শনিবার ১৮ মে ২০২৪
Online Edition

মুসলিম শাসনকর্তাদের আবাসস্থল ছিল সোনার গাঁ -আমিনুল ইসলাম

ঢাকার অদূরে একটি জনপদ সোনারগাঁ। সোনার গাঁ আমাদের ঐতিহ্য। যেখানে এখন পর্যন্ত সংরক্ষিত আছে ইতিহাসের নানা স্মৃতি। লোক ও কারুশিল্পের মাধ্যমেও আমরা অতীত নিদর্শনের অস্তিত্ব খুঁজে পাই। সোনারগাঁ বাংলার মুসলিম শাসকদের অধীনে পূর্ববঙ্গের একটি প্রশাসনিক কেন্দ্র। এটি বর্তমানে নারায়ণগঞ্জ জেলার একটি উপজেলা। এর অবস্থান ঢাকা থেকে প্রায় ২৮ কিলোমিটার দক্ষিণ-পূর্বে এবং নারায়ণগঞ্জ জেলা শহর থেকে প্রায় ৮ কিলোমিটার পূর্বে মেঘনা, ব্রহ্মপুত্র ও ইসাখালী, বিধৌত এলাকায়। মধ্যযুগীয় এ নগরটির যথার্থ বা সঠিক অবস্থান নির্ণয় বা নির্দেশ করা কঠিন হলেও বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা নিদর্শনগুলো এটাই প্রমাণ করে যে, এটির পূর্বে মেঘনা, পশ্চিমে শীতলক্ষ্যা, দক্ষিণে ধলেশ্বরী ও উত্তরে ব্রহ্মপুত্র নদ দ্বারা বেষ্টিত একটি জনপদ। এখন পর্যন্ত সোনারগাঁয় নামকরণের ইতিহাস নিয়ে অনেক মতভেদ রয়েছে। অনেকের ধারণা এখানকার মাটির রং সুবর্ণ বা রক্তবর্ণ ছিল। অনেকে বলেন, দেবাসুরের যুদ্ধকালে রক্তপাতের কারণে মৃত্তিকা ধারণ করেছিল লোহিতবর্ণ। কথিত আছে, প্রাচীন নিম্নবঙ্গে বা আশপাশে ছিল কোনো সোনার খনি। সোনার গুঁড়ো ভেসে বেড়াতো বুড়িগঙ্গা বা সুবর্ণগ্রামের পার্শ্ববর্তী নদীগুলোতে। স্থায়ী মুরবিবদের মুখে শোনা গেছে, কোনো এক সময়ে এখানে হয়েছিল স্বর্ণবৃষ্টি। নামকরণের পেছনে উপরোক্ত তথ্যাবলীর কোনটি সঠিক, তা নিশ্চিতভাবে বলা না গেলেও বেশিরভাগ সূত্রে জানা গেছে, মুসলিম আমলের সোনার গাঁ নামের উদ্ভব প্রাচীন সুবর্ণগ্রামকে কেন্দ্র করেই। বহু অঞ্চলে মুসলিম অধিকার প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকে ঢাকা নগরের অভ্যুদয়ের পূর্ব পর্যন্ত সময়কালে দক্ষিণ-পূর্ববঙ্গের প্রশাসনিককেন্দ্র ছিল সোনার গাঁ। ফিরোজ শাহ চতুর্দশ শতাব্দির প্রায় প্রথমদিকে এই অঞ্চল নিজেদের দখলে নিয়ে তা অন্তর্ভুক্ত করেন লখনৌতি রাজ্যের। এর ফলে ঘটে হিন্দু রাজত্বের অবসান। সোনারগাঁ লখনৌতি রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হওয়ার পর থেকে গিয়াসউদ্দীন বাহাদুর শাহ-এর ক্ষমতালাভের (১৩২২) পূর্ব পর্যন্ত সময়ে সোনারগাঁয়ের গুরুত্ব সাময়িকভাবে কিছুটা কমে গেলেও এটি একটি বন্দর ও টাকশাল শহর হিসেবে গুরুত্ব পেতে থাকে। ১৩২৪ খৃস্টাব্দে গিয়াসউদ্দীন তুঘলক বাংলা অধিকার করে সাতগাঁও, লখনৌতি ও সোনারগাঁ- এই তিনটি প্রশাসনিক অংশ বা ইউনিটে বিভক্ত করেন। ১৩৩৮ থেকে ১৩৫২ খৃস্টাব্দ পর্যন্ত সোনারগাঁ ফখরুদ্দিন মোবারক শাহ প্রতিষ্ঠিত স্বাধীন রাজ্যের রাজধানীর মর্যাদা লাভ করে। বাংলার প্রথম স্বাধীন সুলতান ফখরুদ্দিন মোবারক শাহ। তিনি সোনারগাঁয়ের শাসনকর্তা বাহরাম খানের সাহায্যকারী ছিলেন। ১৩৩৮ খৃস্টাব্দে সুলতানের মৃত্যু ঘটলে দিল্লী হতে নতুন শাসনকর্তা নিয়োগে বিলম্ব হলে তিনি বিদ্রোহ ঘোষণা করে সোনার গাঁ অধিকার করেন। শামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহ সোনারগাঁ দখল করেন ১৩৫২ খৃস্টাব্দে। সেখান থেকে জারি করা হয় মুদ্রা। ইতিহাসে তাকে তুলে ধরা হয়েছে অত্যন্ত উদার ও বিনয় স্বভাবের লোক হিসেবে। এ সময় লখনৌতি বা গৌড়ের অধিপতি ছিলেন তারই ভাই। ঈশা খাঁ ও তার বংশধরদের শাসনামলে সোনার গাঁ ছিল তাদের রাজধানী। মুসা খানের পতনের পর (১৬১১) সোনার গাঁ মুঘল সুবাহ বাংলার একটি সরকারে পরিণত হয়। দ্রুত সোনারগাঁয়ের পতন শুরু হয় ঢাকার মুঘল রাজধানী স্থাপনের (১৬১০) পর থেকেই। সোনারগাঁয়ের একটি অংশে ঊনবিংশ শতাব্দির শেষ থেকে বিংশ শতাব্দির প্রথমদিকে গড়ে উঠেছিল পানাম নগর। নানা স্থাপত্য নিদর্শন থেকে এটা সুস্পষ্ট যে, বর্তমান পানাম নগর ও খাস নগরের মধ্যবর্তী এলাকার বিস্তৃত হিন্দু আমলের রাজধানী শহর মুসলিম আমলে সম্পূর্ণ পরিত্যক্ত হয়নি, সম্ভবত এই স্থানে প্রথমদিকের মুসলিম শাসনকর্তাদের আবাসস্থল ছিল। সোনারগাঁ বাণিজ্যিক শহর হিসেবে গড়ে ওঠে চতুর্দশ শতাব্দির প্রায় প্রথমার্ধ্বে। সোনারগাঁয়ে তৈরি ‘মসলিন' গোটা বিশ্বে খ্যাতি অর্জন করতে থাকে। সোনারগাঁয়ের সাথে চীন, ইন্দোনেশিয়া প্রভৃতি দেশের সরাসরি বাণিজ্য সম্পর্ক শুরু হয়। কিন্তু সপ্তদশ শতাব্দির দ্বিতীয় দশক থেকে এখানকার রাজনৈতিক মর্যাদা কমে যাওয়ার ফলে ক্রমে সোনারগাঁয়ের বাণিজ্যিক গুরুত্ব কমতে থাকে। বোখারার জ্ঞানতাপস হিসেবে পরিচিত মাওলানা শরফুদ্দীন আবু তওয়ামা সোনারগাঁয়ে এসে। (১২৮২ থেকে ১২৮৭ খৃস্টাব্দের মধ্যে) প্রতিষ্ঠা করেন একটি খানকাহ ও একটি মাদরাসা। এই মাদরাসার এতোই সুনাম ছিল যে, এখান থেকে জ্ঞান অর্জনকারীরা আখ্যায়িত হতেন ‘সোনার টুকরা' হিসেবে। ফলে দূর-দূরান্ত থেকে অনেকেই এখানে আসতেন শিক্ষালাভের জন্য। এই মাদরাসায় শিক্ষা দেওয়া হতো ধর্মতত্ত্ব ও সূফীতত্ত্ব সম্বন্ধে। সোনার গাঁ এক সময় ছিল সূফী-দরবেশের মিলনক্ষেত্র। এখানে সুলতান ও মুঘল আমলের প্রচুরসংখ্যক ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান চোখে পড়ে। রয়েছে মুঘল আমলের কয়েকটি সেতু ও ইংরেজ আমলের কয়েকটি আবাসিক ভবন। খাসনগর দিঘি, নীল কুঠি,-- গোয়ালদি মসজিদ, আব্দুল হামিদ মসজিদ, শাহ লঙ্গরের দরগাহ, ক্রোড়িবাড়ি, সরদার বাড়ি, ফতেহ শাহ মসজিদ, নহবতখানা, শরফুদ্দিন আবু তওয়ামার সমাধি, মুন্না শাহ দরবেশের মাজার, গিয়াসউদ্দিন আযম শাহের সমাধি, পাঁচ পীর দরগাহ ও মসজিদ, ইউসুফগঞ্জ মসজিদ ইত্যাদি এখন পর্যন্ত কালের সাক্ষী হয়ে আছে। তবে নেই এসবের যথাযথ সংরক্ষণের ব্যবস্থা। ফলে কমবেশি হারাতে বসেছে এখানকার ঐতিহ্য। বিভিন্ন স্থাপনার (পুরনো) দেয়ালের আস্তরণ খসে পড়েছে। এসবের নিচে চাপা পড়ছে এখানকার অনেক গুরুত্বপূর্ণ ইতিহাস। বর্তমান ও পরবর্তী প্রজন্মের জন্য এসব সংরক্ষণ করা খুবই জরুরি।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ