ঢাকা, সোমবার 29 April 2024, ১৬ বৈশাখ ১৪৩০, ১৯ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী
Online Edition

গানিম আল মুফতাহ্: তারুণ্যের প্রেরণা

সংগ্রাম অনলাইন ডেস্ক: কাতার বিশ্বকাপের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান সঞ্চালনার দায়িত্বে ছিলেন হলিউডের অস্কারজয়ী অভিনেতা মরগ্যান ফ্রিম্যান। অস্কারজয়ী অভিনেতার পাশে হাতে ভর করে অনুষ্ঠান দ্বিতীয় সঞ্চালকের ভূমিকায় দেখা যায় পা হীন আরেকজনকে। তিনি হলেন গানিম আল মুহতাহ। বিরল এক রোগে আক্রান্ত কাতারের সর্বকনিষ্ঠ উদ্যোক্তা। হাতে ভর দিয়ে ফ্রিম্যানের সাথে অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেই নজর কেড়েছেন পুরো বিশ্বের। সাথে উদ্বোধনীতে কোরআন তেলওয়াতের দায়িত্বটাও ছিল তার কাঁধেই। আজ পুরো বিশ্ব তার সাফল্যের স্তুতি করছে, সেটা তার কঠোর মনোবলের কারণে। মনোবলের জেরেই গানিম এখন পুরো বিশ্বের আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে।

শারীরিক অপূর্ণতা নিয়ে জন্মেও নিলেও সৃষ্টিকর্তা তাকে দিয়েছেন পাহাড় সমান মনোবল বা ইচ্ছাশক্তি যা দিয়ে ২০ বছর বয়সী এই তরুণ বিশ্বের কোটি কোটি তরুণকে চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিলেন, শরীরটাই বড় নয়, বরং বড় হলো সদিচ্ছা। সদিচ্ছা থাকলে সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ মানুষকে সাহায্য করেন।

গানিম আল মুফতাহ্ এর শরীরের নিচের অংশ নেই, জন্মের আগেই দুটো পা হারিয়ে ফেলেন। ঠিক সেটাও নয় আসলে মায়ের পেট থেকে পৃথিবীতে আসেন অর্ধেক শরীর নিয়ে।

"কোডাল রিগ্রেশন সিনড্রোম" রোগে আক্রান্ত গানিমের শরিরের নিম্নাংশ না থাকা সত্বেও তিনি গোটা কাতার তথা আরব দুনিয়ার একজন রোল মডেল। আরবের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে রয়েছে তাঁর ভক্ত ও সমর্থকবৃন্দ। তিনি একজন বিশ্ববিখ্যাত মোটিভেশনাল স্পিকার। তাঁর বক্তব্যের মাধ্যমে উজ্জীবিত, বর্ণময় হয়ে ওঠে হাজার বর্ণহীন জীবন। গানিম যখন মাতৃগর্ভে তখনই আলট্রা-সাউন্ড মেশিনে ধরা পড়ে তাঁর শরীরের অবিকশিত অংশ। ডাক্তার গর্ভপাতের পরামর্শ দেন।। কিন্তু গানিমের মা-বাবা এই পরামর্শ গ্রহণ করেননি। কারণ ইসলামের বিধান অনুযায়ী গর্ভপাত হলো চূড়ান্ত অপরাধ।

গর্ভধারিণী মা  "ইমান-উল-আবদেলি" এবং পিতা "মুহাম্মদ-আল-মুফতাহ্" এটাকে মহান আল্লাহর সিদ্ধান্ত হিসেবে মেনে নিয়ে বিকলাঙ্গ সন্তানের জন্ম দিলেন।

ইমান-উল-আবদেলি তার স্বামীকে উদ্দেশে বলেন, ‘আমি হবো সন্তানের বাম পা, আর তুমি হবে তার ডান পা। আমরা দুজনে সন্তানকে কখনো নিম্নাংশের অভাব টের পেতে দেবো না।"

৫ মে ২০০২ সালে পৃথিবীর আলো দেখেন গানিম আল মুফতাহ্। কোডাল রিগ্রেশন সিনড্রোমের সাথে জন্মেন তিনি। শিশুকাল থেকেই পদে পদে সামাজিক বঞ্চনার শিকার হয়ে পড়েন তিনি। স্কুল, খেলার মাঠ সহ বিভিন্ন জায়গায় তাকে অপমানিত করা হতো। তিনি এসবের তোয়াক্কা না করেই এগিয়ে যেতেন নিজ পথে; একেবারে নিজস্ব ছন্দে। বন্ধুদের বোঝাতেন তাঁর অসম্পূর্ণ শরীরের জন্য তিনি মোটেও দায়ী নন। আল্লাহ তাঁকে যে পরিমাণ অঙ্গ-প্রতঙ্গ প্রদান করে পাঠিয়েছেন এর জন্য তিনি কৃতজ্ঞ।

বর্তমানে মোটিভেশনাল স্পিকার হিসেবে তিনি আরব বিশ্বে তুমুল জনপ্রিয়তা পেয়েছেন। এই অর্ধেক শরীরী মানুষটাই আজ বিশ্ব দরবারে নিজের পরিচিতি তুলে ধরলেন।

ভিডিওতে দেশের সৌন্দর্য, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য তুলে ধরে বিশ্বকাপের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের সূচনা করে কাতার। মধ্যপ্রাচ্যের প্রথম ফুটবল বিশ্বকাপ, তাই স্মরণীয় করে রাখার সর্বাত্মক চেষ্টা ছিল দেশটির। সেই ভাবনা থেকেই কাতার কর্তৃপক্ষ নিজ দেশের সর্বকনিষ্ঠ উদ্যোক্তাকেই বেছে নিয়েছে। সবার নজর কাড়তেই হয়তো গানিম আল মুহতাহকে নিয়ে এসেছিল পুরো বিশ্বের সামনে।

জন্ম থেকে কডাল রিগ্রেশন সিনড্রোমে ভোগা গানিম আল মুহতাহ ছোট থেকেই পা হীন। বিশ্বে প্রায় ৬০ হাজার শিশুর মধ্যে একজনের মধ্যে দেখা যায় এই বিরল রোগ। বিরল এই রোগে আক্রান্ত শিশুদের শরীরের অর্ধেক অংশ থাকে না। ফলে অর্ধেক শরীর নিয়ে বেঁচে থাকতে হয় তাদেরকে।

অর্ধেক শরীর না থাকার বাধা বিপত্তি পেরিয়ে হাজারো মানুষের অনুপ্রেরণা হয়ে উঠেছেন গানিম আল মুহতাহ। হয়ে উঠেছেন কাতারের সর্বকনিষ্ঠ উদ্যোক্তা। কাতারে তিনি চালু করেছেন নিজস্ব আইসক্রিম ব্যবসা। তার অধীনে সেখানে কাজ করেন ৬০ জন। ইতিমধ্যেই ৬টি শাখা খোলা গানিমের চাওয়া পুরো আরব বিশ্বেই ছড়িয়ে পড়ুক তার আইসক্রিম ব্যবসা। মরুর দেশে আইসক্রিম ব্যবসার পাশাপাশি গানিমের পদচারণা আছে ইউটিউবেও। সেখানে নিজের কর্মকাণ্ড নিয়েই নিয়মিতই ভিডিও বানান তিনি।

গানিমের জন্মের আগে তার গর্ভধারিণী মাকে অনেকেই গর্ভপাত করানোর কথা বলেছিল। প্রতিকূলতা থাকবে জেনেও সেই পথে না হেঁটে, ছেলেকে পৃথিবীর আলো দেখানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন গানিমের মা। এমনকি জন্মের পর অনেক চিকিৎসকই বলেছেন ১৫ বছরের বেশি বাঁচবেন না গানিম। সব ভবিষ্যতবাণী ভুল প্রমাণের পর হাজারো বাধা বিপত্তি উপেক্ষা করে এখনও পৃথিবীর আলো দেখছেন ২০ বছর বয়সী গানিম। শুধু তাই নয়, হয়ে উঠেছেন অনেকের প্রেরণা উৎস।

অবশ্য এর পিছনে গানিমের ইচ্ছাশক্তি ও কঠোর মনোবলের প্রশংসা করতে বাধ্য যে কেউ। মায়ের অনুপ্রেরণায় নিজ ইচ্ছাশক্তিতে হয়ে উঠেছেন কাতারের সবচেয়ে কম বয়সী উদ্যোক্তা। এখন স্বপ্ন দেখেন পুরো উপসাগরীয় অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়বে তার ব্যবসা।

ইউটিউব বা ব্যবসার পাশাপাশি খেলাধুলাতেও ছোট থেকেই নিজেকে জড়িয়ে রেখেছেন গানিম আল মুহতাহ। শরীরের অর্ধেক অংশ না থাকার পর সাধারণ মানুষের মতো ফুটবলও খেলেছেন। হাতে মোজা পড়ে সাধারণ মানুষের সাথে ফুটবল খেলার অভিজ্ঞতা আছে তারা।

শুধু ফুটবল নয়, সাঁতার,স্কুবা ডাইভিং, হাইকিং কিংবা স্কেট বোর্ডিংয়েও সমান পারদর্শী গানিম। এখন তার ইচ্ছা কাতারের হয়ে প্যারা অলিম্পিকে অংশ নেওয়া ও পদক জয়।

ব্যবসা, ইউটিউব ও খেলার মাঠের পর গানিমের নজরকাড়া পারফর্মেন্স আছে পর্বতারোহণেও। ইতিমধ্যেই উপসাগরীয় অঞ্চলের সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গ জেবেল শামসে পর্বতারোহণ শেষ করেছেন। জন সম্মুখে ঘোষণা দিয়েছেন তার পরের লক্ষ্য মাউন্ট এভারেস্ট জয়।

মাঠের বাইরের কঠিন মনোবলের অধিকারী গানিম পড়ার টেবিলেও কম যান না। কাতারের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্র বিজ্ঞানে পড়াশুনার লক্ষ্য ঠিক করে রেখেছেন। তার চাওয়া, রাষ্টবিজ্ঞানে স্নাতক ডিগ্রি নিয়ে কাতারের প্রধানমন্ত্রীর চেয়ার সামলাবেন।

পুরো ক্যারিয়ার জুড়ে গানিমের একের পর এক সাফল্যের একমাত্র গোপন রহস্য কঠোর মনোবল। সেই মনোবলের জেরেই এখন গানিমের খ্যাতি বিশ্বজুড়ে। হয়ে উঠছেন অনেকের আদর্শ। তাই তো বলা হয়, মানসিকতার বলেই সব অসম্ভবকে সম্ভব করা যায়।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ