শনিবার ০৪ মে ২০২৪
Online Edition

মাওলানা আব্দুল আজিজসহ ৬ জনের মৃত্যুদন্ড

স্টাফ রিপোর্টার : মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় জামায়াত নেতা ও গাইবান্ধার সাবেক সংসদ সদস্য মাওলানা আবু সালেহ মুহাম্মদ আব্দুল আজিজ মিয়াসহ ৬ জনকে মৃত্যুদন্ড দিয়েছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত এই ছয় আসামীর মধ্যে পাঁচজনই পলাতক। আসামীদের বিরুদ্ধে আনা প্রথম অভিযোগে তাদের আমৃত্যু কারাদন্ড এবং ২ ও ৩ নম্বর অভিযোগে মৃত্যুদন্ড দিয়েছেন ট্রাইব্যুনাল।
গতকাল বুধবার ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান বিচারপতি মো: শাহিনুর ইসলামের নেতৃত্বে তিন সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল এই রায় ঘোষণা করেন। ট্রাইব্যুনালের অপর দুই সদস্য হলেন- বিচারপতি আমির হোসেন ও বিচারপতি মো: আবু আহমেদ জমাদার।
আব্দুল আজিজ ছাড়া মামলার অন্য আসামীরা হলেন- মো: রুহুল আমিন ওরফে মঞ্জু (৬১), মো: আব্দুল লতিফ (৬১), আবু মুসলিম মোহাম্মদ আলী (৫৯), মো: নাজমুল হুদা (৬০) ও মো: আব্দুর রহিম মিঞা (৬২)। ছয় আসামীর মধ্যে মো. আব্দুল লতিফ কারাগারে আছেন। বাকি পাঁচ আসামী পলাতক।
এদিকে মাওলানা আবদুল আজিজসহ পলাতক আসামীদের পক্ষের আইনজীবী এডভোকেট গাজী তামিম সাংবাদিকদের জানান, আমাসীদের বিরুদ্ধে প্রসিকিউশন পক্ষ যথেষ্ট সাক্ষ্যপ্রমাণ দিতে পারেননি। তারা কোন মুক্তিযোদ্ধাকে ট্রাইব্যুনালে এনে সাক্ষ্য দিতে ব্যর্থ হয়েছেন। বরং ট্রাইব্যুনালে এমন ব্যক্তিদের সাক্ষ্য গ্রহণ করা হয়েছে যাদের বয়স মুক্তিযুদ্ধের সময়ে ছিল মাত্র ১১ বা ১২ বছর। আসামী পক্ষের এই আইনজীবী আরো জানান, মাওলানা আব্দুল আজিজের বিরুদ্ধে দুুটি পত্রিকার কাটিং সাক্ষ্য হিসেবে ট্রাইব্যুনালে উপস্থাপন করা হয়েছে। অথচ এই পত্রিকা দুটির একটি রিপোর্ট প্রকাশ হয়েছে ২০০১ সালে এবং অন্যটি প্রকাশ হয়েছে ২০০৭ সালে যখন তিনি জাতীয় সংসদের নির্বাচিত সদস্য ছিলেন। আসামীরা যদি আত্মসমর্পণ করেন তাহলে উচ্চ আদালতে আপিলের বিষয়ে পরিবারের পক্ষ থেকেই সিদ্ধান্ত নেয়া হবে বলেও জানান তিনি।
গতকাল সকালে ১৬৬ পৃষ্ঠার রায় পড়া শুরু করে বেলা সাড়ে ১১ টার পর এ রায় ঘোষণা করেন ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান বিচারপতি মো. শাহিনুর ইসলাম। উল্লেখ্য, এর আগে ট্রাইব্যুনালে রাষ্ট্রপক্ষে যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করেন প্রসিকিউটর ব্যারিস্টার সৈয়দ সাইয়েদুল হক সুমন ও শেখ মোশফেক কবির।
গত ৯ মে এই মামলায় যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষে ট্রাইব্যুনালের তৎকালীন চেয়ারম্যান বিচারপতি আনোয়ারুল হকের নেতৃত্বাধীন বিচারিক প্যানেল রায়ের জন্য মামলাটি অপেক্ষমাণ রেখেছিলেন।
বিচারপতি আনোয়ারুল হক মৃত্যুবরণ করায় ট্রাইব্যুনাল পুনর্গঠন করে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়। নবগঠিত ট্রাইব্যুনাল মামলাটি পুনরায় যুক্তিতর্ক উপস্থাপনের জন্য দিন ধার্য করে আদেশ দিলে গত রোববার থেকে প্রসিকিউশনের যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শুরু হয়। এর আগে গত ১৬ এপ্রিল মামলায় রাষ্ট্রপক্ষের প্রসিকিউশনের আনা সব সাক্ষীর জবানবন্দী ও জেরার কার্যক্রম শেষ করার পর যুক্তিতর্ক উপস্থাপনের জন্য ৮ মে দিন নির্ধারণ করেছিলেন ট্রাইব্যুনাল।
উল্লেখ্য, আসামী মাওলানা আবদুল আজিজসহ গাইবান্ধার ছয়জনের বিরুদ্ধে ২০১৫ সালের ২৭ ডিসেম্বর আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল করা হয়। ওই বছরের ২৩ নভেম্বর প্রসিকিউশনের করা আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ২৬ নভেম্বর ট্রাইব্যুনাল ছয়জনের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেন। এ মামলায় মাত্র একজন আসামীকে গ্রেফতার করতে সক্ষম হয় পুলিশ। পরে জামায়াত নেতা আবদুল আজিজসহ সব আসামীকে পলাতক দেখিয়েই আদালতে মামলার বিচারিক কাজ শুরু হয়।
জামায়াতে ইসলামীর সদস্য আব্দুল আজিজ মিয়া ২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত চারদলীয় জোটের অধীনে জামায়াত থেকে গাইবান্ধা সুন্দরগঞ্জ-১ আসনের সংসদ সদস্য ছিলেন। ২০০৯ সাল থেকে ২০১৩ সালের মধ্যে তার বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলাসহ ১৩টি মামলা হয়। সুন্দরগঞ্জ থানা শাখার জামায়াতের সদস্য রুহুল আমিন ওরফে মঞ্জুর বিরুদ্ধে দু’টি মামলা রয়েছে। এ ছাড়া উপজেলা জামায়াত নেতা আব্দুল লতিফের বিরুদ্ধে সুন্দরগঞ্জ থানায় মানবতাবিরোধী অপরাধসহ তিনটি মামলা রয়েছে।
আসামীদের বিরুদ্ধে তিন অভিযোগ : মামলার প্রথম অভিযোগে বলা হয়েছে, একাত্তরের ৯ অক্টোবর সকালে আসামীরা পাকিস্তানের দখলদার সেনাবাহিনীর ২৫-৩০ জনকে সঙ্গে নিয়ে গাইবান্ধা জেলার সদর থানাধীন মৌজামালি গ্রামে হামলা চালিয়ে চারজন নিরীহ, নিরস্ত্র স্বাধীনতার পক্ষের মানুষকে আটক, নির্যাতন ও অপহরণ করে। পরে তাদের দাঁড়িয়াপুর ব্রিজে নিয়ে গিয়ে একজনকে হাত-পা বেঁধে নদীতে ফেলে দিয়ে হত্যা করে এবং বাকিদের ছেড়ে দেয়। আসামীরা আটকদের বাড়ির মালামাল লুণ্ঠন করেন।
দ্বিতীয় অভিযোগে বলা হয়, ওইদিন বিকেল ৪টার দিকে আসামীরা সুন্দরগঞ্জ থানার মাঠেরহাট ব্রিজে পাহারারত ছাত্রলীগের নেতা মো. বয়েজ উদ্দিনকে আটক করে মাঠেরহাটের রাজাকার ক্যাম্পে নিয়ে নির্যাতন করতে থাকে। পরদিন সকালে আসামীরা বয়েজকে থানা সদরে স্থাপিত পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর ক্যাম্পে নিয়ে যায়। তিন দিন আটক রেখে নির্যাতনের পর ১৩ অক্টোবর বিকেলে তাকে গুলী করে হত্যা করে মরদেহ মাটির নিচে চাপা দেয়।
তৃতীয় অভিযোগে বলা হয়, একাত্তরের ১০ অক্টোবর থেকে ১৩ অক্টোবর পর্যন্ত আসামীরা পাকিস্তান দখলদার সেনাবাহিনীর সহযোগিতায় সুন্দরগঞ্জ থানার পাঁচটি ইউনিয়নের নিরীহ-নিরস্ত্র স্বাধীনতার পক্ষের ১৩ জন চেয়ারম্যান ও মেম্বারকে অবৈধভাবে আটক করে। তাদের তিন দিন নির্যাতন করার পর পাকিস্তানি সেনাদের ক্যাম্পের কাছে নদীর ধারে নিয়ে গিয়ে গুলী করে হত্যা করে এবং তাদের মরদেহ মাটিচাপা দেয়। সেখানে ওই শহীদদের স্মরণে একটি বধ্যভূমি নির্মিত হয়েছে।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ