ্বে তেল এতো গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ হয়ে উঠল কীভাবে?

২৬ সেপ্টেম্বর বিবিসি : ১৮৫৯ সালের ২৭ আগস্ট একটি গুরুত্বপূর্ণ বার্তা পাঠানো হল। উদ্যোক্তা এডউইন ড্রেকের শেষ আর্থিক সহায়তাকারী অবশেষে ধৈর্য্য হারিয়ে ফেলেছেন। তিনি তার পাঠানো ওই বার্তায় বলেছেন, আপনার ঋণ পরিশোধ করুন, হাল ছেড়ে দিন এবং বাড়িতে ফিরে আসুন। ড্রেক আশা করেছিলেন যে, তিনি হয়তো পাথরের ভাজে তেলের সন্ধান বা ‘রক অয়েল’ খুঁজে পাবেন। রক অয়েল হচ্ছে, এক ধরণের বাদামী বর্ণের ‘অপরিশোধিত’ তেল যা কখনও কখনও পশ্চিম পেনসিলভেনিয়ার বিভিন্ন জায়গায় মাটিতে বুদবুদ আকারে বের হয়।

তিনি ভেবেছিলেন যে, এই তেলকে পরিশোধিত করে কেরোসিনে পরিণত করবেন তিনি। যা ল্যাম্প জ্বালানোর কাজে ব্যবহার করা যাবে। আর একই সাথে এটিই হবে ক্রমবর্ধমান হারে দাম বেড়ে চলা তিমির তেলের বিকল্প। এছাড়া এর বাই প্রোডাক্ত বা উপ-জাত পদার্থ হিসেবে যা পাওয়া যাবে তা হলো গ্যাসোলিন। কিন্তু তিনি যদি এর জন্য কোন ক্রেতা খুঁজে না পান তাহলে এটি ফেলেও দেয়া যাবে।

বার্তাটি পাঠানো হলো ঠিকই, কিন্তু ড্রেকের কাছে তখনো এটি পৌঁছায়নি। এরইমধ্যে মাটির নিচে থাকা একটি অপরিশোধিত তেল ভান্ডারে পৌছায় তার ড্রিল। ফলে অতিরিক্ত চাপের কারণে ৬৯ ফুট নিচ থেকে তেল বের হতে শুরু করে। শেষ পর্যন্ত বেঁচে যায় তিমিগুলো এবং পৃথিবীও পরিবর্তিত হতে যাচ্ছিল। কয়েক বছর পরে,মাত্র কয়েক মাইল দক্ষিণে তেল ভান্ডারে কি পরিমাণ মজুদ রয়েছে তার ইঙ্গিত পাওয়া যায়।

নিউইয়র্ক টাইমসের মতে, পেনসিলভেনিয়ার পিথোলে ১৮৬৪ সালে যখন প্রথম তেল পাওয়া যায়, তখন সেখানকার ৬ মাইলের মধ্যে ৫০ জন বাসিন্দাও ছিল না।

বছর খানেক পরে, পিথোলের বাসিন্দা ১০ হাজার ছাড়িয়ে যায়। গড়ে ওঠে ৫০টি হোটেল, দেশের সবচেয়ে ব্যস্ত পোস্ট অফিসগুলোর মধ্যে একটি, দুটি টেলিগ্রাফ স্টেশন এবং কয়েক ডজন পতিতালয়। কিছু লোকের ভাগ্য খুলে যায়। কিন্তু বাস্তবে অর্থনীতি বেশ জটিল এবং স্বাবলম্বীও বটে। কিন্তু পিথোল এর কোনটিই ছিল না এবং এক বছরের মধ্যে এটি বিরান হয়ে যায়। এর তেলের মজুদ বেশিদিন টেকেনি। কিন্তু জ্বালানীর জন্য আমাদের তৃষ্ণা বেড়েই যাচ্ছিল। কেননা তেলের উপর ভর করেই আধুনিক অর্থনীতি গড়ে উঠেছিল।

বিশ্বের শক্তির উৎসের এক তৃতীয়াংশেরও বেশি দখল করে রেখেছে তেল।

যেটা কিনা কয়লা, পরমাণু, জলবিদ্যুত এবং নবায়নযোগ্য শক্তি- এই তিনটি উৎস মিলিয়ে যা হয় সেটির তুলনায় দ্বিগুন। তেল এবং গ্যাস মিলে আমাদের বিদ্যুৎ শক্তির প্রায় এক চতুর্থাংশ সরবরাহ করে থাকে। প্লাস্টিক তৈরির কাঁচামালও আসে এটি থেকে। আর পরিবহন খাত তো রয়েছেই। এডউইন ড্রেকের হয়তো মাথায় প্রশ্ন থাকতে পারে যে গ্যাসোলিন কে কিনবে, অভ্যন্তরীন জ্বালানি ইঞ্জিন তার এই প্রশ্নেরই যেন উত্তর নিয়ে আসে। গাড়ি থেকে শুরু করে ট্রাক, কার্গো জাহাজ থেকে শুরু করে জেট প্লেন, তেল ভিত্তিক জ্বালানী এখনও মানুষ এবং পণ্যদ্রব্য বিভিন্ন জায়গায় পরিবহন করে থাকে। আর তাই বিস্ময়ের অবকাশ নেই যে, তেলের দাম তাৎক্ষনিকভাবেই বিশ্বের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একক দাম।

১৯৭৩ সালে, যখন আরব রাষ্ট্রগুলো কিছু ধনী জাতির কাছে তেল বিক্রিতে অসম্মতি জানালো, তখন মাত্র ছয় মাসে ব্যারেল প্রতি দাম ৩ ডলার থেকে বেড়ে ১২ ডলারে গিয়ে ঠেকে। এর কারণে বৈশ্বিক অর্থনীতিতে মন্দা দেখা দেয়। ১৯৭৮, ১৯৯০ এবং ২০০১ সালে তেলের দাম বাড়ার কারণেই যুক্তরাষ্ট্রের মন্দা দেখা দিয়েছিলো।

অনেক অর্থনীতিবিদ বিশ্বাস করেন যে, ২০০৮ সালের বৈশ্বিক মন্দার পেছনেও আসলে তেলের রেকর্ড পরিমাণ উচ্চ দাম কাজ করেছিল। যদিও ওই মন্দার জন্য এককভাবে ব্যাংক ব্যবস্থাকে দায়ী করা হয়।

তাই, তেল থাকলে, অর্থনীতিও সচল থাকে। তাহলে আমরা কেন আসলে উদ্বেগজনকভাবে পণ্যের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ি?

ড্যানিয়েল ইয়েরগিনর ‘ম্যাজিস্টেরিয়াল হিস্টরি অব অয়েল, দ্য প্রাইজ’ শুরু হয়েছিলো উইনস্টন চার্চিলের জন্য একটি দ্বন্দ্ব দিয়ে শুরু হয়েছিল। ১৯১১ সালে রয়াল নেভির প্রধান নিযুক্ত করা হয়েছিল চার্চিলকে।

তার প্রথম সিদ্ধান্তগুলোর মধ্যে একটি ছিল, সম্প্রসারণবাদী জার্মানীকে মোকাবেলা করতে, এর যুদ্ধ জাহাজ গুলোকে কি ওয়েলশের কয়লা দিয়ে চালিত করা হবে নাকি দূর পার্সিয়া বা ইরানের তেল দ্বারা চালিত করা হবে?

কিন্তু এ ধরণের অনিশ্চিত একটি উৎসের উপর কেউ কেন নির্ভর করবে?

কারণ, তেল চালিত যুদ্ধ জাহাজ গুলো দ্রুততর, উচ্চ গতি সম্পন্ন, জ্বালানি সামলাতে কম লোকবলের দরকার হয় এবং বন্দুক ও গোলাবারুদের জন্য বেশি জায়গা পাওয়া যায়। খুব স্বাভাবিকভাবেই তেল কয়লার চেয়ে ভাল জ্বালানি ছিল।

১৯১২ সালের এপ্রিলে চার্চিলের দুভার্গ্যজনক পতন আমাদেরকে সেই একই বার্তা দেয় যার উপর ভিত্তি করে আমাদের তেলের উপর নির্ভরতা টিকে আছে এবং তার পর থেকে বৈশ্বিক রাজনীতিকে বদলে দিচ্ছে।

চার্চিলের সিদ্ধান্তের পর ব্রিটিশ ট্রেজারি অ্যাংলো-পার্সিয়ান তেল কোম্পানীর বড় অংশ কিনে নেয়। যা আসলে বিপির পূর্বসূরী।

১৯৫১ সালে ইরান সরকার এটিকে সরকারি জাতীয়তাভূক্ত করে। ব্রিটিশরা এর বিরোধিতা করে বলে যে সেটি আসলে তাদের কোম্পানী।

ইরানিরা এটিকে তাদের বলে দাবি করে। আর এই বিতর্ক পরের কয়েক দশক ধরে চলেছিল।

কয়েক দেশ বেশ ভালই করছিলো। সৌদি আরব বিশ্বের অন্যতম ধনী একটি দেশ তাদের তেল ক্ষেত্রের জন্য।

এর রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন তেল কোম্পানী সৌদি আরামকোর মূল্য অ্যাপল, গুগল কিংবা আমাজনের চেয়ে বেশি।

এখনো সৌদি আরবের অর্থনীতিকে কেউ জাপান বা জার্মানির মতো জটিল কিংবা পরিশীলিত বলে মনে করে না। এটি অনেকটা পিথোলের মতই তবে আরো বড় পরিসরে। অন্যদিকে, ইরাক থেকে ইরান, ভেনেজুয়েলা থেকে নাইজেরিয়া, কিছু কিছু তেল সমৃদ্ধ দেশ আবিষ্কারের পর থেকে উন্নতি করেছে। তবে অর্থনীতিবিদরা এতে ‘তেলের অভিশাপ’ বলে উল্লেখ করেন।

হুয়ান পাবলো পেরেজ আলফনজো, ভেনেজুয়েলার তেল বিষয়ক মন্ত্রী ১৯৬০ এর দশকে আরো বিস্তারিত বিবরণ দিয়েছিলেন।

১৯৭৫ সালে তিনি বলেন, এটা শয়তানের মল, আর আমরা এই মলে ডুবে যাচ্ছি।

রপ্তানীর কারণে মুদ্রার মানের উপর প্রভাব পড়ে। যা অভ্যন্তরীনভাবে তেল ছাড়া অন্য যেকোন পণ্যের উৎপাদন মূল্য বাড়িয়ে দিতে পারে। এর মানে হচ্ছে, উৎপাদন কিংবা জটিল সেবা শিল্পের বিকাশ কঠিন হয়ে পড়ে। 

 

ঐতিহাসিকভাবে, অনেক রাজনীতিবিদই চেষ্টা করেছেন তার দেশের তেলের বাজারে তাদের নিজেদের এবং মিত্র রাষ্ট্রগুলোর জন্য একচেটিয়া বাজার তৈরি করার। স্বৈরশাসকরাও এর ব্যতিক্রম নয়। কারো কারো জন্য হয়তো টাকা আছে- তবে এ ধরণের অর্থনীতি দুর্বল ও ভঙ্গুর হয়।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ